Wednesday, September 17, 2014

আত্মহত্যার দীর্ঘ মিছিল:নয়াদিগন্ত

তন্ময় আর মিম। দু’জনেরই বয়স ১৬। দু’জনেই মগবাজার প্রভাতী বিদ্যানিকেতনে দশম শ্রেণীতে পড়ত। বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা। দিন দিন গভীর হয় তাদের প্রেম। এরপর ঘর বেঁধে সারা জীবন একসাথে থাকার স্বপ্ন। কিন্তু সে স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দুই পরিবার। মেয়ের পরিবার মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে ঠিক করে। কিন্তু ছেলেটি তা মেনে নিতে পারে না। মিমকে ছাড়া সে বাঁচবে না। তাই এক দিন বিকেলে দু’জনে বাসা থেকে বের হয়ে পড়ে। সারা রাত এদিক-সেদ
িক ঘোরাঘুরি। একসাথে বাঁচতে না পারলেও একসাথে মরার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। রাতে ঘোরাঘুরি শেষে ভোরে হাতিরঝিল ব্রিজের ওপর থেকে ঝাঁপ দেয়। প্রথমে তন্ময়; পরে মিম। তন্ময় ডুবে মারা যায়। মিমকে প্রত্যক্ষদর্শীরা পানি থেকে জীবিত উদ্ধার করেন। ঘটনাটি ঘটে গত ৩ জানুয়ারি শুক্রবার ভোরে। বেঁচে যাওয়া মিম জানিয়েছে, সে আত্মহত্যায় রাজি ছিল না। সে তন্ময়কে বাস্তবতা মেনে নিতে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু তন্ময় তাকে বোঝায় এক সাথে বাঁচতে না পারলে তাদের মরে যাওয়া উচিত। শেষে রাজি হয় মিম।  রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় বসবাসকারী নারায়ণগঞ্জের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রী সিমা বানু সিমি ২০০১ সালের ২৩ ডিসেম্বর আত্মহত্যা করে বখাটেদের অত্যাচার সইতে না পেরে। ২০১০ সালে একই এলাকায় একই কারণে আত্মহত্যা করে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ইলোরা। এরপর একই এলাকায় গত ৬ সেপ্টেম্বর যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ করে সিমিদের সাথে শামিল হলো উম্মে কুলসম রিতু নামে ১৪ বছরের এক স্কুলছাত্রী। বিষপানে আত্মহত্যা করে সে।  এর আগে গত এপ্রিলে রাজধানীর মিরপুরে সপ্তম শ্রেণীর মাদরাসাছাত্রী জামেনা আক্তার (১৫) যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যা করে।  প্রযুক্তির প্রসার বনাম আত্মহননের নতুন মাত্রা  যৌতুকের কারণে স্বামী ও স্বামীর পরিবারের অত্যাচার, পারিবারিক কলহ, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, প্রেমে ব্যর্থতা বা প্রতারণাÑ এগুলোই মূলত একটা সময় পর্যন্ত নারীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ ছিল আমাদের দেশে। কখনো কখনো পরীক্ষায় ফেল, নিজের অমতে জোর করে বিয়ে দেয়া, পরকীয়া, কেলেঙ্কারি, প্রিয় দলের পরাজয় প্রভৃতি কারণে তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার খবর বের হতো। সময়ের ব্যবধান এবং প্রযুক্তির বিকাশের কারণে আত্মহত্যার কারণের পরিধি যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে কিশোর-কিশোরীদের আত্মহননের প্রবণতা। ইভটিজিংয়ের আত্মহত্যা বলতে একসময় তেমন কিছু ছিল না। তেমনি ছিল না স্টার জলসা দেখতে না দেয়া, ঈদে পাখি ড্রেস না পাওয়া, ইউটিউব, ফেসবুক তথা ইন্টারনেটে শারীরিক সম্পর্ক বা নগ্ন ভিডিও প্রকাশের কারণে কোনো আত্মহত্যার ঘটনা। বিভিন্ন কারণে অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের আত্মহত্যার ঘটনা আগেও ঘটত তবে এ প্রবণতা বর্তমানে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে এবং এর সাথে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন বহুমাত্রিক কারণ।  সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর একটি স্কুলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন জব্দের পর পরীক্ষা করে দেখা গেছে বেশির ভাগ মোবাইলে অশ্লীল ভিডিও। মোবাইল, ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তিগত সামগ্রীর সহজলভ্যতার কারণে এসবের উপজাত তথা পর্নোগ্রাফি এখন তরুণ-তরুণীদের হাতের মুঠোয়। ফলে ধীরে ধীরে শিথিল তচ্ছে যৌন নৈতিকতার বাঁধন। উঠে যাচ্ছে শরম বা লজ্জাবোধ। ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে অবাধ মেলামেশার পরিবেশ। বিয়েবহির্ভূত যৌনতা বিষয়ে ধর্মীয়, পারিবারিক এবং সামাজিক সংস্কার ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তরুণ-তরুণীদের ভালোবাসা-ভাল লাগা দ্রুত শারীরিক সম্পর্কের পর্যায়ে গড়াচ্ছে আজকাল। অবাধ মেলামেশা থেকে সৃষ্ট নানামুখী জটিলতার কারণে সংঘটিত হচ্ছে নানা ধরনের অপরাধ এবং অনেক সময় তা গড়াচ্ছে আত্মহত্যা পর্যন্ত। প্রযুক্তির কারণে জীবনের সব মুহূর্ত মানুষ এখন ধারণ করে রাখছে। অনেক সময় প্রেমিকার অজ্ঞাতসারে গোপন মেলামেশার দৃশ্য ধারণ করে বা ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করে তা প্রকাশ করে দিচ্ছে ইন্টারনেটে। ফলে ইন্টারনেটে গোপন প্রেম বা নগ্ন ভিডিও প্রকাশের কারণে তরুণীর আত্মহত্যার খবর এখন একটি নিয়মিত বিষয়।  গত ৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং বাংলাদেশ পুলিশ সদরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৩ সালে দেশে ১০ হাজার ১২৬ জন আত্মহত্যা করেছে। এদের বেশির ভাগের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। আত্মহত্যাকারীদের ৬০ ভাগ নারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের অন্যান্য দেশে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে বেশির ভাগ পুরুষ হলেও বাংলাদেশে বেশির ভাগ আত্মহত্যাকারী নারী। ২০১২ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যাকারী ১০১৬৭ জনের মধ্যে নারী ছিলেন ৫৭৭৩ জন ও পুরুষ ৪৩৯৪ জন। ২০১১ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করে সাড়ে ৯ হাজারের বেশি মানুষ।  পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় রংপুরের বদরগঞ্জে গত সাত মাসে ১২ জন আত্মহত্যা করে যার মধ্যে আটজনই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এ ছাড়া কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ২০১৩ সালে ১৯ জন আত্মহত্যা করে যার বেশির ভাগই কিশোর-কিশোরী। এভাবে সারা দেশে যে সংখ্যক মানুষ আত্মহত্যা করছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ বর্তমানে কিশোর-কিশোরী।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী আত্মহত্যায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। ২০১১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৮তম।  প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ আত্মহত্যা। যে সংখ্যক মানুষ আত্মহত্যা করে তার থেকে ২০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়।  কিশোরী আত্মহননের কয়েকটি ঘটনা ও কারণ রাজবাড়ীর পাংশায় নিপা আক্তার নামে এইচএসসি প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করে তার নগ্ন ভিডিও প্রকাশের হুমকি দেয়ায়। এলাকার আলফাজ, টুটুল এবং মিতা তিনজন মিলে কৌশলে তাকে একটি বাড়িতে ডেকে নিয়ে জোর করে নগ্ন ভিডিও ধারণ করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে। এরপরই সে আত্মহত্যা করে।  রংপুরের পীরগাছায় অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে বিয়ে করার আশ্বাস দিয়ে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে ফুয়াদ দেউতি। পরে তা ইন্টারনেটে প্রকাশ করে দেয়ায় আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় ওই ছাত্রী। দু’টি ঘটনাই গত আগস্ট মাসে ঘটে।  