Monday, September 15, 2014

৪০ শতাংশ খাদ্যপণ্যই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর:নয়াদিগন্ত

নকল, ভেজাল আর নি¤œমানের পণ্যে ছেয়ে গেছে সারা দেশ। বেঁচে থাকার অনিবার্য উপাদান পানি থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, কোমলমতি শিশুর গুঁড়োদুধ থেকে বয়োবৃদ্ধের ইনসুলিন, রূপচর্চার কসমেটিক থেকে বলবর্ধক ভিটামিন, টুথপেস্ট থেকে ঘুমোতে যাওয়ার আগে এক গ্লাস দুধ পর্যন্ত সবকিছুই এখন ভেজালে ভরপুর। মাছ-দুধ-শাকসবজিতে ফরমালিন, হলুদে সিসা, মরিচে ইটের গুঁড়া, সরিষার তেলে রাসায়নিক, মশার কয়েলে ভয়ঙ্কর উপাদান, নকল ওষুধ, রসালো ফলে
রাসায়নিক, গরুর গোশতে হরমোন, মুরগির খাবারে বিষাক্ত উপকরণ। ধনীর দুলাল থেকে পথশিশু পর্যন্ত সবাইকেই স্পর্শ করেছে ভেজালের এই ভয়াবহতা। যেন ভেজালেই জন্ম, ভেজালেই বেড়ে ওঠা, ভেজালের রাজ্যেই বসবাস। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় সম্প্রতি পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ৪০ শতাংশ খাদ্যেই মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি বিষাক্ত উপাদান রয়েছে। ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাকসবজির নমুনাতেই কীটনাশকের উপস্থিতি মিলেছে। এ ছাড়া আম ও মাছের ৬৬টি নমুনায় পাওয়া গেছে ফরমালিন। চালের ১৩টি নমুনায় মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত বিষক্রিয়াসম্পন্ন আর্সেনিক, পাঁচটি নমুনায় পাওয়া গেছে ক্রোমিয়াম। হলুদের গুঁড়ার ৩০টি নমুনায় ছিল সিসা ও অন্যান্য ধাতু। লবণেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০-৫০ গুণ বেশি সিসা পাওয়া গেছে। মুরগির গোশত ও মাছে পাওয়া গেছে মানুষের শরীরের জন্য তিকর এন্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব। এ ছাড়া চারটি প্যাকেটজাত জুসের নমুনায় পাওয়া গেছে বেঞ্জয়িক এসিড, যা স্বাস্ব্যহানিকর। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মহাখালী, গুলশানসহ বেশ কয়েকটি বড় বড় বাজার থেকে ৮২টি খাদ্যপণ্য নিয়ে পরীা-নিরীা করেন গবেষকেরা। রাজধানীর বাসিন্দাদের জন্য ভেজাল ও ফরমালিনমুক্ত খাদ্যপণ্য নিশ্চিত করতে ২০১২ সালে বাজারগুলোয় ফরমালিন পরীার যন্ত্র বসানোর উদ্যোগ নেয় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেয়া মোটা অঙ্কের ডোনেশনের টাকায় ঢাকঢোল পিটিয়ে ফরমালিনমুক্ত ঘোষণা করা হয় ডজনখানেক বাজারকে। ফরমালিনমুক্ত বাজারের তালিকায় উঠেছে মগবাজার কাঁচাবাজার, শান্তিনগর কাঁচাবাজার, গুলশান-২ কাঁচাবাজার, মহাখালী কাঁচাবাজার, মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজার, মালিবাগ বাজার, উত্তরার আজমপুর বাজার, বনানী, কাপ্তানবাজার, মিরপুর-১, নিউমার্কেট বনলতা কাঁচাবাজার, বাদামতলী কাঁচাবাজার, শাহ আলী সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজার। ফরমালিন পরীার জন্য এসব বাজারে বসানো হয় ফরমালিন ডিহাইড্রেড মেশিন। কিন্তু তদারকির অভাবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওই সব মেশিন তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে সংশ্লিষ্ট বাজার কমিটির আলমিরায়। নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় বলা হয়, খাদ্যপ্রস্তুতকারী রেস্তোরাঁ বা বেকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের দোকান পরিদর্শনকালে স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা ঘুষ গ্রহণ করেন। বিএসটিআইর ফিল্ড অফিসাররা খাদ্য কারখানা পরিদর্শনে খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহে ঘুষের বিনিময়ে শৈথিল্য প্রদর্শন করেন। ত্রেভেদে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও ফিল্ড অফিসাররা ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিয়ে থাকেন, স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা বড় দোকানদার, রেস্তোরাঁ ও বেকারির মালিকের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে মাসিক ভিত্তিতে অর্থ গ্রহণ করেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের কিছু স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পরিদর্শন কার্যক্রমে নিজ উদ্যোগে সোর্স নিয়োগ করেন এবং সোর্সদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের খরচ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আদায় করেন। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীাগার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে মাঠ পর্যায়ের স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা যোগসাজশের মাধ্যমে নমুনা পরীা না করেই ঘুষ ও উপঢৌকনের বিনিময়ে সনদ দিয়ে থাকেন। ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি অধ্যাপক আ ব ম ফারুক এ প্রসঙ্গে বলেন, ভেজালের ছড়াছড়িতে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যে, আমরা এখন কিছুই নির্ভয়ে-নিশ্চিন্তে খেতে পারছি না। বাজার থেকে কিছু কিনতে গিয়েই থমকে দাঁড়াতে হয়, দ্রব্যটি নিরাপদ না বিষযুক্ত সেই চিন্তায়। কিন্তু সমস্যা হলো, বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা-আতঙ্ক থাকলেও পরিস্থিতি রোধে সমষ্টিগত কোনো উদ্যোগ নেই। তিনি বলেন, তাই মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবন রায় দেশে এখন এক নম্বর ইস্যু হওয়া দরকার নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি। এ জন্য প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে এই ইস্যুকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।

No comments:

Post a Comment