Thursday, September 18, 2014

বহুল আলোচিত একটি মামলা:নয়াদিগন্ত

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে আলোচিত মামলা হিসেবে স্থান পেয়েছে ১৯৭১ সালের  যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকার্যক্রম। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলা হয়েছে তার মধ্যে নানা কারণে অন্যতম আলোচিত এবং ঘটনাবহুল মামলায় পরিণত হয় মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা। ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীকে অপহরণ করা, স্কা
ইপ কেলেঙ্কারি, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী গণেশ চন্দ্র পক্ষ ত্যাগ করে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়াসহ নানা কারণে বিশ্বজুড়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে এ মামলা। মামলার আসামি যেমন এ মামলায় মানুষের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু তেমনি এ মামলার বিভিন্ন অভিযোগ এবং মামলাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত একের পর এক ঘটনাপ্রবাহের  কারণেও এ মামলার খবরাখবর পাঠকের কাছে ছিল গভীর আগ্রহের বিষয়। ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগ, ‘সাঈদী’ এবং ‘দেলু  শিকদার’ এসব বিষয়ও ছিল এ মামলার আলোচিত বিষয়। মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ১৯৭১ সালের ৮ মে তার নেতৃত্বে  পাকিস্তান আর্মি, রাজাকার এবং শান্তি কমিটির লোকজন পিরোজপুরের পাড়েরহাট বাজারের নিকটস্থ চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এরপর সেখান থেকে ইব্রাহিম কুট্টি এবং মফিজউদ্দিন পসারীকে ধরে পাড়েরহাট বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা ওই বাড়িতে কাজ করত। পাড়েরহাট নেয়ার পর মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে ।  বিচার চলাকালে আসামিপক্ষ আদালতে জানান, ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই পিরোজপুরে একটি মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় তিনি পাকিস্তান আর্মিসহ মোট ১৪ জনকে আসামি করেছিলেন। আসামির তালিকায়  আল্লামা সাঈদীর নাম নেই। ওই মামলার বিবরণে আরো বলা হয়, ইব্রাহিম কুট্টিকে  ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর তার শ্বশুরবাড়ি নলবুনিয়ায় হত্যা করা হয়। আসামিপক্ষ অভিযোগ করে মমতাজ বেগম এখনো জীবিত কিন্তু তাকে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হিসেবে হাজির করেনি। মাওলানা সাঈদী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মোফাসসিরে কুরআন এবং সুললিত কণ্ঠস্বরের অধিকারী  হওয়ায় দেশে এবং বিদেশে অগণিত মানুষের নিয়মিত মনোযোগের বিষয়ে পরিণত হয়  এ মামলার কার্যক্রম । মাওলানা সাঈদীর বিচারে যখন সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় তখন এ বিষয়ক খবরের জন্য পাঠকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। জেরায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীর মুখ থেকে আইনজীবী মিজানুল ইসলাম কী বের করে আনেন তা জানার জন্য পরের দিনের পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করেছেন অগণিত পাঠক। পিরোজপুরের বর্তমান এমপি এ কে এম এ আউয়াল মাওলানা সাঈদীর বিপক্ষে সাক্ষ্য দেন। মাওলানা সাঈদীর পক্ষেও সাক্ষ্য দিয়েছেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তা ছাড়া জেরায়  রাষ্ট্রপক্ষের বেশ কয়েকজন সাক্ষীর বিরুদ্ধে চুরি, জেল খাটাসহ আরো নানাবিধ তথ্য বের হয়ে আসে, যা ছিল  পাঠকের কাছে বেশ  আকর্ষণীয়।  ট্রাইব্যুনাল থেকে এ মামলার রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশে দেড়শতাধিক মানুষ জীবন দেন। সারা দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে লাখ লাখ মানুষ প্রতিবাদে নেমে আসেন রাজপথে। বিচার চলাকালে  এবং বন্দী থাকা অবস্থায় মাওলানা সাঈদী প্রথমে তার মাকে হারান। এরপর  ২০১২ সালের  জুন মাসে বিচার চলাকালে  ট্রাইব্যুনালে বসে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তার বড় ছেলে রাফিক বিন সাঈদী। মামলা চলাকালে ২০১২ সালের  ৫ নভেম্বর মাওলানা সাঈদীর পক্ষে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন সুখরঞ্জন বালী। সে দিন তাকে ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। বালী অপহরণের ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সাড়া ফেলে। কারণ সুখরঞ্জন বালী ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। তিনি পক্ষ ত্যাগ করে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। আরো একটি কারণে বালী অপহরণ ঘটনা মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে সেটি হলো তিনি ছিলেন বিশাবালীর আপন ভাই। মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ছিল, তার নির্দেশে বিশাবালীকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়। সেই বিশাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালী এসেছিলেন মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে। এর পর ২০১৩ সালের ১৬ মে ঢাকার দৈনিক নিউএজ পত্রিকায়  প্রকাশিত ডেভিড বার্গম্যানের  অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে  বলা হয়, সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান  পাওয়া গেছে। তিনি ভারতের একটি কারাগারে বন্দী আছেন। বালী জানিয়েছেন, তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরণ করে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এর পর আবার নতুন করে শুরু হয় এ চাঞ্চল্যকর ঘটনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে।  