সম্প্রতি বরিশাল বিএম কলেজের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে তার নগ্ন ভিডিও প্রকাশ হয়ে পড়ায়। গত ফেব্রুয়ারিতে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে বিউটি নামে ২০ বছরের এক তালাকপ্রাপ্তার ধর্ষণের ভিডিও প্রকাশ পাওয়ায় তিনি আত্মহত্যা করেন।  মোবাইলফোনে বেশি কথা বলার জন্য রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার দশম শ্রেণীর ছাত্রী শিউলি রাণীকে বকাঝকা করেন তার বড় ভাই। অভিমানে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে সে। গত ৫ জুনের ঘটনা এটি।  পাখি জামা কিনে না দেয়ায় নওগাঁর আত্রাইয়ে মিম আক্তার নামে ১৪ বছরের এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করে। স্টার জলসা দেখতে না দেয়ায় কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে রিয়া নামে ১৫ বছরের এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করে। দু’টি ঘটনাই গত মাসের।  সাভারে ১৭ বছরের স্কুলছাত্রী রিয়া পারিবারিক কলহের কারণে অভিমান করে আত্মহত্যা করে। একই কারণে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী নবনিতা দত্ত আত্মহত্যা করে। এ দু’টি ঘটনাও গত মাসের।  চলতি মাসে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে মুন নামে ১৩ বছরের এক স্কুল ছাত্রী পরিবারের ওপর অভিমান করে আত্মহত্যা করেছে। একই কারণে আত্মহত্যা করেছে ঝিনাইদহের মহেশপুরে লাকি খাতুন নামে ১৬ বছরের অষ্টম শ্রেণীপড়–য়া এক স্কুলছাত্রী।  পড়ালেখা নিয়ে মা-বাবার বকুনির কারণে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় মর্জিনা আক্তার নামে ১৩ বছরের এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। একই কারণে বরিশালের পলাশপুরে রেখা আক্তার নামে সপ্তম শ্রেণীর এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করে। ঝিনাইদহের শৈলকূপায় জেসমিন নামে ষষ্ঠ শ্রেণীর এক স্কুল ছাত্রী আত্মহত্যা করে মা-বাবা বকা দেয়ার কারণে। এ তিনটি ঘটনাও গত মাসের।  ২০০১ সালে উত্ত্যক্তের কারণে সিমির আত্মহত্যার ঘটনার পর একের পর এক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। ২০১০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসে উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছে ২৬ জন তরুণী। এ ছাড়া ২০০৯ সালে সাত এবং ২০০৮ সালে ৯ জন তরুণী উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করে।  উদ্বেগজনক নারী নির্যাতন চিত্র : বাংলাদেশে তরুণ-তরুণীদের আত্মহনন শুধু যে বেড়েছে তা নয় বরং সার্বিকভাবে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র ক্রমে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।  মহিলা পরিষদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩০৪টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন নারী। ধর্ষণের পরে ৪৫ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া যৌতুকের কারণে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১২৭টি, যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার ৯০ জন। আর নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন ৮০ জন। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত সাত মাসেই দেশের বিভিন্ন থানায় নারী নির্যাতন মামলা হয়েছে ১১ হাজার ৯১৩টি। ২০১৩ সালে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয় ১৯ হাজার ৬০১টি, ২০১২ সালে ২০ হাজার ৯৪৭টি, ২০১১ সালে ২১ হাজার ৩৮৯টি এবং ২০১০ সালে ছিল ১৭ হাজার ৭৫২টি। