১৯৯২ সালে জাপানের শিল্প খাতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা ছিল এক কোটি ৬০ লাখ। প্রায় দুই দশক পরে ওই খাতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা এক কোটির নিচে নেমে যায়। কারখানায় কর্মরত মানুষের সংখ্যা এত কমে যাওয়ার ঘটনা পূর্ববর্তী ৫১ বছরের মধ্যে ঘটেনি। শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং ২০১১ সালে সুনামির আঘাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশটির কারখানাগুলো সংকটে পড়ে। এ সংকট এখনো অব্যাহত আছে। শুধু নিজ দেশেই নয়, জাপানি কম্পা
নিগুলো বিপাকে আছে চীনেও। সে দেশে শ্রমের মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। পাশাপাশি জাপান ও চীনের পুরনো বৈরিতা নতুন করে দেখা দিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাপান চাইছে নিজ ভূখণ্ড ও চীন থেকে কারখানাগুলো সরিয়ে অন্য কোনো দেশে নিয়ে যেতে। এতে বাংলাদেশের জন্য বড় একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। জাপান বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে চায়। সম্প্রতি জাপানি কম্পানিগুলোর ওপর পরিচালিত এক জরিপের প্রতিবেদনে তাদের আগ্রহ স্পষ্ট হয়েছে। এ দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বাধাও চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদন বাংলাদেশ সরকারের কাছে জমা দিয়েছে জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো)। জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বাংলাদেশ সফরে এসে সেসব বাধা দূর করার তাগিদ দিয়েছেন। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মনে হয়েছে, জাপান সত্যিই বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ বাড়াতে চায়। জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (জেবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আখতারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, চীনে শ্রমিকের বেতন বেড়ে গেছে। এ কারণে জাপানি কম্পানিগুলো নতুন দেশ খুঁজছে। তাদের গন্তব্য হওয়ার বড় সুযোগ আছে বাংলাদেশের। তিনি জানান, ২০০৭ ও ২০০৮ সালেও জাপানিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে ব্যাপক খোঁজখবর নিয়েছিল। কিন্তু বিদ্যুতের দুরবস্থা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও তীব্র যানজটের কারণে তাদের আগ্রহে ভাটা পড়ে। কিন্তু এবার তারা ওই সব সমস্যার সমাধানে অগ্রগতি দেখতে পেয়েছে, বিশেষ করে বিদ্যুতে। ফলে তাদের আগ্রহ বেড়েছে। অবশ্য বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জাপানি বিনিয়োগ পরিস্থিতি খুব সুখকর নয়। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৪-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত মোট চার বছরে বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ মাত্র ১৪ কোটি ৬২ লাখ ডলারের। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের সাময়িক হিসেবে ৮২ লাখ ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে। অবশ্য জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রথমবারের মতো ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জাপান থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ১২৯ কোটি ডলারের পণ্য। আর ওই দেশে রপ্তানি হয়েছে ৮৬ কোটি ডলারের পণ্য। শ্রমঘন কারখানার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা সব সময় তুলনামূলক সস্তা শ্রম খোঁজে। এ জন্য শিল্প-কারখানা একেক সময়ে একেক অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়েছে। অর্থনীতিবিদ স্যার আর্থার লুইসের মতে, যেসব দেশে প্রচুর কর্মক্ষম বেকার মানুষ আছে সেসব দেশে মজুরি-স্ফীতি ছাড়াই শিল্পবিকাশ ঘটতে পারে। বাংলাদেশ এখন ওই রকম অবস্থায়ই আছে। জাপান-বাংলাদেশ চেম্বারের সদস্য ও জাপান থেকে রি-কন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডন বলেন, জাপানে শ্রমের মূল্য অনেক বেশি। একজন শ্রমিককে মাসে তিন হাজার ডলার দিতে হয়। এত খরচের কারণে জাপানি কম্পানিগুলো বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে পারছে না। ইতিমধ্যে তারা কোরিয়ার কাছে ইলেকট্রনিকস্ পণ্যের বাজার হারিয়েছে। এ জন্যই জাপান ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ নীতি নিয়েছে। চীনে বহাল রাখার পাশাপাশি আরেকটি দেশে তারা কারখানা বসাবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুযোগ রয়েছে, জাপানি বিনিয়োগের কাঙ্ক্ষিত দেশ হওয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নত দেশগুলো সস্তা শ্রমের খোঁজে তাদের কারখানা এশিয়ায় সরিয়ে আনে। একে বলা হয় ‘শিল্প অভিবাসন’। শিল্প অভিবাসনের সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে গত শতাব্দীর সাতের দশকে। তখন জাপান থেকে সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান ও কোরিয়ায় শ্রমঘন কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। দ্বিতীয় অভিবাসনের ঘটনা ঘটে নয়ের দশকে। তখন চীনে আস্তানা গাড়ে বড় বড় কম্পানিগুলো। এখন চীনও তার শ্রমঘন-সমক্ষতা হারাচ্ছে। তারা উচ্চ প্রযুক্তির কারখানার দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে কারখানা সরাতে জাপানিদের তৎপরতা চলছে আগে থেকেই। চলতি বছরের শুরুতে জাপানের রাষ্ট্রদূত শিরো সাদোশিমা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশে তাঁদের বিনিয়োগের আগ্রহের কথা জানান। গত মার্চে জেট্রো ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) যৌথভাবে একটি সেমিনারের আয়োজন করে। তাতে জাপানের কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের আগ্রহের কথা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে জেট্রোর করা একটি জরিপের ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়, তাতে দেখা যায় বাংলাদেশে কাজ করছে এমন ৮০ শতাংশ কম্পানিই আগামী দুই বছরে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চায়। আস্থার বিচারে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। জাপানিদের আস্থা-সূচকে বাংলাদেশের অর্জন প্রায় ৬২; ভারতের ৫৭। গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরকালে সে দেশের ব্যবসায়ীরা তাঁর কাছে বিনিয়োগের আগ্রহের কথা জানান। গত শনিবার বাংলাদেশ সফরকালেও তাঁরা একই কথা বলেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেও জাপানি বিনিয়োগ বাড়াতে বিরাজমান সমস্যা দূর করার দাবি জানান। এর আগে জেট্রোর পক্ষ থেকে জাপানি বিনিয়োগের ১৩টি বাধা উল্লেখ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি সংস্থাকে চিঠি দেওয়া হয়। গত শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ‘জাপান-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর আগ্রহের কথা খোলাখুলিভাবেই বলেন। অনুষ্ঠানে জাপানের সুমিতমো করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কুনিহারো নাকামোরা, কুমে সেক্কেই কম্পানির প্রেসিডেন্ট ও সিইও ইয়োকিও ইয়ামাদা, মায়েকাওয়া এমএফজির এমডি ইচিজি ইশুজো, শিপ হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ও সিইও কুনিহিসা ফুরুকাওয়া, মারোহিসা কম্পানির প্রেসিডেন্ট কিমিনবো হিরাইশি, বোনম্যাক্স কম্পানির প্রেসিডেন্ট ও সিইও ইয়োচি তগাওয়া, নিপ্পন পলি-গ্লুর চেয়ারম্যান ও সিইও কানেতোশি ওদা এবং ইয়োগ্লেনা কম্পানির প্রেসিডেন্ট মিৎশুরো ইজোমো বক্তব্য দেন। তাঁদের বক্তব্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ পায়। হাবিবুল্লাহ ডন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাপান সফরে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, জাপানি কম্পানিগুলো বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ বাড়াতে চায়। এ জন্য আমাদের তরফ থেকে তাদের অবকাঠামো সুবিধা দেওয়া দরকার।’ আখতারুজ্জামান মনে করেন, জাপানিরা বিনিয়োগের সঙ্গে যে প্রযুক্তি নিয়ে আসবে তা বাংলাদেশের অনেক উপকারে লাগবে। কয়েকটি দেশ জাপানিদের নিয়ে যাওয়া প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন বিশ্ববাজারে রাজত্ব করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
No comments:
Post a Comment