Monday, September 1, 2014

৩৬ বছরে সবচেয়ে নাজুক বিএনপি:প্রথম অালো

বিএনপি এখন তার ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, এমনটিই মনে করছেন দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। বাংলাদেশের দুই প্রধান দলের একটি বিএনপির ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রাক্কালে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে দলটির সক্রিয় এবং সাবেক নেতা-কর্মীদের কয়েকজন এবং বিশ্লেষকদের কাছে দলটির বর্তমান অবস্থার মূল্যায়ন জানতে চাওয়া হলে তাঁরা এসব কথা বলেন।  ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালী
ন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিভিন্ন রাজনৈতিক মত ও পথের অনুসারীদের এক মঞ্চে এনে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে, দলটির ৩৬ বছরের ইতিহাসে প্রায় ৩২ বছর ধরে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বর্তমান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বলছেন, জন্মের তিন যুগের মাথায় এসে দলটি বহুমতের সম্মিলন ঘটানোর সামর্থ্য তো হারিয়েছেই, উপরন্তু দলের ঐক্য বা অভ্যন্তরীণ সংহতি এখন বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে। বিশেষ করে, এক-এগারোর পর বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বে মতের অমিল, পরস্পর সন্দেহ ও দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে দলটি সাংগঠনিকভাবে চরম নাজুক অবস্থায় পড়েছে। এ অবস্থার জন্য অবশ্য এক-এগারোর সময় দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও নিপীড়নকে দায়ী করেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এক-এগারোর সময় বিএনপির ওপর অপারেশন চালিয়ে আওয়ামী লীগকে যেভাবে ক্ষমতায় বসানো হলো এবং বিএনপির নেতৃস্থানীয় নেতা-কর্মীদের এমনভাবে যন্ত্রণা দিল যে দলটি আগের মতো আর শক্তভাবে থাকতে পারল না। ৩৬ বছরের মাথায় এসে বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতার মূল্যায়ন হচ্ছে, দেশ পরিচালনায় এবং ছোট্ট এ ভূখণ্ডকে মর্যাদার আসনে নিতে জিয়াউর রহমান যতটা কার্যকরি ও দূরদর্শী ছিলেন, বিএনপি পরের দুই দফায় সে রকম কার্যকর উদ্যোগ ছিল না। তবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা ও স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম দাবি করেন, বিএনপি এখনো বহুমতের সম্মিলনের মৌলিক অবস্থান হারায়নি। কিছু কিছু নেতা ব্যক্তিস্বার্থে এর থেকে দূরে সরে গেলেও দলের তৃণমূল এখনো এ চেতনা ধারণ করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের এক পটভূমিতে ৭ নভেম্বর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। প্রথমে তিনি ১৯ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপিতে রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ৪৩ বছরে বেশিবার নির্বাচনে জিতে সবচেয়ে বেশি সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল এ দলটি। হিসাবে দেখা যায়, এখন এই দলটিই টানা প্রায় আট বছর ক্ষমতার বাইরে আছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ তৎকালীন ১৮-দলীয় জোট নির্বাচন প্রতিহতের আন্দোলনে নামে। নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে দলটির ভেতরে এখন প্রায় নির্জীব অবস্থা। বিএনপির উচ্চপর্যায় থেকে আন্দোলনে নামার নতুন নতুন দিন-তারিখ ঘোষণা করে হাঁকডাক ছাড়া হলেও কর্মসূচি দেওয়া যায়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া শত শত মামলার খড়্গ। সব মিলিয়ে নেতা-কর্মীরা ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছেন। অবশ্য এ বিষয়ে তরিকুল ইসলামের মূল্যায়ন ভিন্ন। তিনি বলেন, বিএনপি একটি সমর্থকনির্ভর দল। দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হাজার-লাখো মানুষের সমাবেশ হয়। যখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্মসূচি পালন করতে দেয় না, বা সরকারের পেটুয়া বাহিনী অত্যাচার চালায়, তখন সমর্থকেরা সরকারি সন্ত্রাস অনেক ক্ষেত্রে মোকাবিলা করতে পারেন না। বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ও দলের নীতিনির্ধারকেরা জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠার সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পটভূমি সামনে আনেন। তাঁদের মতে, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় দেশের অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে ছিল বিশৃঙ্খলা। রাজনীতিতেও একধরনের শূন্যতা বিরাজ করছিল। বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তর দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস, দুর্ভিক্ষ, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে জাতীয়তাবাদী দর্শনের ভিত্তিতে বিএনপি প্রতিষ্ঠা হয়। জিয়াউর রহমান সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি রোল মডেল দাঁড় করান। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলে দলটি প্রথমবারের মতো নেতৃত্বের সংকটে পড়ে। তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার সাময়িক সময়ের জন্য সরকার ও দলের হাল ধরলেও ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। বিচারপতি সাত্তারের ক্ষমতাচ্যুতির পর বিএনপি প্রকৃত অর্থেই অস্তিত্ব-সংকটের মুখে পড়ে। মওদুদ আহমদসহ বিএনপির অনেক নেতাই জেনারেল এরশাদের সরকারে যোগ দেন। দলের সেই সংকটকালে ১৯৮৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিএনপির হাল ধরেন খালেদা জিয়া। বিএনপির নেতারা বলছেন, জিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে খালেদা জিয়াও সমান্তরালভাবে জনপ্রিয়। তবে নেতারা স্বীকার করেন, বিএনপির কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা, দলটি সেগুলোর কিছুটা পূরণ করতে পারলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা পারা যায়নি। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপসহীন ভূমিকা দলটিকে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। এরপর ২০০১ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে দলটি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে বিএনপির গায়ে সেনা ছাউনির সমর্থননির্ভরতার যে অভিযোগ লেগেছিল, তা থেকে দলটি কিছুটা বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এ সময়ট মাঠের আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির মূল শক্তি ছিল ছাত্রদল ও যুবদল। ৩৬ বছর পর সে ছাত্রদল এখন নির্জীব। ছাত্রত্ব আছে, আবার নেতৃত্ব দেওয়ার মতো উপযুক্ত—এমন নেতাই খুঁজে পাচ্ছেন না বিএনপির চেয়ারপারসন। আর যুবদল কার্যকারিতা হারিয়ে এখন দলের অন্য সংগঠনে বিলীন হওয়ার পর্যায়ে ঠেকেছে। আবার মূল দলের ঢাকা মহানগর কমিটি নিয়ে নতুন করে অস্বস্তিতে পড়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। মির্জা আব্বাস ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের নেতৃত্বে কমিটি ঘোষণা দেওয়ার পর নেতৃত্বের পুরোনো দ্বন্দ্ব নতুন আঙ্গিকে জেগে উঠেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের একটি দর্শন ও দূরদৃষ্টি ছিল। জীবদ্দশায় তিনি দলের নীতিনির্ধারণী সভায় বলতেন, কোনো সমস্যা হলে জনগণের কাছে যেতে হবে। আমার মনে হয়, জনসম্পৃক্ততার এ জায়গাটায় বিএনপির একটা ফাঁক আছে।’ নেতৃত্বের নতুন কেন্দ্র: প্রতিষ্ঠার তিন যুগের মাথায় এসে পরিবর্তন এসেছে বিএনপির নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায়। এত দিন দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দলীয় কর্মসূচি আবর্তিত ছিল মূলত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে। তিনি প্রায় ৩২ বছর দলীয় প্রধানের পদে আছেন। হালে দলটির নেতৃত্ব দ্বি-কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়েছেন লন্ডনে বসবাসকারী দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি ১৯৯৭ সালে বগুড়া জেলা বিএনপির সদস্যপদ নিয়ে রাজনীতিতে যুক্ত হন। মাঝে ছিলেন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব, এখন তিনি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। দলে তরুণ নেতাদের একটি বড় অংশ তারেক রহমানকে ঘিরে সক্রিয়। এ অবস্থায় বিগত আমলে ‘হাওয়া ভবনের’ কথা মনে করে দলের প্রবীণ ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের কেউ কেউ অস্বস্তিতে আছেন, আবার অনেকে দুর্ভাবনায় পড়েছেন। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীন দল যখন গণতন্ত্রের চর্চা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকে, তখন অন্য দলগুলোর মতো এই দুষ্টচক্র থেকে বিএনপিও বের হতে পারছে না। এটা একটা বাস্তবতা। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ, দলের কমিটি গঠন, দল থেকে কাউকে বহিষ্কার বা তিরস্কার করা—সব সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত করেন খালেদা জিয়া। তিন বছর অন্তত দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল, ছয় মাস অন্তর নির্বাহী কমিটির সভা হওয়ার কথা। কিন্তু ২০০৯ সালের পর কাউন্সিল হয়নি, নির্বাহী কমিটির সর্বশেষ সভা হয়েছে ২০১২ সালের জুলাই মাসে। ২০১১ সালের ১৬ মার্চ বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সম্মেলন না হওয়ায় এ পদে পরিবর্তনও আসছে না, আবার মির্জা ফখরুল ইসলামও ভারমুক্ত হতে পারছেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সদস্য বলেন, দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কিছু ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের চর্চা আছে, অনেক ক্ষেত্রে নেই। আবার মাঠপর্যায়ে কেন্দ্র থেকে বেশি আছে। তাঁরা মনে করেন, দলের গণতন্ত্র চর্চার জন্য সব পর্যায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করা দরকার। অবশ্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে দলের এক অনুষ্ঠানে বলেন, প্রতিষ্ঠার ৩৬ বছরে বিএনপির ওপর একের পর আঘাত এসেছে। এক-এগারোর সময় বিএনপিকে ভাঙার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো ঘুরে দাঁড়িয়েছে। খালেদা জিয়ার দৃঢ়তা আর তারেক রহমানের অনুপ্রেরণায় বিএনপি সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে বলে তিনি দাবি করেন।

No comments:

Post a Comment