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪১৪ জন।  বিশেষজ্ঞরা যা বলেন : কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যা, উত্ত্যক্ত এবং সমাজে নারী নির্যাতন এবং এ থেকে বাঁচার উপায় কি, তা নিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীর সাথে।  তাদের মতে, মা-বাবার অধিক ব্যস্ততা এবং প্রযুক্তি বিকাশের কারণে সন্তানদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা এবং নিঃসঙ্গতা বাড়ছে। শিথিল হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। এর সাথে ভোগবাদিতা, অধিক পাওয়ার আকাক্সা, সবকিছুতে তীব্র প্রতিযোগিতা, সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা, পরিবারে নৈতিকতা চর্চার অভাব, সমাজে অন্যায় অনাচার ছড়িয়ে পড়া সব কিছু মিলিয়ে কিশোর-কিশোরীরা সহজেই নানা নিষিদ্ধকাজে আগ্রহী হয়ে উঠছে এবং নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তা ছাড়া ধর্ষণ, উত্ত্যক্ত ও জোর করে প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাবের সাথে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে ক্ষমতার বলয়ে থাকা লোকজন জড়িত। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তাদের দাপটে ভুক্তভোগীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় নিরাপত্তাহীনতা এবং একমাত্র সমাধান হিসেবে অনেক সময় অসহায় নারীরা বেছে নেয় আত্মহননের পথ।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, কিশোর বয়সে ছেলেমেয়েদের আবেগ বেশি থাকে। অন্য দিকে আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কম থাকে। ফলে তারা অনেক সময় নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়। শিশুদের যেমন মা-বাবার দেখাশুনা করতে হয় তেমনি কিশোর- কিশোরীদেরও মা-বাবার দেখাশুনা করা দরকার। কিন্তু বর্তমানে অনেক পরিবারের কিশোর-কিশোরী মা-বাবার সংস্পর্শ কম পাচ্ছে। পরিবারের সাথে বিচ্ছিন্নতা বেশি হচ্ছে। যথাযথ গাইড পাচ্ছে না তারা। এতে মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে।  এ থেকে বাঁচার উপায় কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা অন্যায় অনাচার করছে তাদের প্রতিরোধ করা দরকার। তিনি বলেন, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে কিন্তু সে লেখাপড়া প্রকৃত লেখাপড়া হওয়া উচিত। আদর্শভিত্তিক এবং আদর্শ চিন্তার বিকাশের ব্যবস্থা থাকা দরকার শিক্ষাব্যবস্থায়। আজকাল যে লেখাপড়া হচ্ছে তাতে আসলে অনেক তথ্যের মধ্যে ও অনেক তথ্যপ্রযুক্তির মধ্যে আটকা পড়ছে ছেলেমেয়েরা।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগের প্রফেসর ড. আজিজুন নাহার ইসলাম বলেন, জাপান ও কোরিয়ায় যারা আত্মহত্যা করে তাদের একটি বড় অংশ নাস্তিক। আমাদের সমাজের মেয়েরা ধার্মিক এবং রক্ষণশীল হওয়া সত্ত্বেও তারা আত্মহত্যা করছে ধর্ম, সমাজ এবং মা- বাবার কারণে। অল্প বয়সী মেয়েরা বেশি আত্মহত্যা করে প্রেমের কারণে। প্রেমের ক্ষেত্রে সমস্যায় জড়িয়ে সমাজ, ধর্ম এবং মা-বাবার ভয়ে তারা আত্মহত্যা করে।  প্রফেসর আজিজুন নাহার বলেন, প্রযুক্তি সত্যিই আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের এসব ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা সীমা আরোপ করা উচিত। মা-বাবার কারণে ছেলেমেয়েরা বিচ্ছিন্ন তা মানতে অস্বীকার করে তিনি বলেন, প্রযুক্তির কারণে আজকাল ছেলেমেয়েরাই নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তারা সারাক্ষণ ল্যাপটপ ও ফেসবুক নিয়ে থাকে আর কানে মোবাইলের হেডফোন লাগিয়ে রাখে। মা-বাবাকে কোনো পাত্তা দিতে চায় না তারা এবং মা-বাবার কাছে ঘেঁষতে পারে না অনেক সময়।  