Wednesday, August 13, 2014

সম্প্রচার নীতিমালা সরকারের নির্বিঘেœ ক্ষমতায় থাকার হাতিয়ার:নয়াদিগন্ত

সদ্য ঘোষিত জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে এক গোলটেবিল আলোচনায় দেশের বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, এই নীতিমালা মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের নতুন কৌশল এবং বাকশাল প্রতিষ্ঠারই অংশÑ যা কেবল মতাসীনদের স্বার্থেই করা হচ্ছে। তারা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে যত অন্যায়-অপকর্ম করেছে সেগুলো যেন কেউ প্রকাশ না করতে পারে সে জন্যই এই নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নির্বিঘেœ ক্ষমতায় টিকে থাকতে এই নতুন
সম্প্রচার নীতিমালা করেছে বলে বক্তারা মন্তব্য করেন। সত্য প্রকাশের পথে বিঘœ সৃষ্টিকারী এই নীতিমালার বিরুদ্ধে চাপ অব্যাহত রাখা এবং যাতে এটিকে আইনে পরিণত না করা হয়, সে জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তারা। গতকাল জাতীয় প্রেস কাবে এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ নীতিমালাটির পে যারা কথা বলছেন, তাদেরও (সাংবাদিক) সমালোচনা করেন। ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক এই বৈঠকের আয়োজন করে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ। সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক রুহুল আমিন গাজীর সভাপতিত্বে এবং সদস্য সচিব ডা: এ জেড এম জাহিদ হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আরো বক্তব্য রাখেনÑ বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ, নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, ড্যাব সভাপতি ডা: এ কে এম আজিজুল হক, চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম, দি নিউ নেশনের সাবেক সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার ও কবি এরশাদ মজুমদার, বিএফইউজের মহাসচিব এম এ আজিজ, শিক-কর্মচারী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অধ্য সেলিম ভূঁইয়া, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক ডিজি এ কে এম হানিফ, সাবেক বিচারক রেজাউল করিম চুন্নু প্রমুখ। আলোচনায় মির্জা ফখরুল বলেন, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নতুন মোড়কে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের এক ভিন্ন উপায়। এই সম্প্রচার নীতিমালার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বলেন, সরকার গণবিচ্ছিন্ন হয়ে প্রশাসন, আদালত ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে ভিন্ন প্রক্রিয়ায় একদলীয় বাকশাল কায়েমের চক্রান্ত করছে। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, ততবারই গণতন্ত্রের ক্ষতি করেছে। তারা সরকারে থাকলেও ক্ষতি করে, বিরোধী দলে থাকলেও ক্ষতি করে। নতুন সম্প্রচার নীতিমালার মাধ্যমে অঘোষিতভাবে একদলীয় বাকশাল কায়েমের পথ পাকাপোক্ত করা হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, এই নীতিমালা এমন ব্যক্তির (তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু) হাত দিয়ে এসেছে, যিনি শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাত করতে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন। এখন নাকি তারা ওই ঘটনার কাফফারা দিচ্ছেন! সম্প্রচার নীতিমালাকে মানুষের অধিকার হরণকারী নীতিমালা আখ্যা দিয়ে মির্জা ফখরুল আরো বলেন, এর ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিনা অপরাধে কাউকে আক্রমণ করলে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। তা হলে মানুষের অধিকার থাকল কোথায়? আওয়ামী লীগ জনগণের সাথে প্রতারণা করে ক্ষমতায় টিকে রয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাদের স্বৈরাচারী রূপ দেখায়; ক্ষমতায় টিকে থাকতে আইনকানুন এবং সব প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করে। শুধু সাংবাদিকদের নয়, দেশের সর্বস্তরের মানুষকে সম্প্রচার নীতিমালার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান মির্জা ফখরুল। রফিকুল ইসলাম মিয়া সরকার ও সম্প্রচার নীতিমালার সমালোচনা করে বলেন, নির্বিঘেœ ক্ষমতায় থাকার হাতিয়ার হিসেবে আওয়ামী লীগ এই নীতিমালা করেছে। ৫ জানুয়ারির অবৈধ নির্বাচনের সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় আছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন, হত্যা, খুন, গুম করেই চলেছে। এসবের যেন কেউ সমালোচনা এবং সংবাদ প্রকাশ করতে না পারে, সে জন্যই এই নীতিমালা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে একদলীয় শাসন কায়েম করতে এই নীতিমালা কাজে লাগানো হবে বলে তিনি মনে করেন। বিচারপতি আবদুর রউফ এই নীতিমালার কঠোর সমালোচনা করে বলেন, আকাশে বেড়া দেয়ার চেষ্টা করে লাভ নেই। এই নীতিমালার নেগেটিভ অ্যাপ্রোচ হবে আর নেগেটিভ অ্যাপ্রোচ দিয়ে ভবিষ্যৎ ভালো হয় না। এর প্রভাব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপরও পড়বে।  