্থান শনাক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় লঞ্চ উদ্ধারের আশাও ক্ষীণ হয়ে আসছে। চাওয়া শুধু প্রিয়জনের লাশটি। তাই প্রশাসনের আশায় বসে না থেকে নৌকা নিয়ে প্রমত্তা পদ্মায় নেমে পড়েন অনেকেই। মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের হিসাবে, গতকাল রাত নয়টা পর্যস্ত বিভিন্ন স্থান থেকে ২১টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে আটজনের পরিচয় জানা গেছে। আর নিখোঁজের তালিকায় নাম উঠেছে ১৩৭ জনের। এর আগে গত সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছিলেন, তখন পর্যন্ত ১৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে আটটি তাঁদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। যেসব জেলা দিয়ে এই নদী প্রবাহিত, সেসব জেলার প্রশাসনকে অনুসন্ধান চালানোর জন্য বলা হয়েছে। মন্ত্রী জানান, অনেক চেষ্টা করেও লঞ্চের অবস্থান শনাক্ত করা যাচ্ছে না। সন্ধানে স্বজনেরা: মেয়ে রোকসানা, জামাই মিজানুর রহমান আর তাঁদের দুই শিশুসন্তানের খোঁজে মাওয়ায় এসেছিলেন মো. হাশেম। দুই দিন অপেক্ষার পর গতকাল সকালে নিজেই নৌকা নিয়ে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন পদ্মায়। অবশেষে শরীয়তপুরের নড়িয়ার সুরেশ্বরে ভাসমান অবস্থায় মিজানুরের লাশও পেয়ে যান। সেই লাশ নিয়ে গতকাল বিকেলে তাঁরা মাওয়া ঘাটে আসেন। মিজানুরের খালুশ্বশুর আলাউদ্দীন বলেন, সুরেশ্বরে যাওয়ার পথে তাঁরা অনেক লাশ ভাসতে দেখেছেন। কয়েকটি লাশ উল্টেপাল্টে দেখে পরে পরনের শার্ট দেখে মিজানুরের লাশ শনাক্ত করে নিয়ে এসেছেন তাঁরা। তিন দিন ধরে ১২ বছরের ছেলে জাহিদ হোসেনকে খুঁজে হয়রান পরিবহনকর্মী শহীদুল ইসলাম। দুই দিন পর মঙ্গলবার রাতে একটু ঘুমিয়েছিলেন। সকালেই তাঁর মোবাইলে ফোন আসে। চাঁদপুরের হাইমচরে ভাসমান একটি শিশুর লাশের পকেটে থাকা মুঠোফোনের সিমকার্ড থেকে নম্বর নিয়ে একজন ফোন করেছেন। কেঁদেকেটে পুরো পরিবার ছোটে মাওয়া ঘাটে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণকক্ষের দিকে। নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে জানানো হয়, চাঁদপুরের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের পরই তাঁরা লাশ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। কিন্তু বাবার কান্না তো আর থামে না। শিশু জাহিদ তাঁর মামা সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে বাকেরগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসছিল। মামা বেঁচে গেছেন, জাহিদ নিখোঁজ। নিয়ন্ত্রণকক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে বাবা শহীদুল যখন এই বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন পাশে করুণ চেহারায় দাঁড়িয়ে ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। তাঁকে দেখিয়ে তর্জনি উঁচিয়ে শহীদুল বলছিলেন, ‘উই যে, ওর লগেই আছিল আমার পোলায়। হ্যায় তো বাইচ্চা গ্যাছে, আর আমার পোলাডা গাঙে ভাইসা গেছে।’ গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত জাহিদের লাশ বুঝে পায়নি এই পরিবার। ছড়িয়ে পড়ছে লাশ: নিহত যাত্রীদের অনেকের লাশ ভাটিতে ভেসে যাচ্ছে। পদ্মা ও মেঘনা নদীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব লাশ উদ্ধার হচ্ছে। প্রথম দিন পাওয়া গিয়েছিল দুজনের লাশ। এদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার চাঁদপুরে মিলল আরও দুটি লাশ। তবে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফলে এরা ডুবে যাওয়া লঞ্চের যাত্রী কি না, তা-ও নিশ্চিত করা যায়নি। চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলায় মেঘনা নদীতে গতকাল সকাল নয়টায় ৩০-৩৫ বছর বয়সী এক নারীর লাশ ভেসে ওঠে। তাঁর পরনে রয়েছে কালো বোরকা। বেলা ১১টায় একই উপজেলার মিয়ারবাজার এলাকায় ভেসে ওঠে এক কিশোরের লাশ। বেলা তিনটায় সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের ব্যাপারীকান্দি এলাকায় পাওয়া যায় আরেকজন পুরুষের লাশ। তবে তাঁদের কারোরই পরিচয় পাওয়া যায়নি। চাঁদপুরের পুলিশ সুপার আমির জাফর বলেন, লাশগুলো উদ্ধারের পর সুরতহাল করে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের ২৭ দাগ বাজারের হাসন মিয়ার মসজিদের কাছে ইলিশা নদীতে সকাল সাড়ে ছয়টায় একটি লাশ ভেসে ওঠে। পরে লাশটি উদ্ধার করে পকেটে দুটি মুঠোফোন পাওয়া যায়। ওই মুঠোফোন থেকে সিমকার্ড সংগ্রহ করে কল করলে লাশটির পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর নাম মো. ফাইজুল ইসলাম ফাহাদ আকন। ফাইজুলের বাবা লুৎফর রহমান জানান, লঞ্চডুবির দিন তাঁর ছেলে ঢাকায় ফিরছিলেন। গতকাল বিকেলে তাঁর লাশ কাঠালিয়ার উত্তর আউড়া গ্রামে এনে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। বেলা ১১টার দিকে ভোলা সদর উপজেলার কাঁচিয়া ইউনিয়নের কাঠির মাথায় মেঘনায় ভেসে ওঠে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তির লাশ। তাঁর সঙ্গে থাকা একটি ব্যাগে নয় হাজার চার টাকা পাওয়া গেছে। এর দুই ঘণ্টা পর বেলা একটার দিকে পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের ভাংতির খাল নামক এলাকায় ভেসে ওঠে আরেকটি মেয়েশিশুর লাশ। বয়স আনুমানিক আট বছর। শিশুটির পরনে রয়েছে গোলাপি প্যান্ট ও হলুদ-নীল জামা। প্রায় একই সময়ে একই ইউনিয়নের নাদোর মিয়ারহাটে ভেসে ওঠে এক কিশোরের লাশ। তার পরনে সবুজ পাঞ্জাবি-পায়জামা। বেলা আড়াইটার দিকে ইলিশা ফেরিঘাটে মেঘনা নদী থেকে এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার পরনে গেঞ্জি ও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট রয়েছে। সর্বশেষ রাত আটটার দিকে দৌলতখান উপজেলার মেদুয়াচর এলাকায় মেঘনা নদীতে উদ্ধার হয় এক যুবকের লাশ। তিনিও অজ্ঞাতপরিচয়। ভোলার সহকারী পুলিশ সুপার রামানন্দ দাস জানান, একমাত্র পরিচয় পাওয়া ফাইজুলের লাশ তাঁর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিদের মাদারীপুরের শিবচরে লাশ শনাক্ত কেন্দ্র পাচ্চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। বরিশালে ভোলা সীমান্তবর্তী কালাবদর নদী থেকে গতকাল বেলা দেড়টার দিকে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর লাশ উদ্ধার করে বরিশাল বন্দর থানার পুলিশ। তিনি বোরকা পরিহিত। পরনে খয়েরি রঙের সালোয়ার ও হলুদের ওপর কালো ছাপার কামিজ। বয়স ৪০-৪২ বছর। তাঁর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। বরিশাল মেট্রোপলিটনের বন্দর থানার ওসি মো. রেজাউল ইসলাম বলেন, লাশটি পিনাক-৬ লঞ্চের যাত্রীর বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া বন্দরসংলগ্ন মেঘনা নদীতে ভেসে ওঠে সাত-আট বছর বয়সী