তা ছাড়া আত্মহত্যার খবর মিডিয়ায় বেশি করে প্রচারেরও বিরুদ্ধে তিনি। তার মতে, এটি একটি সংক্রামক ব্যাধির মতো কাজ করে।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ছেলেমেয়েরা বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে আজকাল। পরিবার থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। উপযুক্ত নির্দেশনা পাচ্ছে না। ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে। তা ছাড়া আদর্শহীন ভোগবাদী জীবনদর্শন তথা খাও দাও আর ফুর্তি করোÑ এসবের দিকে ধাবমান হচ্ছে এক শ্রেণীর লোক। ফলে এসব সামাজিক সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে।  এনাম মেডিক্যাল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান ড. আব্দুর রহিম বলেন, আমাদের কাছে যেসব রোগী আসে তার মধ্যে ছেলেদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ হলো মাদকাসক্তি আর মেয়েদের বিশেষ করে তরুণীদের প্রধান কারণ হলো প্রেম।  ডা: আব্দুর রহিম বলেন, বর্তমানে একটি ছেলে বা মেয়ে পরিপক্ব হওয়ার আগে জীবন সম্পর্কে ভালো করে কোনো কিছু উপলব্ধির আগেই তাদের প্রযুক্তির মধ্যে ডুবিয়ে দেয়া হয়। বিশেষ করে মোবাইলফোন ছেলেমেয়েদের বেশি ক্ষতি করছে। প্রযুক্তির বিকাশের ফলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে অবাধ মেলামেশা বাড়ছে। এ থেকে নানা জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে তাদের জীবনে। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে ধর্মীয় মূল্যবোধের লালন এবং সুন্দর পারিবারিক বন্ধন প্রতিষ্ঠা করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. শাহ এহসান হাবীব বলেন, আমাদের পারিবারিক বন্ধন অনেক শিথিল হয়ে গেছে। নানা কারণে আমরা সবাই এখন বেশি ব্যস্ত। পরিবারের সদস্যদের সাথে কথাবার্তা কমে গেছে। এর পেছনে প্রযুক্তির বড় একটা ভূমিকা আছে। আমরা এখন ফেসবুকে সময় দেই। কিন্তু আপনজনের সাথে সামনাসামনি বসে কথা বলা সম্ভব হয় না। আমরা প্রত্যেকে নিজস্ব একটা ভার্চুয়াল জগৎ বা বলয় গড়ে তুলেছি। এভাবে আমরা ধীরে ধীরে চার পাশের বাস্তব পরিবেশ থেকে নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছি। ফলে আমাদের ছেলেমেয়েরা আর আগের মতো আমাদের সাথে অনেক কিছুই মন খুলে বলতে পারে না। পাশাপাশি ছোটরা অনুকরণপ্রিয় হওয়ায় তারা টিভি মিডিয়া থেকে এটা বেশি করে থাকে। বয়স কম থাকায় কোনটা অনুকরণ করা উচিত এবং কোনটা বর্জন করা উচিত সেটা তারা নির্ধারণ করতে পারে না। ফলে খারাপের অনুকরণ বেশি হচ্ছে। তিনি বলেন পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা কাটাতে আমাদের উচিত ছেলেমেয়েদের বেশি করে সময় দেয়া। তাদের কথা শোনা। ড. মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ আবু ইউছুফ খান বলেন, জীবনের প্রতি চূড়ান্ত হতাশা এবং আস্থাহীনতা থেকেই মানুষ শেষ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আল্লাহর প্রতি ঈমান, ভরসা এবং নির্ভরতাই পারে মানুষকে এ হতাশা থেকে ফিরিয়ে আনতে। সেই সাথে সমাজ থেকে পাপাচার, শোষণ, বঞ্ছনা, বৈষম্য দূর করতে হবে। তাহলেই মানুষ এ সঙ্কট থেকে মুক্তি পাবে।  বিশেষজ্ঞদের মতে সন্তান কী করছে বা না করছে তার প্রতি লক্ষ রাখা দরকার। প্রতিটি পরিবার যদি এ দায়িত্ব যথাযথ পালন করে তাহলে অনাকাক্সিত ঘটনা কমে আসবে। সন্তানের প্রতি সত্যিকারের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করার জন্য মা-বাবাকে প্রথমে সৎ, স্বচ্ছ নৈতিক জীবনযাপনের পথ বেছে নিতে হবে। তাহলেই তার প্রভাব পড়বে সন্তানের ওপর।

No comments:

Post a Comment