‘দেশের ব্যাংকিং খাত খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। এসব ব্যাংকে সুশাসন বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করলেও খুব একটা সফল হতে পারছে না। বাংলাদেশ নিয়ে ক্রেডিট রেটিং করতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ফিচ রেটিংস। আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশকালে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্বেগ প্রকাশে
র দুই দিন পরই দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে এমন হতাশার কথা জানাল বিশ্বব্যাপী সাড়ে তিন হাজার ব্যাংকের রেটিং করা শতবর্ষী সংস্থা ফিচ রেটিংস। ফিচের রেটিং ‘বিবি’ বলতে বর্ধিত ঝুঁকি নির্দেশ করে। বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে একটা নেতিবাচক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বর্ধিত ঝুঁকি নির্দেশ করে। একই সঙ্গে ব্যবসা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আর্থিক স্থিতিস্থাপকতাও আছে। বাংলাদেশ এই পর্যায়ের চেয়েও এক ধাপ নিচে অবস্থান করছে, যাকে ফিচ ‘বিবি-’ বলে চিহ্নিত করেছে। অন্যদিকে ফিচের রেটিংয়ে ‘এএএ’ থেকে ‘ডি’ পর্যন্ত মোট ১১টি ধাপ রয়েছে। তার মধ্যে ‘বিবি’ হচ্ছে পঞ্চম অবস্থানে। মানের সামান্য তারতম্যের পরিপ্রেক্ষিতে এর সঙ্গে প্লাস-মাইনাস যোগ করা হয়। গত ২৯ আগস্ট দেওয়া প্রতিবেদনে ফিচ বলেছে, বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে বৈদেশিক ও স্থানীয় মুদ্রা ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিংসের (আইডিআরএস) ক্ষেত্রে ‘বিবি-’ (বিবি মাইনাস), দীর্ঘমেয়াদে আইডিআরএস স্থিতিশীল। এ ছাড়া স্বল্পমেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রার (আইডিআর) ক্ষেত্রে ‘বি’ এবং কান্ট্রি সিলিংয়ে ‘বিবি-’ অর্জন করেছে। সভরেন ক্রেডিট রেটিং বা স্বাধীন ঋণমান নিক্তিতে এসঅ্যান্ডপি ‘বিবি-’ এবং মুডিস ‘বিএ৩’ দেওয়ার পর বাংলাদেশ নিয়ে করা প্রথম প্রতিবেদনে নিউ ইয়র্কভিত্তিক ফিচ বাংলাদেশকে দিয়েছে ‘বিবি-’। ফিচ রেটিংয়ের প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ ব্যাংক দিন কয়েক আগে হাতে পেয়েছে, তবে এখনো তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। গতকাল প্রতিবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিবি-’ অর্থ হলো স্থিতিশীল। তবে আমি এখনো ফিতসের প্রতিবেদন দেখিনি। এটি পর্যালোচনা না করে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। সংস্থাটি বলেছে, ২০১৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে এ খাতের নন-পারফর্মিং ঋণের অনুপাত ছিল ৮.৯ শতাংশ। ২০১৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.৫ শতাংশ। আর এই সময়ে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোর নন-পারফর্মিং ঋণের অনুপাত ঠেকেছে ২১.৯ শতাংশে। ফিচের তথ্য মতে, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোর যে মূলধন ঘাটতি রয়েছে, তা মধ্যমেয়াদে দূর করা সম্ভব হবে। রেটিংয়ে বাংলাদেশের নিম্ন পর্যায়ের উন্নয়নের তথ্য উঠে এসেছে। ফিতসের মতে, জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচক ও সরকারের বিভিন্ন সূচকেও সার্বিকভাবে দৈন্যদশা উঠে এসেছে। জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুযায়ী, রেটিংয়ে বিবি মানদণ্ড পেতে হলে মানবসম্পদ উন্নয়নে মাথাপিছু জিডিপি চার হাজার ৬৯৬ ডলার হওয়ার কথা; কিন্তু ২০১৩ সালে বাংলাদেশে এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ২৩ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ক্রেডিট রেটিং সংস্থা ফিচ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অনেক উদ্যোক্তাই বিনিয়োগ পরিকল্পনা হয় বাতিল করেছেন, না হয় বিলম্বিত করছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও হাত গুটিয়ে নিয়েছে, রপ্তানিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংস্থাটির মতে, গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে বছরখানেক ধরে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল, তা দৃশ্যত এখন স্বাভাবিক মনে হলেও বিনিয়োগকারীদের কপালের ভাঁজ দূর করতে পারেনি। বাংলাদেশের রাজনীতির এ অস্থিতিশীল অবস্থা আরো দীর্ঘায়িত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করেছে ফিচ। তাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর রাজনৈতিক ঝুঁকি কমাতে পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এর আগে স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড পুরস (এসঅ্যান্ডপি), মুডিসও একই ধরনের কথা বলেছে। ঋণমান নিক্তির ওপর আন্তর্জাতিক লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অনেকটাই নির্ভর করে। এর মধ্য দিয়ে একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা ফুটে ওঠে। রেটিংসে ভালো করলে আন্তর্জাতিক লেনদেনে বৈশ্বিক বৃহৎ ব্যাংকগুলো আগ্রহী হয়। ঋণপত্রের ক্ষেত্রে চার্জ কম হয়। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ কমে। বিনিয়োগে বিদেশিরা আকৃষ্ট হয়। কম সুদে বিদেশ থেকে ঋণ পায় বিনিয়োগকারীরা। ফিচের মতে, বাংলাদেশের রেটিংয়ে উচ্চ ও স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন, রাজনৈতিক ও ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকির প্রতিফলন রয়েছে। পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশ ৬.২ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। চলতি অর্থবছর ৬.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের জন্য ছয়টি ঝুঁকি চিহ্নিত করে তা দূর করার সুপারিশ করেছে ফিচ। তাতে বলা হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে টেকসই উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে- এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি না দেওয়ার বিষয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। ব্যাংকিং খাতে লেনদেন শক্তিশালীকরণ ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীন ঋণমান নিক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থাকে স্থিতিশীল উল্লেখ করে ফিচ বলেছে, গত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও অর্থনীতিকে পঙ্গু করতে পারেনি। তবে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় বাধা হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকসহ সার্বিক ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাকেও দায়ী করেছে ফিচ। এ ছাড়া দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য মূল দুটি খাত তৈরি পোশাক ও প্রবাসী আয়ের ওপর অতি নির্ভরতাকেও ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছে ফিচ। সংস্থাটি বলেছে, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই তৈরি পোশাক থেকে আসে। আবার তৈরি পোশাকের ৮৫ শতাংশই রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। শ্রম অসন্তোষ বা জিএসপি প্রত্যাহার বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) যুক্তরাষ্ট্রের পথ অনুসরণ করলে বাংলাদেশের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাবে। অন্যদিকে ৩০ মে করা প্রতিবেদনে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে- এমন তথ্য তুলে ধরে মুুডিস বলেছে, শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপির মধ্যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান আরো কঠোর হচ্ছে। প্রথাগতভাবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগের বছর হরতাল ও অবরোধ বাড়ে। নিরপেক্ষা অন্তর্বর্তীকালীন ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর নির্বাচনী গতি আরো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এক বছর ধরে চলমান অনিশ্চয়তার পর ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সংসদীয় নির্বাচন হয়েছে। বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করেছে এবং প্রায় অর্ধেক আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী জয়ী হয়েছে। তখন থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। তবে দুর্বল শাসনব্যবস্থা এবং পতনশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অর্থনীতির ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলছে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও অনিয়মের কারণে দাতারা বাংলাদেশকে ঋণ দিতে আগ্রহ হারিয়েছিল। পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার ঘটনাও এর প্রমাণ। তবে গত বছরের জুন থেকে এবারের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। অন্যদিকে এসঅ্যান্ডপির প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশের কঠিন বিনিয়োগ পরিবেশ বিরাজমান থাকায় সরাসরি বিনিয়োগের পরিমাণ কম। অভ্যন্তরীণ সম্পদের অভাবের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটসহ অবকাঠামোগত দুর্বলতাও রয়েছে। এসব সমস্যার সঙ্গে প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্বলতা বাংলাদেশের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসঅ্যান্ডপি-এর মতে, বাংলাদেশের গলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্বলতা সৃষ্টি ও সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি করে। ফলে বিনিয়োগের স্বস্তি আসে না। এ ছাড়া বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কম, রাজস্ব বাড়ানোর মতো কর্মকাণ্ডও তেমন নেই। মৌলিক অবকাঠামো ও সরকারি সেবার তাৎপর্যপূর্ণ সংকটও প্রকট। দেশের গোলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ প্রশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রতিফলন রয়েছে রেটিংয়ে।
No comments:
Post a Comment