Thursday, September 18, 2014

মাওলানা সাঈদীর আজীবন কারাদণ্ড:নয়াদিগন্ত

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনটি পৃথক অভিযোগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং অপর  দুটি অভিযোগের একটিতে ১২ বছর ও একটিতে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাকাণ্ডে ১২ বছর জেল এবং বিশাবালী হত্যার অভিযোগসহ তিনটি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড  দেয়া হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ চূড়ান্ত এ রায় ঘোষণা করে গ
তকাল।  রায়ে আসামি এবং রাষ্ট্র উভয়পক্ষের আবেদন আংশিকভাবে মঞ্জুর করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে মোট আটটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। অপর ছয়টি অভিযোগে কোনো সাজা  উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল। আসামিপক্ষ মাওলানা সাঈদীর বেকসুর খালাস দান এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছয়টি অভিযোগে সাজা উল্লেখের দাবি জানিয়ে আপিল আবেদন করেছিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে আসামিপক্ষের আবেদন আংশিক গ্রহণ করে দণ্ড ঘোষিত দুটি অভিযোগের একটিতে  মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আমত্যৃ এবং আরেকটিতে ১২ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। অপর দিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা উল্লেখ করা হয়নি এমন ছয়টি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনও আংশিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। অপর তিনটি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয়েছে। মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২০টি অভিযোগ এনেছিল। আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগ ছিল  ৮ নম্বর অভিযোগ।  এ অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগে ১২ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। অপর দিকে বিশাবালী হত্যার অভিযোগটি ছিল ১০ নম্বর অভিযোগ। এ অভিযোগেও ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। গতকাল রায়ে এ অভিযোগে তাকে আমৃত্য কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন গ্রহণ করে যে তিনটি অভিযোগে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হলো ৭, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগ। ১৬ নম্বর অভিযোগ হলো  গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোন মহামায়া, আনু ও কমলাকে অপহরণ করে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়ার অভিযোগ। এ অভিযোগে  আপিল বিভাগের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ১৯ নম্বর অভিযোগ হলো  মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরকরণ। এ অভিযোগেও মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু জেল দেয়া হয়েছে। ৭ নম্বর অভিযোগ ছিল শহিদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে আগুন দেয়া। এ অভিযোগে তাকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ৭, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে ট্রাইবু্যুনাল মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও কোনো সাজা উল্লেখ করেনি।  আপিল বিভাগের রায়ে  এ তিন অভিযোগের বিপরীতে সাজা  উল্লেখ করা হলো। আরো তিনটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও  সে তিনটি অভিযোগে গতকালের চূড়ান্ত রায়ে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে।  এ অভিযোগ তিনটি হলো  (৬) পাড়েরহাট বাজারে দোকানপাটে  লুটপাটে নেতৃত্ব প্রদান ও অংশ নেয়া, (১১) মাহবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে লুট ও তার ভাইকে নির্যাতন  এবং (১৪)  ১৯৭১ সালে  হোগলাবুনিয়া এলাকায় হিন্দুপাড়ায় আক্রমণ ও শেফালী ঘরামী নামে এক মহিলাকে রাজাকার কর্তৃক  ধর্ষণে সহায়তা ও সেখানে উপস্থিত থাকা। প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের  আপিল বেঞ্চ গতকাল সকালে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে। সকাল ১০টা ৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বেঞ্চের সকল বিচারপতি আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন। ১০টা ৭ মিনিটের সময় সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা শুরু হয় এবং ৩ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায় রায় ঘোষণা। এ সময় আদালত কক্ষে বিপুল সংখ্যক আইনজীবী ও সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। গত ১৬ এপ্রিল আপিল বিভাগে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার  সমস্ত কার্যক্রম শেষে  রায় অপেক্ষমাণ ঘোষণা করা হয়। তার পাঁচ মাস পর গতকাল চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে  মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানি শুরু হয়। সাড়ে ছয় মাসেরও অধিক সময় পর আলোচিত এ আপিল শুনানি শেষে রায় অপেক্ষমাণ ঘোষণা করা হয়। মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে  পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় তখন। বেঞ্চের  অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। ইব্রাহিম কুট্টি ও বিশাবালী হত্যার অভিযোগ : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগ বিষয়ে বলা হয়,  ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা সাঈদীর  নেতৃত্বে  পাকিস্তান আর্মি ও শান্তি কমিটির লোকজন চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এর পর মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ইব্রাহিম কুট্টি ও মফিজুল নামে দু’জনকে  ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পাড়েরহাট বাজারে।  