খেলাপি হওয়া ঋণগ্রহীতাদের রিট পিটিশন দায়েরের হিড়িক চলছে হাইকোর্টে। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ পেয়ে নতুন করে ঋণ নিয়ে আবারও খেলাপি হচ্ছেন ওই গ্রাহকরাই। এভাবে সরকারি মালিকানাধীন ১৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপিরা উচ্চ আদালতে দুই হাজার ৫১২টি রিট করে রেখেছেন। তাঁদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার ১৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এসব রিট নিষ্পত্তি না হওয়ায় ব্যাংকগুলো যেমন টাকা আদায় করতে পারছে না, তেমনি উচ্চ আদাল
তের স্থগিতাদেশের ফলে খেলাপি গ্রাহকরাও পেয়ে যাচ্ছেন নতুন ঋণ। ব্যাংকিং খাতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রিট করে মামলা ঝুলিয়ে রেখে অর্থ পরিশোধ থেকে দীর্ঘমেয়াদে রেহাই পাওয়ার পাশাপাশি নতুন করে ঋণ নেওয়ার এ কৌশল অবলম্বন করছে নামিদামি ব্যবসায়ী গ্রুপ থেকে শুরু করে জালিয়াতচক্র পর্যন্ত। সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণ ও রপ্তানিতে সুনাম কুড়ানো একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও রিট করে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করার ওপর স্থগিতাদেশ পেয়ে নতুন করে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়েছে অন্য ব্যাংক থেকে। আবার আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ভুয়া কাগজপত্রে গ্রুপটির বিভিন্ন কম্পানির নামে বিতরণ করা টাকা উদ্ধারে গত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে সোনালী ব্যাংক যখন কম্পানিগুলো নিলামে তোলার উদ্যোগ নেয়, তখনই দেশসেরা এক আইনজীবীর সহায়তায় হাইকোর্টে রিট পিটিশন করে নিলামের ওপর নিষেধাজ্ঞা পেয়ে যায় গ্রুপটি। ফলে তিন বছর আগে উদ্ঘাটিত জালিয়াতির টাকা ফেরত পেতে ব্যর্থ হচ্ছে সোনালী ব্যাংক। এ অবস্থায় এসব রিট দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে আলাদা একটি বেঞ্চ গঠনের অনুরোধ জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে চিঠি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য মতে, ২০০১ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সময়ে হাইকোর্টে অনিষ্পন্ন রিটের মধ্যে অর্থঋণসংক্রান্ত রিট পিটিশনের সংখ্যা এক হাজার ৫১৭টি। এসব রিটে জড়িত অর্থের পরিমাণ আট হাজার ৫৬৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) সংক্রান্ত রিট ৫২১টি, জড়িত অর্থের পরিমাণ ২০ হাজার ৪৬৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা। অন্যান্য রিটের সংখ্যা ৪৭৪টি, জড়িত অর্থের পরিমাণ ৯৮০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অর্থমন্ত্রী জানান, এসব মামলার নিষ্পত্তি দ্রুত হলে আর্থিক খাতে ঋণ-শৃঙ্খলা জোরদার হবে। খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি কমবে। শক্তিশালী ও স্থিতিশীল হবে আর্থিক খাত। এর মধ্য দিয়ে বিনিয়োগে উৎপাদনবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেন, অল্প টাকা নিয়ে যাঁরা খেলাপি হয়ে পড়ছেন, তাঁরা নানাভাবে ব্যাংকের দায় পরিশোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু গুটিকয়েক বড় ঋণগ্রহীতা খেলাপি হওয়ার পর ছুটে যান উচ্চ আদালতে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলা করার আগেই এসব ঋণগ্রহীতা উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসেন। অনেক ক্ষেত্রেই ওই সব রিট বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। ফলে রিটের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর পুঞ্জীভূত খেলাপি অর্থের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। মাত্র ২০ শীর্ষ খেলাপির রিটেই সোনালী ব্যাংকের হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ আটকে আছে। আইনমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ১৫টি রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যরত আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসব রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিট পিটিশনগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পৃথক বেঞ্চ গঠন ও মামলাগুলোর এনালোগাস হেয়ারিং-এর কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে এ চিঠিখানা লিখছি।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ খেলাপি ঋণগ্রহীতার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। খেলাপি ঋণগ্রহীতারা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ না করে বিভিন্ন যুক্তিতে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায়ের করছেন। ফলে বিতরণকৃত ঋণের অর্থ যথাসময়ে আদায় হচ্ছে না। এতে উৎপাদনশীল খাতে ঋণপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি এসব খেলাপি গ্রাহকের স্ট্যাটাস (খেলাপি হিসেবে চিহ্নিতকরণ) যেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি তথ্যভাণ্ডারে অন্তর্ভুক্ত হতে না পারে, তার জন্য মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায়ের করে তাঁরা স্থগিতাদেশ লাভ করছেন। ফলে তাঁরা খেলাপি অবস্থাতেও অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে সক্ষম হচ্ছেন।’ গত ১৯ আগস্ট আইনমন্ত্রীকে পাঠানো চিঠিতে অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমার জানা মতে, মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগে অর্থঋণসংক্রান্ত ও অন্যান্য রিট পিটিশনের শুনানির জন্য একত্রে একাধিক বেঞ্চ থাকলেও শুধুমাত্র অর্থঋণসংক্রান্ত রিট পিটিশন শুনানির জন্য একক কোনো বেঞ্চ নেই। তাই রাষ্ট্র মালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থঋণসংক্রান্ত ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রিট পিটিশন দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য এককভাবে একটি বেঞ্চ গঠনসহ এনালোগাস হেয়ারিং বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ কাঙ্ক্ষিত সুফল বয়ে আনবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।’ ঋণসংক্রান্ত এসব রিট নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে আলাদা কোনো বেঞ্চ গঠনের উদ্যোগ আছে কি না- জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর চিঠিটি আমার কাছে এসে পৌঁছেনি। চিঠিটি পাওয়ার পর অবশ্যই এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০০৩ সালে নতুন করে অর্থঋণ আদালত আইন প্রণয়নের পর নিম্ন আদালত থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলোর পক্ষে দেওয়া সেসব রায় মুহূর্তেই আটকে যাচ্ছে উচ্চ আদালতে। মূলত ঋণখেলাপি ব্যক্তিরা উচ্চ আদালতে একাধিক নামি-দামি আইনজীবী নিয়োগ দেন। তুলনায় ব্যাংকগুলোর প্যানেলভুক্ত আইনজীবীরা বেশ দুর্বল। ব্যাংকাররা জানান, অর্থঋণ আদালত আইনের ১২ ধারায় মামলা রুজুর প্রাথমিক শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রথম ঋণখেলাপি সাব্যস্ত করে বিবাদীর বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশ দেবেন। বিবাদী এতে সাড়া না দিলে সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতার সম্পত্তি নিলামে বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দেবে ব্যাংক। বিবাদী এতেও সাড়া না দিলে তখন অর্থঋণ আদালতে মামলা করা যাবে। মামলা রুজুর এক মাসের মধ্যে বিবাদী আদালতে হাজির না হলে আদালত বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রির সমন জারি করবে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলো প্রথম শর্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে যখনই কোনো ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি সাব্যস্ত করে লিগ্যাল নোটিশ দেয়, তখনই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ব্যাংক ও অর্থঋণ আদালতের পদক্ষেপের ওপর উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশ চেয়ে রিট করে দেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমনটি হচ্ছে। ফলে রিট ও এর বিপরীতে পাওনা অর্থের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
No comments:
Post a Comment