পাকিস্তানে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের (কোর কমান্ডার) নিয়ে গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাতটা থেকে টানা প্রায় চার ঘণ্টা জরুরি বৈঠকের পর সেনাবাহিনীর প্রধান রাহিল শরিফ এ কথা বলেন। ‘গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন’ পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, বর্তমান অচলাবস্থার মূলে রয়েছে সরকারের সঙ্গে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ও পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিকের (পিএটি)
বিরোধ। আর এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য চাই রাজনৈতিক সমঝোতা। খবর ডন, এএফপি ও জিয়ো টিভির। সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত দীর্ঘ বৈঠকের পর পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনসের (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের সংকটকালে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা হোক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আর তা চান না। এ সময় তাঁরা রাজধানীতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, সেনাবাহিনী কেবল রাষ্ট্রের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের অংশ হিসেবে কাজ করবে, কোনো উচ্চাভিলাষ মেটাতে নয়। বৈঠকটি আজ সোমবার সকালে হওয়ার কথা থাকলেও তা এগিয়ে আনা হয়। সেনাপ্রধানের এই তোড়জোড়ে দীর্ঘদিন সামরিক শাসনে থাকা দেশটিতে উত্তেজনা বেড়ে যায়। এদিকে রাজধানী ইসলামাবাদে পার্লামেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের আশপাশে গত শনিবার রাত থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষ গতকালও অব্যাহত ছিল। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের দিনভর দফায় দফায় সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও পাঁচ শতাধিক মানুষ আহত হয়। এর পরও পিছু হটেনি বিক্ষোভকারীরা। সংঘর্ষের মধ্যেই তারা পার্লামেন্ট ভবনের চত্বরে তাঁবু ফেলে অবস্থান নেয়। সংকট নিরসনে বিরোধীদের সঙ্গে সমঝোতায় সরকারের পক্ষ থেকে গতকাল দৃশ্যত কোনো উদ্যোগ ছিল না। সকালে শুধু তথ্যমন্ত্রী পারভেজ রশিদ জানান, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আলোচনার দরজা এখনো খোলা আছে। পরে বিকেলে মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ সদস্য ও শীর্ষ সহযোগীদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ আগামীকাল মঙ্গলবার পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশন আহ্বান করেন। এ অবস্থায় গতকাল সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন সেনাপ্রধান রাহিল শরিফ। গত বছরই নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ শরিফ। পাকিস্তানের ইতিহাসে সেবারই প্রথম একটি নির্বাচিত সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা নেয় নির্বাচিত আরেকটি সরকার। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের দাবিতে গত জুনে ইসলামাবাদ অভিমুখে ‘আজাদি মার্চের’ ঘোষণা দেন পিটিআই চেয়ারম্যান সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খান। ১৪ আগস্ট ওই মার্চ শুরুর চার দিন আগে একই দাবিতে একই দিনে ‘ইনকিলাব মার্চ’ ঘোষণা দেন ধর্মীয় নেতা ও পিএটির নেতা তাহির-উল-কাদরি। ঘোষণা অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে দুই দলের কর্মসূচি শুরু হয়। ১৮ আগস্ট তারা ইসলামাবাদের রেড জোনে ঢুকে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে। তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-বিক্ষোভ ও সরকারের সঙ্গে আলোচনা পাশাপাশি চলছিল। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার সংকট নিরসনে সমঝোতার প্রচেষ্টায় সেনাবাহিনী জড়িয়ে পড়লে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ওই দিন পিটিআই অভিযোগ করে, পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে সরকার সেনাবাহিনী ডেকে আনছে। সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ওই অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়, পিটিআই ও পিএটির দাবিতেই সেনাবাহিনীকে এই প্রচেষ্টায় যুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে দুই পক্ষ যখন বাদানুবাদে লিপ্ত, তখন সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়ে দেয়, সরকারের আহ্বানেই তারা এই প্রচেষ্টায় যুক্ত হয়েছে। এসব নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই শনিবার রাত নয়টার দিকে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বাসভবনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য নেত-কর্মী-সমর্থকদের নির্দেশ দেন ইমরান ও কাদরি। এরপর শুরু হয়ে যায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ। রাত শেষে গতকাল দিনভরও তা অব্যাহত ছিল। পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোশাররফ জায়দি মনে করছেন, সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান কঠিন হয়ে উঠেছে। সরকারবিরোধীরা এখন সেনাবাহিনীর আরও সরাসরি সম্পৃক্ততা চাইবে। জায়েদি বলেন, ‘তাদের একমাত্র লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করা। সম্ভবত তারা সেনাবাহিনীকেও হস্তক্ষেপে বাধ্য করবে।’ সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ নিয়ে জায়েদির এই ধারণাকে সমর্থন করে পিটিআইয়ের প্রেসিডেন্ট জাভেদ হাশমির বক্তব্য। গতকাল তিনি বলেছেন, ‘শনিবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কোনো একজনের কাছ থেকে বার্তা পাওয়ার পর ইমরান খান নেতা-কর্মীদের অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন।’ শনিবার রাত নয়টার দিকে ইমরান-কাদরির নির্দেশের পর কনস্টিটিউশন অ্যাভিনিউ থেকে প্রধানমন্ত্রীর বাভসভন ও পার্লামেন্ট ভবনের দিকে অগ্রসর হন পিটিআই ও পিএটির প্রায় ৩০ হাজার কর্মী-সমর্থক। বুলেটপ্রুফ গাড়িতে করে কাদরি এবং একটি শিপিং কনটেইনারের মধ্যে করে ইমরান তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। প্রথমে পুলিশ তাঁদের বাধা না দিলেও গুলি, রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। মাঝরাতে বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট কমপ্লেক্সে ঢুকে পড়েন এবং শেষ রাতে পৌঁছে যান প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কাছে। পরে সেখান থেকে পার্লামেন্ট ভবনের কাছে ফিরে আসেন। এরপর গতকাল দিনভরও চলে দফায় দফায় সংঘর্ষ। আহত হন ১১৮ জন নারী, ১০ শিশুসহ ৪৮১ জন। আহতদের মধ্যে পুলিশের ৯২ জন সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে একটু পর পর ভাষণ দিয়ে কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত রাখেন ইমরান ও কাদরি। পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান ইমরান বলেন, ‘সব পাকিস্তানির প্রতি আমার আহ্বান, এই সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এটা সাংবিধানিক সরকার না, এরা হত্যাকারী। শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত আমরা এই আন্দোলন চালিয়ে যাব।’ আর পিএটির নেতা কাদরি বলেন, ‘সন্ত্রাসী ও হত্যার অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।’ বিক্ষোভকারীরা ইসলামাবাদে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন অবরুদ্ধ করে ফেলতে পারেন—এই আশঙ্কায় গত শুক্রবারই রাজধানী ছেড়ে নিজের এলাকা পাঞ্জাবে চলে যান নওয়াজ। গতকাল সকালে সেখানে তাঁকে আগের রাতের পরিস্থিতি অবহিত করেন কর্মকর্তারা। দুপুরে তিনি ইসলামাবাদে ফেরেন। পরে বেলা তিনটার দিকে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নাসির ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফসহ জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও শীর্ষ সহযোগীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। ইমরান ও কাদরির অভিযোগ, গত বছর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও জালিয়াতি হয়েছে। এ জন্য তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও নতুন করে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন।
No comments:
Post a Comment