Tuesday, August 19, 2014

বিচারক অপসারণ প্রক্রিয়া আরেক ধাপ এগোল:কালের কন্ঠ

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার বিধান রেখে সংবিধান সংশোধনের জন্য ‘সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন, ২০১৪’ অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। সংশোধনীতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারকদের অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান বদলে সংসদের হাতে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বিচারকদের অপসারণের এ বিধান কার্যকর করতে হলে প্রস্তাবিত সংশোধনীর আলোকে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে। সংশ
োধনী প্রস্তাবে এ আইন প্রণয়নের বিষয়টিও রয়েছে। গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া সংসদ অধিবেশনেই এ-সংক্রান্ত বিলটি পাস হবে বলে আশা করছি। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে না। বরং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সুফল লাভে জনগণের অধিকার আরো পাকাপোক্ত হবে। বিচার বিভাগের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার জন্যই বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া উচিত।’ আইন মন্ত্রণালয়ের মতো আইন কমিশন বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিলেও বিএনপি এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। দলটি বলেছে, একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই বিচারকদের অপসারণ করার বিধান করা হচ্ছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলেও ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান এক সামরিক ফরমানে ওই অনুচ্ছেদ বাতিল করে বিচারক অপসারণের জন্য জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান যুক্ত করেন। পরবর্তী সময়ে এ ফরমান আইন আকারে ১৯৭৯ সালে সংসদে পাস করানো হয়, যা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী নামে পরিচিত। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারকদের দক্ষতা ও আচরণ তদন্ত করে যদি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় তবেই রাষ্ট্রপতি বিচারককে অভিশংসন করতে পারেন। ষোড়শ সংশোধনীর জন্য প্রস্তুত খসড়ায় সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। বর্তমান সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে আটটি উপ-অনুচ্ছেদ রয়েছে। নতুন খসড়ায় ৯৬ অনুচ্ছেদে উপ-অনুচ্ছেদ থাকবে মাত্র চারটি। প্রস্তাবিত ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনীতে বলা হয়েছে- ‘(১) এই অনুচ্ছেদের বিধানাবলী-সাপেক্ষে কোন বিচারক ৬৭ (সাতষট্টি) বৎসর বয়স পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন। (২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অনুন্য দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না। (৩) এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবে। (৪) কোন বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারিবেন।’ প্রস্তাবিত এই চারটি উপদফার মধ্যে (১) ও (৪) নম্বর বর্তমান সংবিধানে বলবৎ রয়েছে। তবে ১ নম্বর উপদফায় সাতষট্টি বছর বয়সের সঙ্গে গাণিতিক ভাষায় ‘৬৭’ শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। শুধু (২) ও (৩) নম্বর উপদফা নতুনভাবে যুক্ত করা হয়েছে। এ জন্য বর্তমান সংবিধানের ২ থেকে ৭ নম্বর উপদফা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব উপদফায় বিচারক অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনসংক্রান্ত বিষয় রয়েছে। আইনমন্ত্রী জানান, সংবিধানের ৫২ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে অভিসংশন করা এবং ৭৪(২) অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে সরানোর ক্ষমতা সংসদের হাতে রয়েছে। এ ছাড়া যেকোনো মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা জানানোর ক্ষমতাও সংসদের রয়েছে। এসব সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে দেখা যায়, জনগণের কারণেই বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া যায়। সব পক্ষই যাতে সুস্পষ্টভাবে তাদের বক্তব্য বলতে পারে এবং কোনো পক্ষের যাতে আত্মরক্ষার অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়, কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়টি আইনে থাকবে। এ আইনে অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের অধিকার রক্ষা করা হবে। মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের অনুমোদনের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের যে বিধান ছিল, সংবিধান সংশোধন করে সেটিই আবার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। পাশাপাশি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারক অপসারণের নিয়মটি বাদ পড়ছে। জিয়াউর রহমানের সময় সামরিক ফরমানবলে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়। সংশোধন করে এই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে অর্পণ করা হয়। এটি করা হয়েছিল জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে, ১৯৭৮ সালে। বাহাত্তরের সংবিধানের এই বিধান দিয়ে বর্তমান সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদটি প্রতিস্থাপিত করা হবে। একজন অভিযুক্ত বিচারক ও কাউন্সিলের সদস্য একই প্রতিষ্ঠানে অনেক দিন কাজ করার কারণে তাঁরা যে সিদ্ধান্ত দেবেন তার যথার্থতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তা ছাড়া সংসদে রাষ্ট্রপতির অভিশংসন ও স্পিকারকে অপসারণ করার বিধান রয়েছে; ৫৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণেরও বিধান রয়েছে। মোশাররাফ হোসাইন বলেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকার বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে তুলে ধরা হয়েছে। অনুমোদন দেওয়ার আগে মন্ত্রিসভা বৈঠকে অন্যান্য দেশের নজির নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতে দুই কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অনুমোদন দিলে রাষ্ট্রপতি অপসারণের আদেশ দিতে পারেন। যুক্তরাজ্যের নিয়ম হলো, পার্লামেন্টের দুই কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তাব পাস হতে হবে, তারপর রানি তাতে অনুমোদন দেবেন। অপসারণের ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে দেওয়া আছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানেও। প্রতিনিধি সভা ও সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি পেলে বিচারকদের অপসারণ করা যায়। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সংবিধানে একই বিধান রয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদসচিব জানান। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়ার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে আওয়ামী লীগের গত সরকারের মেয়াদে। ২০১২ সালে তৎকালীন স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে কয়েকজন সংসদ সদস্য হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তোলেন। সে সময়ই বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার দাবি জোরালো হয়। এ ছাড়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য গঠিত কমিটিও উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করে। পাশাপাশি আইন কমিশনও বিচারপতিদের অপসারণসংক্রান্ত বাহাত্তরের মূল বিধানটি পুনর্বহালের পক্ষে মত দিয়েছে। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ  প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভায় নিয়ে আসে। এতে বলা হয়, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের যে বিধান বর্তমান সংবিধানে রয়েছে, তা ৭ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।

No comments:

Post a Comment