Monday, September 15, 2014

রওশনের ডাকা সংসদীয় দলের বৈঠকে যাননি এরশাদ:নয়াদিগন্ত

জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠকে এরশাদ-রওশনের মুখোমুখি হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। এরশাদ দ্বিতীয়তলায় তার নিজ অফিস কক্ষে কয়েকজন সংসদ সদস্যকে নিয়ে অবস্থান করলেও রওশনের ডাকা সংসদীয় দলের বৈঠকে যাননি। তারা দু’জন নিজ নিজ কক্ষে আলাদা বৈঠক করেছেন। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দ্বন্দ্বের অবসান হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও শেষ পর্যন্ত তা জিইয়েই থাকল বলে মনে করা হচ্ছে। গতকাল রোববার বিকেলে সংসদ ভবনের
তৃতীয়তলায় বিরোধী দলের সভাকক্ষে যখন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের সভাপতিত্বে বৈঠক চলছিল, তখন এর ঠিক নিচের ফোরেই পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দীন বাবলুসহ ১০-১২ জন এমপিকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে পাওয়া নিজ কার্যালয়ে বসে পৃথক বৈঠক করছিলেন এরশাদ। অন্য দিকে সংসদীয় দলের বৈঠকে এরশাদ-রওশনের ঐক্য চেয়েছেন উপস্থিত এমপিরা। রওশন এরশাদকে উদ্দেশ্য করে তারা অভিন্ন কণ্ঠে বলেছেন ‘দলের একটি স্বার্থান্বেষী গ্রুপ নিজেদের স্বার্থে আপনাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে রেখেছে, আপনারা দু’জন এক হয়ে কাজ করুন, দলকে ঐক্যবদ্ধ করুন, কারণ আপনাদের বিভক্তির কারণে পুরো দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ সংসদ অধিবেশনে কিছুক্ষণ অবস্থান শেষে সংসদ ভবন থেকে বের হওয়ার সময় এরশাদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি পার্টির চেয়ারম্যান। পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক ডাকতে হলে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমার অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু আমার অনুমতি নেয়া হয়নি। বৈঠকের বিষয়ে আমাকে আগে জানানোও হয়নি।’ তবে এরশাদের সাথে থাকা তার ব্যক্তিগত সহকারী নয়া দিগন্তকে জানান, এরশাদ গাড়িতে বসে দুঃখ করে বলেছেন, রাঙ্গা আমাকে সংসদ লবিতে এভাবে গালাগাল করল, আমি এখন কিভাবে ওই বৈঠকে যাই। প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা গতকাল সংসদীয় দলের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তবে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা নয়া দিগন্তকে জানান, বৈঠকের বিষয়ে দলের চেয়ারম্যানকে জানানো হয়নি। বাবলার এই তথ্য অসত্য বলে দাবি করেছেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ জানিয়েছেন, বৈঠকে যোগদানের অনুরোধ জানিয়ে শনিবার অন্তত তিনবার এরশাদকে এসএমএস করা হয়েছে, এমনকি বিরোধীদলীয় নেতার সংসদ কার্যালয় থেকে তাকে ফোনও করা হয়েছে। এরশাদ যে কেন এলেন না বুঝলাম না : রওশন সংসদীয় দলের বৈঠক শেষে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশের সময় রওশন এরশাদ নয়া দিগন্তকে বলেন, ওনাকে (এরশাদ) তো বৈঠকে আসার জন্য বলা হয়েছে। কেন যে তিনি এলেন না বুঝলাম না। এরশাদ তো এতক্ষণ তার কক্ষেই ছিলেন, এমন কথা জানালে তিনি বলেন, তাই নাকি- তাহলে বৈঠকে এলেন না কেন!। এরশাদ তো একটু আগে অধিবেশন কক্ষেও ঢুকলেন, এমন কথা বললে রওশন বলেন, ও তাই, তিনি অধিবেশনে আছেন!  