এক ছেলের লাশ। মেহেন্দীগঞ্জ থানার ওসি উজ্জ্বল দে জানান, লাশটি শিবচরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পদ্মা নদীর চরআত্রা এলাকা থেকে সকাল ১০টার দিকে এক তরুণী, বেলা একটার দিকে ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাঁচিকাটা থেকে এক যুবক এবং বিকেল পাঁচটার দিকে গোসাইরহাট উপজেলার মেঘনা নদীর ঠান্ডার বাজার এলাকা থেকে তিন-চার বছর বয়সী একটি ছেলের মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশগুলো শিবচরে পাঠানো হয়েছে। শিবচরে লাশ শনাক্ত কেন্দ্রে নেওয়ার পর সেখানে চরআত্রা এলাকা থেকে উদ্ধার করা লাশটি শনাক্ত করেছেন তাঁর স্বজনেরা। তিনি হলেন মাদারীপুর সদর উপজেলার ইমা আক্তার (১৯)। আদৌ লঞ্চটি উদ্ধার হবে: কর্মকর্তারা বলছেন, নদীর স্রোত এখন অনেক বেশি। ঘণ্টায় প্রায় ১৫ নটিক্যাল মাইল, বর্ষা মৌসুমে কখনো যা ১১ নটিক্যাল মাইলে নামে। শুস্ক মৌসুমে এই নদীর স্রোতের গতি দুই থেকে তিন নটিক্যাল মাইল প্রতি ঘণ্টায় নেমে আসে। বর্ষায় নদীর পানিতে প্রচুর কাদা-পালি থাকে। এ কারণে নদীর তলদেশে কোনো কিছু পড়লে খুব দ্রুত পলিতে ঢেকে যায়। কর্মকর্তারা বলেন, তল্লাশির জন্য যে সাইড স্ক্যান সোনারযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, তা মূলত নদীর তলদেশের মসৃণতা পরিমাপ করে। অর্থাৎ তলদেশে উঁচু-নিচু থাকলে ওই যন্ত্রে তা ধরা পড়ে। এখন লঞ্চটির ওপর পলি পড়ে তলদেশের মতো মসৃণ হয়ে থাকলে এই যন্ত্র দিয়ে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মঙ্গলবার রাত ১০টা থেকে তিনটি সোনারযন্ত্র নিয়ে পাঁচটি জাহাজ একযোগে তল্লাশি শুরু করে। প্রায় ৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা তল্লাশি চালিয়েও কিছু পায়নি জহাজগুলো। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের দুটি জাহাজের নোঙর নদীর তলদেশে ফেলে আঁচড়ানোর মতো করে খোঁজাখুঁজি চলছে। তবে গতকাল সন্ধ্যায় নৌপরিবহনমন্ত্রী বলেছেন, ভারী কিছু একটা ফায়ার সার্ভিসের জাহাজে আটকেছে। এখন সেই অবস্থানে আরু খোঁজাখুঁজি করা হবে। মন্ত্রী জানান, কান্ডারি নামের একটি জরিপ জাহাজ বুধবার রাতেই মাওয়ায় এসে পৌঁছাবে। সেই জাহাজটি নদীর তলদেশের কয়েক ফুট পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম। তবে কর্তাব্যক্তিদের এসব কথায় স্বজনেরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। যাঁদের নৌকা নিয়ে লাশ খুঁজতে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, তাঁরা এখনো পাড়ে বসে রয়েছেন। গতকাল কয়েক দফায় তাঁরা বিক্ষোভ করেন। সবশেষ গতকাল সন্ধ্যায় কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। এর মধ্যে গণমাধ্যমের গাড়িও আছে। এত দিনে তৎপর নৌ মন্ত্রণালয়: গতকতাল মাওয়া ঘাটে গিয়ে দেখা যায় বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তা ঘাটে বসে লঞ্চ যাতায়াত তদারক করছেন। লঞ্চের পর্যাপ্ত বয়া আছে কি না, অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হচ্ছে কি না—এসব দেখেন তাঁরা। দিনভর বসে থেকে তাঁরা মাত্র দুটি লঞ্চকে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের জন্য জরিমানা করেন। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান জানিয়েছেন, ১৪ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী নৌ জরিপ শুরু হবে। এই জরিপে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিরাও থাকবেন। পিনাক-৬ ডুবে যাওয়ার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান নৌমন্ত্রী। তবে গতকাল পর্যন্ত মামলার কোনো আসামিই ধরা পড়েনি। মামলার এক আসামি কাওড়াকান্দি ঘাটের ইজারাদার আবদুল হাই শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি জেলা প্রশাসনের ইজারাদার। লঞ্চ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা তাঁর দায়িত্ব নয়। তবু তাঁকে মামলায় আসামি করা হয়েছে। মূলত যিনি মামলাটি করেছেন, সেই বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক (টিআই) জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ারই দায়িত্ব ছিল কাওড়াকান্দি ঘাটের নৌ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌমন্ত্রী বলেন, বিআইডব্লিউটিএর লোকবল খুবই কম। মাওয়া ঘাটের টিআইকে কাওড়াকান্দিসহ চারটি ঘাট দেখতে হয়। তাঁর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, পিনাক লঞ্চটি কাওড়াকান্দি থেকে তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ীই যাত্রী নিয়েছিল। কিন্তু এর পরে লঞ্চের অর্থলোভী কর্তৃপক্ষ কাঁঠালবাড়ী ঘাট থেকে অতিক্তি যাত্রী তোলে। এর পরই ঘটে দুর্ঘটনা। লঞ্চটি কাঁঠালবাড়ী ঘাটে থামার কথা ছিল না বলে দাবি মন্ত্রীর। প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের বরিশাল ও ভোলা অফিস, চাঁদপুর ও শরীয়তপুর প্রতিনিধি
Headlines from most popular newspapers of Bangladesh. বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রধান প্রধান দৈনিক পত্রিকার সংবাদ শিরোনামগুলো এক নজরে দেখে নিন।
Thursday, August 7, 2014
আশা নেই, তবু খুঁজে ফেরা:প্রথম অালো
্থান শনাক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় লঞ্চ উদ্ধারের আশাও ক্ষীণ হয়ে আসছে। চাওয়া শুধু প্রিয়জনের লাশটি। তাই প্রশাসনের আশায় বসে না থেকে নৌকা নিয়ে প্রমত্তা পদ্মায় নেমে পড়েন অনেকেই। মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের হিসাবে, গতকাল রাত নয়টা পর্যস্ত বিভিন্ন স্থান থেকে ২১টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে আটজনের পরিচয় জানা গেছে। আর নিখোঁজের তালিকায় নাম উঠেছে ১৩৭ জনের। এর আগে গত সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছিলেন, তখন পর্যন্ত ১৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে আটটি তাঁদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। যেসব জেলা দিয়ে এই নদী প্রবাহিত, সেসব জেলার প্রশাসনকে অনুসন্ধান চালানোর জন্য বলা হয়েছে। মন্ত্রী জানান, অনেক চেষ্টা করেও লঞ্চের অবস্থান শনাক্ত করা যাচ্ছে না। সন্ধানে স্বজনেরা: মেয়ে রোকসানা, জামাই মিজানুর রহমান আর তাঁদের দুই শিশুসন্তানের খোঁজে মাওয়ায় এসেছিলেন মো. হাশেম। দুই দিন অপেক্ষার পর গতকাল সকালে নিজেই নৌকা নিয়ে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন পদ্মায়। অবশেষে শরীয়তপুরের নড়িয়ার সুরেশ্বরে ভাসমান অবস্থায় মিজানুরের লাশও পেয়ে যান। সেই লাশ নিয়ে গতকাল বিকেলে তাঁরা মাওয়া ঘাটে আসেন। মিজানুরের খালুশ্বশুর আলাউদ্দীন বলেন, সুরেশ্বরে যাওয়ার পথে তাঁরা অনেক লাশ ভাসতে দেখেছেন। কয়েকটি লাশ উল্টেপাল্টে দেখে পরে পরনের শার্ট