তারা ওই বাড়িতে কাজ করতেন। পাড়েরহাট বাজারে নেয়ার পর  মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে। ১০ নম্বর অভিযোগ বিষয়ে চার্জ ফ্রেমিং অর্ডারে উল্লেখ করা হয়ে,ে   ১৯৭১ সালের ৬ জুন  সকাল ১০টার দিকে উমেদপুর গ্রামে সাঈদীর নেতৃত্বে ২৫টি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। এ সময় সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালী নামে একজনকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়। আপিল শুনানির সময় আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা বিষয়ে আসামিপক্ষ তাদের উপস্থাপিত যুক্তিতে জানায়,  ইব্রাহিম কুট্টি ১৯৭১ সালের ৮ মে তার শ্বশুরবাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছেন। অথচ এ বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে ১৩ জনকে আসামি করে যে মামলা করেছিলেন তাতে মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। মমতাজ বেগম এখনো জীবিত আছেন। মামলার কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ : ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। তার এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের  ৬ ডিসেম্বর  মামলার সমস্ত  কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমাণ ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ১১ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করার পর মাওলানা সাঈদীসহ ট্রাইব্যুনালে সকল মামলার পুনরায় বিচার দাবি করে দরখাস্ত করা হয় আসামিপক্ষ থেকে। সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তবে মাওলানা সাঈদীর মামলায় পুনরায় যুক্তি  উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারি পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ২৯ জানুয়ারি  উভয়পক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে  সে দিন পুনরায় রায়ের তারিখ অপেক্ষমাণ ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের তারিখ অপেক্ষমাণ ঘোষণার এক মাসের মাথায় নির্দিষ্ট করে রায় দেয়ার তারিখ ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত  মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চ মাসে  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়।  ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে স্কাইপ কেলেঙ্কারির কারণে  পিছিয়ে যায় এ মামলার রায় ঘোষণা। মানিক পসারী নামে এক ব্যক্তি পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে  ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট  মাওলানা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এর পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আরেকটি নালিশ দায়ের করেন পিরোজপুর নালিশি আদালতে। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে  মামলার বাদি মাহবুবুল আলম হাওলাদার  ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবি করেন।  এভাবে মাওলানা সাঈদীর বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে এবং  বিচারকার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন। মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মাওলানা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখ পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী দেশের দণিাঞ্চলে সুপরিচিত ইসলামি চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন। বাবার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিাপ্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিা লাভ করার পর মাওলানা সাঈদী ১৯৬২ সালে মাদরাসা শিক্ষা শেষ করে গবেষণা কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৬৭ থেকে মাওলানা  সাঈদী বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এবং বিশ্বের বহু দেশে  মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসির করেছেন।  তার ওয়াজ শুনে  অসংখ্য  হিন্দু  এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কুরআন হাদিস ও ইসলামের ওপর তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য পুস্তক। পেয়েছেন নানা উপাধি, খ্যাতি ও  সম্মান। তার তাফসিরের অডিও ভিডিও পাওয়া যায় দেশ-বিদেশে সর্বত্র।  দেশে-বিদেশে তৈরি হয়েছে তার অগণিত ভক্ত-অনুরাগী। বিশ্বের বহু দেশ থেকে নামকরা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের  আমন্ত্রণে তিনি সেসব দেশ সফর করেছেন এবং  কুরআনের  তাফসির করেছেন।

No comments:

Post a Comment