তিনি সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে বলেন, সেখানে কথা বলা, সভা সংগঠন করার কথা আছে; যা আমাদের মৌলিক অধিকারও। কিন্তু দেশে এমন সব ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা দেয়া হয় যারা সব আইনই বাদ দিয়ে নিজেদের স্বার্থে নতুন নতুন আইন করেন। এরই প্রমাণ নতুন সম্প্রচার নীতিমালা। যারা এই নীতিমালা করেছেন তারা ব্যর্থ হবেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। শেখ হাসিনা তার বাবার পথেই চলেছেন মন্তব্য করে এরশাদ মজুমদার বলেন, বাকশাল কায়েম করতেই হাসিনা গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করতে নতুন সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। জাতীয়তাবাদী শক্তিকে এর প্রতিরোধের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, শুধু সভা সেমিনারে বসে বক্তব্য দিলে চলবে না। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর বিরোধিতা করার আহ্বান জানান তিনি। আলমগীর মহিউদ্দিন বলেন, সরকার সত্যকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় বলেই সম্প্রচার নীতিমালা করেছে। কিন্তু যত আইনই করা হোক কোনো কিছুতেই কাজ হবে না। কারণ এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগÑ যত বেশি আইন হবে তত বেশি বিশৃঙ্খলাও হবে। চাষী নজরুল ইসলাম বলেন, বাকশাল কায়েম করার উদ্দেশ্যেই আওয়ামী লীগ সরকার ভিন্ন আঙ্গিকে সম্প্রচার নীতিমালা করেছে। এই নীতিমালা শুধু মিডিয়া বা কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়; এই নীতিমালা দেশের জনগণের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। সব শক্তিকে একই প্লাটফর্মে এসে আন্দোলন করার আহ্বান জানান তিনি। ড. পিয়াস করিম বলেন, হাসানুল হক ইনু বলছেন, ‘এটি নীতিমালা, আইন নয়। কারো শাস্তি হবে না।’ এটি তিনি বলছেন চাপের মুখে। এই চাপ অব্যাহত রাখতে হবে, নইলে নীতিমালাটি আইনে পরিণত হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এই নীতিমালা হলো গণতন্ত্রকে হত্যা করার একটি অপপ্রয়াস। এমনিতে দেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট চলছে। আমরা ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আছি। পিয়াস করিম বলেন, নীতিমালায় বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি ুণœ হয় বা বন্ধুপ্রতিম দেশের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয় বা শ্রেণী অসন্তোষ দেখা দেয় এমন বিষয় নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না।  তিনি বলেন, এমন হলে তো নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মতো ঘটনা, সীমান্তে হত্যা, তোবা গার্মেন্ট নিয়ে সংবাদ পরিবেশন বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবে কি দেশ চলতে পারে। সরকারকে ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এই সরকারকে হটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বন্দী গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে হবে। বিএনপিকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার কথা বলে ড. পিয়াস করিম বলেন, আন্দোলনে ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি হলে ভিন্ন জায়গা থেকে আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে। আবদুল হানিফ বলেন, যেসব সাংবাদিক এখন এই নীতিমালার পে কথা বলছেন, তাদের এক সময় এই নীতিমালার জন্যই ভয়ঙ্করভাবে ভুগতে হবে। তিনি বলেনÑ সরকার ভেবেছে এতগুলো টিভির লাইসেন্স দিয়েছি; আমাদের গুণগান গাইতে। কিন্তু নিজস্ব দায়বদ্ধতা থেকে মিডিয়াগুলো নারায়ণগঞ্জের সাত খুন ঘটনাসহ বিভিন্ন ঘটনার সংবাদ পরিবেশন করায় এখন নীতিমালা করছে সরকার। এই নীতিমালা ভবিষ্যতে তাদের কী পরিমাণ হয়রানি করবে, তা তারা চিন্তাও করতে পারছে না। এম এ আজিজ বলেন, এই নীতিমালা দিয়ে সব মিডিয়াকে বিটিভিতে পরিণত করা হবে। বাকশালের সময় যেমন সব রকমের মানুষ নিয়ে একদল, একমতে গণতন্ত্রের নামে একদলীয় শাসনের চেষ্টা হয়েছিল, এখনো তাই হচ্ছে। মোস্তফা কামাল মজুমদার বলেন, এই শতাব্দীতে মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি করা যাবে না। এই মিডিয়া পলিসিতে মন্ত্রী (ইনু) ব্যাকস্টেপ করেছেন, আশা করি, তিনি সারেন্ডারও করবেন। যেসব সাংবাদিক আজ এই নীতিমালার পে কথা বলছেন, তাদের জন্য ভবিষ্যতে হয়রানি অপো করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সভাপতির বক্তব্যে রুহুল আমিন গাজী বলেন, এই নীতিমালা নিয়ে অবৈধ সরকার এবং সরকার সমর্থক সাংবাদিকেরা প্রথম থেকেই মিথ্যাচার করছেন। নিজেদের মতা চিরস্থায়ী করার ল্েযই এটি করছেন তারা। তিনি বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, দেশের মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে কবে এই অবৈধ সরকারের বিদায় হবে। আমরা পেশাজীবীরা রাজপথে ছিলাম এবং এখনো প্রস্তুত আছি।

No comments:

Post a Comment