দেখে মিজানুরের লাশ শনাক্ত করে নিয়ে এসেছেন তাঁরা। তিন দিন ধরে ১২ বছরের ছেলে জাহিদ হোসেনকে খুঁজে হয়রান পরিবহনকর্মী শহীদুল ইসলাম। দুই দিন পর মঙ্গলবার রাতে একটু ঘুমিয়েছিলেন। সকালেই তাঁর মোবাইলে ফোন আসে। চাঁদপুরের হাইমচরে ভাসমান একটি শিশুর লাশের পকেটে থাকা মুঠোফোনের সিমকার্ড থেকে নম্বর নিয়ে একজন ফোন করেছেন। কেঁদেকেটে পুরো পরিবার ছোটে মাওয়া ঘাটে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণকক্ষের দিকে। নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে জানানো হয়, চাঁদপুরের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের পরই তাঁরা লাশ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। কিন্তু বাবার কান্না তো আর থামে না। শিশু জাহিদ তাঁর মামা সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে বাকেরগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসছিল। মামা বেঁচে গেছেন, জাহিদ নিখোঁজ। নিয়ন্ত্রণকক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে বাবা শহীদুল যখন এই বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন পাশে করুণ চেহারায় দাঁড়িয়ে ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। তাঁকে দেখিয়ে তর্জনি উঁচিয়ে শহীদুল বলছিলেন, ‘উই যে, ওর লগেই আছিল আমার পোলায়। হ্যায় তো বাইচ্চা গ্যাছে, আর আমার পোলাডা গাঙে ভাইসা গেছে।’ গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত জাহিদের লাশ বুঝে পায়নি এই পরিবার। ছড়িয়ে পড়ছে লাশ: নিহত যাত্রীদের অনেকের লাশ ভাটিতে ভেসে যাচ্ছে। পদ্মা ও মেঘনা নদীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব লাশ উদ্ধার হচ্ছে। প্রথম দিন পাওয়া গিয়েছিল দুজনের লাশ। এদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার চাঁদপুরে মিলল আরও দুটি লাশ। তবে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফলে এরা ডুবে যাওয়া লঞ্চের যাত্রী কি না, তা-ও নিশ্চিত করা যায়নি। চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলায় মেঘনা নদীতে গতকাল সকাল নয়টায় ৩০-৩৫ বছর বয়সী এক নারীর লাশ ভেসে ওঠে। তাঁর পরনে রয়েছে কালো বোরকা। বেলা ১১টায় একই উপজেলার মিয়ারবাজার এলাকায় ভেসে ওঠে এক কিশোরের লাশ। বেলা তিনটায় সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের ব্যাপারীকান্দি এলাকায় পাওয়া যায় আরেকজন পুরুষের লাশ। তবে তাঁদের কারোরই পরিচয় পাওয়া যায়নি। চাঁদপুরের পুলিশ সুপার আমির জাফর বলেন, লাশগুলো উদ্ধারের পর সুরতহাল করে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের ২৭ দাগ বাজারের হাসন মিয়ার মসজিদের কাছে ইলিশা নদীতে সকাল সাড়ে ছয়টায় একটি লাশ ভেসে ওঠে। পরে লাশটি উদ্ধার করে পকেটে দুটি মুঠোফোন পাওয়া যায়। ওই মুঠোফোন থেকে সিমকার্ড সংগ্রহ করে কল করলে লাশটির পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর নাম মো. ফাইজুল ইসলাম ফাহাদ আকন। ফাইজুলের বাবা লুৎফর রহমান জানান, লঞ্চডুবির দিন তাঁর ছেলে ঢাকায় ফিরছিলেন। গতকাল বিকেলে তাঁর লাশ কাঠালিয়ার উত্তর আউড়া গ্রামে এনে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। বেলা ১১টার দিকে ভোলা সদর উপজেলার কাঁচিয়া ইউনিয়নের কাঠির মাথায় মেঘনায় ভেসে