সংসদীয় দলের বৈঠকে চার বিষয়ে আলোচনা : বেলা ২টায় সংসদীয় দলের বৈঠক বসার কথা থাকলেও তা শুরু হয় বিকেল প্রায় পৌনে ৪টার দিকে। ৫টার কয়েক মিনিট পর বৈঠক শেষ হয়। বৈঠক শেষে জাতীয় সংসদের মিডিয়া সেন্টারে আনুষ্ঠানিক প্রেস ব্রিফিংয়ে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, আমাদের দলে কোনো বিভক্তি বা গ্রুপিং নেই। জাপা এক ও ঐক্যবদ্ধ। তিনি জানান, বৈঠকে চারটি বিষয়ে কথা হয়েছে। প্রথমত, কাজী ফিরোজ রশীদকে বিরোধীদলীয় উপনেতা করার বিষয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে রওশন এরশাদ যে চিঠি দিয়েছেন, গতকালের বৈঠকে বলা হয়েছেÑ এ ব্যাপারে আগের সংসদীয় দলের বৈঠকের সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে। অর্থাৎ কাজী ফিরোজ রশীদকেই জাপা বিরোধীদলীয় উপনেতা নির্বাচিত করেছে। দ্বিতীয়ত, বৈঠকে বলা হয়েছেÑ দলের চেয়ারম্যান (এরশাদ) একক ক্ষমতায় প্রেসিডিয়াম থেকে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে বাদ দিয়েছেন। দলের গঠনতন্ত্র মোতাবেক চেয়ারম্যান এটি করতে পারেন। তবে তাদের দুইজনের কোনো ভুল থাকলে তা ক্ষমা করে প্রেসিডিয়াম থেকে অব্যাহতির বিষয়টি যেন প্রত্যাহার করা হয়, সেজন্য বৈঠকে সবাই একমত হয়েছেন। এ ব্যাপারে সংসদীয় দলের প্রধান রওশনকে অনুরোধ করা হয়েছে, তিনি যেন এরশাদের সাথে কথা বলে বিষয়টি মীমাংসা করেন। তৃতীয়ত, গতকালের বৈঠকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিরোধী দল বিলটিতে সমর্থন দেবে। তবে বিলটির ওপর গতকাল সংসদে উত্থাপিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদন দলীয় ফোরামে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। চতুর্থ যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা হলোÑ মন্ত্রিসভা থেকে জাপার বের হয়ে আসা না আসা প্রসঙ্গে। বৈঠকে সবাই একমত হন, পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত জাপা আপাতত মন্ত্রিসভায় থাকবে। এরশাদসহ কয়েক এমপি কেন বৈঠকে আসেননি, এই প্রশ্নের জবাবে চুন্নু বলেন, এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। প্রেস ব্রিফিংয়ে তাজুল ইসলাম চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। স্বামী-স্ত্রীর ঐক্য চান এমপিরা : সংসদীয় দলের বৈঠকে যোগ দেয়া জাপার আটজন এমপির সাথে পৃথকভাবে কথা বলে জানা গেছে, বৈঠকে উপস্থিত এমপিদের প্রায় সবাই অভিন্ন সুরে এরশাদ-রওশনের ঐক্য চেয়েছেন। বৈঠকে রওশনকে উদ্দেশ্য করে এ কে এম মাইদুল ইসলাম বলেছেন ‘ম্যাডাম, আপনারা দুইজন এক হয়ে যান। আপনাদের দুইজনের অনৈক্যের কারণে আমরা এমপিরাও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছি, কখন কার ডাকে সাড়া দেবো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। বৈঠকে প্রতিমন্ত্রী চুন্নু বলেছেন, রাঙ্গা ও তাজুল সাহেবকে প্রেসিডিয়াম থেকে এভাবে বাদ দেয়া ঠিক হয়নি। আমরা আপনাকে (রওশনকে) অনুরোধ করছি আপনি এ বিষয়ে এরশাদ সাহেবের সাথে কথা বলে এটি প্রত্যাহার করিয়ে নেবেন। না হয় আরো ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে পারে। গত বৃহস্পতিবার সংসদ লবিতে বাবলুর সাথে রাঙ্গা-তাজুলের ঝগড়ার বিষয়টি ইঙ্গিত করে বৈঠকে জাপার সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেছেন, ওইদিন যে ঘটনা ঘটল তা দলকে বিব্রত করেছে। এই ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে যেন আর না ঘটে সেজন্য আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। লিয়াকত হোসেন খোকা জানান, বৈঠকে তিনিও এরশাদ-রওশনকে এক হতে বলেছেন। ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী জানান, বৈঠকে তিনি বলেছেন, একটি স্বার্থান্বেষী গ্রুপ নিজেদের স্বার্থে দলের চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতার মধ্যে বিভক্তি জিইয়ে রেখেছে। এটাকে মিটিয়ে ফেলতে হবে। নিজ কার্যালয়ে কয়েক এমপিকে নিয়ে এরশাদের অবস্থান : জিয়াউদ্দিন বাবলু, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাসহ এরশাদ পৌনে ৫টার দিকে সংসদ ভবনে এসে নিজ কার্যালয়ে ঢুকেন। এর আগে-পরে সেখানে যান দলের এমপি মুজিবুল হক চুন্নু, সেলিম ওসমান, এম এ হান্নান, সেলিম উদ্দিন, সালমা ইসলাম, পীর ফজলুল রহমান, আব্দুল মুনিম চৌধুরী বাবু, ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নোমান ও হাজী মোহাম্মদ ইলিয়াস। তবে এরশাদের কক্ষে কিছুক্ষণ অবস্থান করে আবার উপরের ফোরে রওশনের সভাপতিত্বে চলা সংসদীয় দলের বৈঠকেও যোগ দেন প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু, সেলিম উদ্দিন ও ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী। বিকেল ৫টার কিছুক্ষণ পর সংসদ অধিবেশন শুরু হলে ঠিক ৫টা ১০ মিনিটে নিজ কক্ষ থেকে বের হয়ে সোজা অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন এরশাদ। এ সময় তার সাথে ছিলেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিয়াউদ্দিন বাবলু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও মোহাম্মদ নোমান। এ সময় কেন পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে যাননি, জানতে চাইলে নোমান বলেন, স্যার (এরশাদ) না গেলে আমরা যাই কী করে। রওশনের পাশে কয়েক মিনিট এরশাদ : এরশাদের প্রবেশের ৫ মিনিট পরেই অধিবেশন কক্ষে যান রওশন এরশাদ। পাশাপাশি আসনে বসা এরশাদ-রওশনকে এ সময় দু-একবার কথা বলতে দেখা গেছে। তবে কয়েক মিনিট পরেই এরশাদ অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন। তাকে এগিয়ে দেন জিয়াউদ্দিন বাবলু। এ সময় লবিতে সংসদীয় দলের বৈঠকে না যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এরশাদ কোনো মন্তব্য করেননি। পরে জিয়াউদ্দিন বাবলু জানান, স্যারের শরীর ভাল না। বুকে কিছুটা ব্যথা অনুভব করছেনÑ তাই বাসায় চলে যাচ্ছেন। সংসদীয় দলের বৈঠকে উপস্থিতি নিয়ে দুই রকম বক্তব্য : সংসদীয় দলের বৈঠকে কতজন উপস্থিত ছিলেন, এ নিয়ে দুই রকম বক্তব্য পাওয়া গেছে। কাজী ফিরোজ রশীদ জানান, বৈঠকে দলের ৪০ জন এমপির মধ্যে ২৩ জন উপস্থিত ছিলেন, তারা সবাই উপস্থিতির তালিকায় স্বাক্ষরও করেছেন। আর জিয়াউদ্দিন বাবলু জানান, ১৮ জন সংসদীয় দলের বৈঠকে গেছেন। এ সময় কয়েকজন এমপির নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরা কেউই সংসদীয় দলের বৈঠকে যাননি। বাবলু-রাঙ্গার আড্ডা : সংসদীয় দলের বৈঠক শেষে এবং এরশাদ চলে যাওয়ার পর অধিবেশন কক্ষে প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গার সাথে বেশ খোশ মেজাজে আড্ডা দিতে দেখা গেছে জিয়াউদ্দিন বাবলুকে। বাবলুর আসন বিরোধী দলের প্রথম সারিতে হলেও তিনি উঠে গিয়ে দ্বিতীয় সারিতে রাঙ্গার পাশের আসনে বসেন, বেশ কিছুক্ষণ তাদের হাসিমুখে কথা বলতে দেখা গেছে। এ সময় পাশে প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুও ছিলেন।

No comments:

Post a Comment