গণেশ চন্দ্র সাহা ছিলেন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আরেকজন সাক্ষী। কিন্তু গণেশ রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য না দিয়ে উল্টো মাওলানা সাঈদীর পক্ষে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন।  ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে একটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড হলো ভাগিরথী হত্যাকাণ্ড। বিধবা ভাগিরথীকে পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্পে আটকে রেখে ইজ্জত হরণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তথ্য পাচারের অভিযোগে ভাগিরথীকে পাকিস্তান আর্মি গাড়ির পেছনে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে হত্যা করে। মাওলানা সাঈদীর সহায়তায় এই ভাগিরথীকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। সেই ভাগিরথীর ছেলে হলেন সাক্ষী গণেশ চন্দ্র সাহা। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু তিনি কোর্টে এসে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে বললেন, মাওলানা সাঈদী তার মাকে মারেননি। পাকিস্তান আর্মিরাই তার মাকে মেরেছে।  এ ঘটনা তখন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।  ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে এ মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ ঘোষণা করার কথা ছিল। সে দিন দেশ-বিদেশের অসংখ্য সাংবাদিক হাজির হন ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু সে দিন ফাঁস হলো স্কাইপ কেলেঙ্কারির খবর।  ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নিজেই বিষয়টি ওপেন কোর্টে প্রকাশ করলেন সে দিনের এ ঘটনা।   বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, ব্রাসেলসে বসবাসরত আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কাছ থেকে ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালে এবং বিভিন্ন আদেশের  সময় সহায়তা নিয়েছেন তিনি। এ উপলক্ষে তাদের দু’জনের মধ্যে স্কাইপের মাধ্যমে কথোপকথন হয়েছে। এ তথ্য হ্যাক করে ইকোনমিস্ট হস্তগত করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি । ৯ ডিসেম্বর থেকে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে বিচারপতি নিজামুল হক ও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে তুমুল ঝড়  ওঠে। বিচারপতি নিজামুল হকের কথোপকথনের বিষয়বস্তু পড়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে গোটা জাতি। বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা একে দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করেন। শুধু স্কাইপ সংলাপ নয় বিচারপতি নিজামুল হক এ বিচার বিষয়ে তার সাথে যেসব মেইল আদান প্রদান করেছেন তা-ও ফাঁস হয়ে যায়। বিচারের বিভিন্ন বিষয় বেলজিয়াম থেকে লিখে পাঠানোর ঘটনার চিত্র বের হয়ে পড়ে এতে। এ ঘটনার জের ধরে ১১ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন নিজামুল হক। ২০১২ সালের ২০ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ৪৬ জন সাক্ষীর বিষয়ে একটি দরখাস্ত দাখিল করা হয় ট্রাইব্যুনালে। দরখাস্তে নিবেদন করা হয় ৪৬ জন সাক্ষীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। তাই এসব সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হোক। সাক্ষী হাজির করতে না পারার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় কেউ নিখোঁজ, কেউ পলাতক, কেউ অসুস্থ, কেউবা চলে গেছে ভারতে। ট্রাইব্যুনাল ২৯ মার্চ ১৫ জন সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী প্রদান করেন তা তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে আদেশ দেয়। এরপর ৩ জুন আসামিপক্ষ সেফহাউজের (ঢাকায় যেখানে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী  এনে রাখা হতো)  বিশাল ডকুমেন্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়ে বলেন, সাক্ষী হাজির করতে না পারার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ যে কারণ দেখিয়েছে তা সম্পূর্ণ  মিথ্যা। সাক্ষীগণ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ তাদেরকে আদালতে হাজির করেনি। অনেক সাক্ষী তাদের হেফাজতেই ছিল এবং সেফহাউজের রেজিস্টার বইয়ে  তার প্রমাণ রয়েছে। কোন সাক্ষী কবে সেফহাউজে আসে, কতদিন থাকে, কে কয়বেলা খেয়েছে তার সমস্ত তথ্য রেজিস্টার বইয়ে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। আসামিপক্ষ রাষ্ট্রপক্ষের সেফহাউজ থেকে রেজিস্টার খাতা সংগ্রহ করে ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।  অবশ্য রাষ্ট্রপক্ষ তাকে জাল হিসেবে আখ্যায়িত করে। মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার একেবারে শুরুতে বিতর্ক শুরু হয় ট্রাইব্যুনালের তখনকার চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হককে নিয়ে।  বিচারপতি নিজামুল হক ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি  (ঘাদানিক)  গঠিত  জাতীয়  গণতদন্ত কমিশন সেক্রেটারিয়েটের সদস্য ছিলেন। এ তদন্ত কমিশন কারাবন্দী মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ  মোট ১৬ জনকে  যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করে দুই দফা তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে ১৯৯৪ এবং ১৯৯৫ সালে। মাওলানা সাঈদীর আবেদনে  বলা হয়, যিনি আগে থেকেই আসামিদের বিচারের সাথে জড়িত তার কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা করা যায় না। তাই তাকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করা হয়। এ নিয়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে ওয়াকআউট করার ঘটনাও ঘটে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের।

No comments:

Post a Comment