ওঠে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তির লাশ। তাঁর সঙ্গে থাকা একটি ব্যাগে নয় হাজার চার টাকা পাওয়া গেছে। এর দুই ঘণ্টা পর বেলা একটার দিকে পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের ভাংতির খাল নামক এলাকায় ভেসে ওঠে আরেকটি মেয়েশিশুর লাশ। বয়স আনুমানিক আট বছর। শিশুটির পরনে রয়েছে গোলাপি প্যান্ট ও হলুদ-নীল জামা। প্রায় একই সময়ে একই ইউনিয়নের নাদোর মিয়ারহাটে ভেসে ওঠে এক কিশোরের লাশ। তার পরনে সবুজ পাঞ্জাবি-পায়জামা। বেলা আড়াইটার দিকে ইলিশা ফেরিঘাটে মেঘনা নদী থেকে এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার পরনে গেঞ্জি ও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট রয়েছে। সর্বশেষ রাত আটটার দিকে দৌলতখান উপজেলার মেদুয়াচর এলাকায় মেঘনা নদীতে উদ্ধার হয় এক যুবকের লাশ। তিনিও অজ্ঞাতপরিচয়। ভোলার সহকারী পুলিশ সুপার রামানন্দ দাস জানান, একমাত্র পরিচয় পাওয়া ফাইজুলের লাশ তাঁর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিদের মাদারীপুরের শিবচরে লাশ শনাক্ত কেন্দ্র পাচ্চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। বরিশালে ভোলা সীমান্তবর্তী কালাবদর নদী থেকে গতকাল বেলা দেড়টার দিকে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর লাশ উদ্ধার করে বরিশাল বন্দর থানার পুলিশ। তিনি বোরকা পরিহিত। পরনে খয়েরি রঙের সালোয়ার ও হলুদের ওপর কালো ছাপার কামিজ। বয়স ৪০-৪২ বছর। তাঁর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। বরিশাল মেট্রোপলিটনের বন্দর থানার ওসি মো. রেজাউল ইসলাম বলেন, লাশটি পিনাক-৬ লঞ্চের যাত্রীর বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া বন্দরসংলগ্ন মেঘনা নদীতে ভেসে ওঠে সাত-আট বছর বয়সী এক ছেলের লাশ। মেহেন্দীগঞ্জ থানার ওসি উজ্জ্বল দে জানান, লাশটি শিবচরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পদ্মা নদীর চরআত্রা এলাকা থেকে সকাল ১০টার দিকে এক তরুণী, বেলা একটার দিকে ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাঁচিকাটা থেকে এক যুবক এবং বিকেল পাঁচটার দিকে গোসাইরহাট উপজেলার মেঘনা নদীর ঠান্ডার বাজার এলাকা থেকে তিন-চার বছর বয়সী একটি ছেলের মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশগুলো শিবচরে পাঠানো হয়েছে। শিবচরে লাশ শনাক্ত কেন্দ্রে নেওয়ার পর সেখানে চরআত্রা এলাকা থেকে উদ্ধার করা লাশটি শনাক্ত করেছেন তাঁর স্বজনেরা। তিনি হলেন মাদারীপুর সদর উপজেলার ইমা আক্তার (১৯)। আদৌ লঞ্চটি উদ্ধার হবে: কর্মকর্তারা বলছেন, নদীর স্রোত এখন অনেক বেশি। ঘণ্টায় প্রায় ১৫ নটিক্যাল মাইল, বর্ষা মৌসুমে কখনো যা ১১ নটিক্যাল মাইলে নামে। শুস্ক মৌসুমে এই নদীর স্রোতের গতি দুই থেকে তিন নটিক্যাল মাইল প্রতি ঘণ্টায় নেমে আসে। বর্ষায় নদীর পানিতে প্রচুর কাদা-পালি থাকে। এ কারণে নদীর তলদেশে কোনো কিছু পড়লে খুব দ্রুত পলিতে ঢেকে যায়। কর্মকর্তারা বলেন, তল্লাশির জন্য যে সাইড স্ক্যান সোনারযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, তা মূলত নদীর তলদেশের মসৃণতা পরিমাপ করে। অর্থাৎ তলদেশে উঁচু-নিচু থাকলে ওই যন্ত্রে তা ধরা পড়ে। এখন লঞ্চটির ওপর পলি পড়ে তলদেশের মতো মসৃণ হয়ে থাকলে এই যন্ত্র দিয়ে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মঙ্গলবার রাত ১০টা থেকে তিনটি সোনারযন্ত্র নিয়ে পাঁচটি জাহাজ একযোগে তল্লাশি শুরু করে। প্রায় ৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা তল্লাশি চালিয়েও কিছু পায়নি জহাজগুলো। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের দুটি জাহাজের নোঙর নদীর তলদেশে ফেলে আঁচড়ানোর মতো করে খোঁজাখুঁজি চলছে। তবে গতকাল সন্ধ্যায় নৌপরিবহনমন্ত্রী বলেছেন, ভারী কিছু একটা ফায়ার সার্ভিসের জাহাজে আটকেছে। এখন সেই অবস্থানে আরু খোঁজাখুঁজি করা হবে। মন্ত্রী জানান, কান্ডারি নামের একটি জরিপ জাহাজ বুধবার রাতেই মাওয়ায় এসে পৌঁছাবে। সেই জাহাজটি নদীর তলদেশের কয়েক ফুট পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম। তবে কর্তাব্যক্তিদের এসব কথায় স্বজনেরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। যাঁদের নৌকা নিয়ে লাশ খুঁজতে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, তাঁরা এখনো পাড়ে বসে রয়েছেন। গতকাল কয়েক দফায় তাঁরা বিক্ষোভ করেন। সবশেষ গতকাল সন্ধ্যায় কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। এর মধ্যে গণমাধ্যমের গাড়িও আছে। এত দিনে তৎপর নৌ মন্ত্রণালয়: গতকতাল মাওয়া ঘাটে গিয়ে দেখা যায় বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তা ঘাটে বসে লঞ্চ যাতায়াত তদারক করছেন। লঞ্চের পর্যাপ্ত বয়া আছে কি না, অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হচ্ছে কি না—এসব দেখেন তাঁরা। দিনভর বসে থেকে তাঁরা মাত্র দুটি লঞ্চকে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের জন্য জরিমানা করেন। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান জানিয়েছেন, ১৪ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী নৌ জরিপ শুরু হবে। এই জরিপে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিরাও থাকবেন। পিনাক-৬ ডুবে যাওয়ার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান নৌমন্ত্রী। তবে গতকাল পর্যন্ত মামলার কোনো আসামিই ধরা পড়েনি। মামলার এক আসামি কাওড়াকান্দি ঘাটের ইজারাদার আবদুল হাই শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি জেলা প্রশাসনের ইজারাদার। লঞ্চ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা তাঁর দায়িত্ব নয়। তবু তাঁকে মামলায় আসামি করা হয়েছে। মূলত যিনি মামলাটি করেছেন, সেই বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক (টিআই) জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ারই দায়িত্ব ছিল কাওড়াকান্দি ঘাটের নৌ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌমন্ত্রী বলেন, বিআইডব্লিউটিএর লোকবল খুবই কম। মাওয়া ঘাটের টিআইকে কাওড়াকান্দিসহ চারটি ঘাট দেখতে হয়। তাঁর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, পিনাক লঞ্চটি কাওড়াকান্দি থেকে তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ীই যাত্রী নিয়েছিল। কিন্তু এর পরে লঞ্চের অর্থলোভী কর্তৃপক্ষ কাঁঠালবাড়ী ঘাট থেকে অতিক্তি যাত্রী তোলে। এর পরই ঘটে দুর্ঘটনা। লঞ্চটি কাঁঠালবাড়ী ঘাটে থামার কথা ছিল না বলে দাবি মন্ত্রীর। প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের বরিশাল ও ভোলা অফিস, চাঁদপুর ও শরীয়তপুর প্রতিনিধি
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment