Friday, August 29, 2014

মুক্তিযোদ্ধা সনদ ছাড়াই চাকরির মেয়াদ বাড়ল পাঁচ অধ্যাপকের:প্রথম অালো

ভবিষ্যতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ জমা দেবেন—এই শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ অধ্যাপক ও এক কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। নিয়মানুযায়ী, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সনদ জমা দেওয়ার পর স্বাভাবিক সময় শেষে চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর কথা। গত ২২ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সভায় এই ছয়জনের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। গত ১ জুলাই থেকে চার শিক্ষক ও এক কর্মকর্তা এই সুবিধা ভোগও ক
রছেন। ২০১১ সালের ৬ জুলাই সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের অবসর গ্রহণের বয়স ৬৫ হইতে ৬৭ বৎসর এবং কর্মরত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়স ৬০ হইতে ৬২ বছর কার্যকর করা হউক। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে সনদ নেওয়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।’ কিন্তু গত ২২ জুনের সভায় ওই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা হয়েছে। ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীদের চাকরির মেয়াদ সাধারণ গণকর্মচারীদের চেয়ে এক বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সুবিধা-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মুক্তিযোদ্ধা সনদসহ আবেদন করতে হবে। চাকরিতে যোগদানের সময়ই যিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন, তিনিই কেবল এ আবেদন করতে পারবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের এই বিধানও মানেনি। সুবিধাপ্রাপ্তরা মুক্তিযোদ্ধা সনদ জমা দেননি। নজিরবিহীনভাবে তাঁদের চাকরির বয়স দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। সিন্ডিকেটের গত ২২ জুনের সভায় উপস্থিত সূত্র জানায়, ছয়জনের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সিন্ডিকেটের অন্তত চারজন সদস্য আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। সিন্ডিকেটের সভার কার্যবিবরণীতেও এই চারজনের ভিন্নমতের কথা উল্লেখ আছে। সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরিন আহমাদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন মোল্যা, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আজিজুর রহমান, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ইকবাল আহমেদ, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আহসান আলী। এ ছাড়া বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের প্রিন্সিপাল আবাসিক শিক্ষক সুলতানা রাজিয়াও এই সুবিধা নিচ্ছেন। তবে অধ্যাপক নাসরিন আহমাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনই করিনি। আমার চাকরির মেয়াদ শেষ হতে আরও এক বছর বাকি। তাঁদের সঙ্গে কেন আমার নাম জুড়ে দেওয়া হলো, তা বোধগম্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘একদিন অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন মোল্যা একজন পিয়নকে দিয়ে আমার কাছে একটি চিঠি পাঠান। খুলে দেখি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর ডিও লেটার (আধা সরকারি পত্র)। কিন্তু চিঠিটি শুধু উপাচার্যকে পাঠানো হয়েছে, আমাদের কোনো কপি দিতে বলা হয়নি। কেন তিনি তা আমাকে পাঠালেন, তাও আমি জানি না।’ ২২ জুনের সভায় সিন্ডিকেট সদস্যদের জানানো হয়, এই ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে বলা আছে, ‘এই পাচঁজন শিক্ষক ও একজন কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ জমা দেবেন—এই শর্তে তাঁদের চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হইল। অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন মোল্যা গত বছরের ৩০ জুন অবসরে গেছেন বিধায় তাঁর এলপিআরের সময় স্বাভাবিক চাকরিকাল হিসেবে গণ্য হবে এবং ২০১৫ সালের ৩০ জুন থেকে এলপিআর কার্যকর হবে।’ তবে সভার এ সিদ্ধান্তে সিন্ডিকেটের সদস্য অধ্যাপক ড. তাজমেরী এস এ ইসলাম, মো. লুৎফর রহমান, মো. হাসানুজ্জামান ও মাজহারুল আনোয়ার তাঁদের সনদ পাওয়ার আগে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে আপত্তি করেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের অনুরোধে ৪ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক একটি ডিও লেটার পাঠিয়েছেন। তাতে জানানো হয়, অধ্যাপক নাসরিন আহমাদ, গিয়াস উদ্দিন মোল্যা ও অধ্যাপক ইকবাল আহমেদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। তবে অন্তর্ভুক্তির জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সুপারিশ প্রয়োজন। বর্তমানে জামুকার কমিটি না থাকায় সুপারিশ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। জামুকার কমিটি গঠন হওয়ার পর আবেদনকারীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জানতে চাইলে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী একটি ডিও লেটার দিয়ে বলেছেন যে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। সে বিবেচনায় আমরা সাময়িকভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ ডিও লেটারে বিবেচনার কথা উল্লেখ নেই জানালে উপাচার্য বলেন, ‘আমি বোঝাতে চেয়েছি, জামুকার কাজ বন্ধ ছিল। এখন নতুন কমিটি হয়েছে। সনদ দেওয়ার পরই তাঁদের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। আর কোনো কারণে কেউ সনদ দেখাতে না পারলে তাঁকে পেনশন-সুবিধা দেওয়া হবে না।’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক অবশ্য এভাবে মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত বা সনদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিইনি। তাঁরা আবেদন করেছেন, নিয়মানুযায়ী যা হওয়ার হবে। আমরা ডিও লেটারে বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছি।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমান ২৫ জুন নাসরিন আহমাদ ছাড়া অন্যদের পাঠানো চিঠিতে জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ জমা দেবেন—এ শর্তে চাকরির সময়সীমা দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু চিঠিতে সনদ জমা দেওয়ার কোনো সময়সীমা ছিল না। জানতে চাইলে চিঠি পাঠানোর বিষয়টি স্বীকার করে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার বলেন, ‘ড. নাসরিন আহমাদের চাকরির বয়স থাকায় তাঁকে চিঠি পাঠানো হয়নি। তবে এঁদের কেউই এখনো মুক্তিযোদ্ধা সনদ জমা দেননি, এটা ঠিক।’ সরকারের প্রজ্ঞাপন ও সিন্ডিকেটের আগের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, ‘পরবর্তী বৈঠকে আমরা এটি পরিবর্তন করব। দুই বছর কেউ সুবিধা পাবে না। মন্ত্রণালয় সম্প্রতি চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ বস্তুত ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি হয়। কিন্তু অনেকে এ নিয়ম ভঙ্গ করে দুই বছর করায় ৪ আগস্ট আরেকটি প্রজ্ঞাপনে সরকার বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়। অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন মোল্যা ২০১৩ সালের ৩০ জুন থেকে অবসর-পরবর্তী ছুটিতে (এলপিআর) আছেন। তাঁর চাকরির মেয়াদও দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। জানতে চাইলে গিয়াস উদ্দিন মোল্যা গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শর্ত দিয়ে সিন্ডিকেট এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে আমার কী বক্তব্য থাকতে পারে।’ কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন এবং কার অধীনে করেছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ কোথায় করেছি না করেছি, আপনার কী দরকার! আপনি সাংবাদিক। আমি জামুকাকে এসব বলব, আপনাকে না। আপনার জানার বিষয় এটা না।’ পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আজিজুর রহমান এ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। চলতি বছরের ১ জুন আজিজুর রহমানের বিভাগীয় চেয়ারম্যান পদের মেয়াদ শেষ হয়। ৩ জুন পরবর্তী চেয়ারম্যান হিসেবে আরেকজনকে নিয়োগও দেওয়া হয়। কিন্তু আজিজুর রহমানের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর পর ২৫ জুন নতুন চেয়ারম্যানের নিয়োগের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। অধ্যাপক মোহাম্মদ আহসান আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কিন্তু সনদ অনেক আগেই জমা দিয়েছি, এখন এনএসআইয়ের যাচাই-বাছাই চলছে।’ আবার তিনি এও বলেন, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। ছয়জনের বিষয়ে যে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও জানেন না।

No comments:

Post a Comment