কন্টেইনার থেকে মূল্যবান মালামাল চুরিতে বাধা দেয়া ও সংঘবদ্ধ চোরদের চিনে ফেলায় আনসার সদস্য এমদাদুল হককে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। সংরক্ষিত এলাকা রাজধানীর কমলাপুরে ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোর (আইসিডি) মধ্যে দায়িত্বরত অবস্থায় তাকে খুন করা হয়। সেই খুনের নেপথ্যে আইসিডির এক বা একাধিক কর্মচারীও জড়িত ছিল বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। হত্যাকাণ্ডের প্রায় আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি
পুলিশ। নিহতের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ওপর মহলের চাপ থাকার কারণেই পুলিশ প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতার করছে না। হত্যাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করার দাবি স্বজনদের। মামলা তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর যুগান্তরকে বলেন, আইসিডি সংরক্ষিত এলাকা। আইসিডির নিরাপত্তা প্রহরীসহ আনসার সদস্যরা সার্বক্ষণিক সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে। এই নিরাপত্তা বেষ্টিত এলাকায় আনসার সদস্য খুনের ঘটনা রহস্যজনক। এ পর্যন্ত সেখানে দায়িত্বরত ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের অনেকের কথায় অসংলগ্নতা পাওয়া গেছে। ৩০ জুলাই রাতে আইসিডির এক নম্বর ভবনে (ওয়ার্কশপ) নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন এমদাদুল হক। তার ডিউটির সময় ছিল রাত ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ওই এক নম্বর ভবনের সামনে দীর্ঘদিন ধরে মালভর্তি কন্টেইনার রাখা হয়। একটি কন্টেইনারে এমন কিছু দামি মালামাল ছিল যা চুরি করে নিয়ে সহজে বাজারে বিক্রি সম্ভব। ঈদুল ফিতরের ছুটিতে আইসিডির ভেতরের কর্মচারী ছিল কম। ওই সুযোগেই দুর্বৃত্তরা ওই কন্টেইনার থেকে মালামাল চুরি করতে যায়। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের একজন জানান, দুর্বৃত্তরা এই কন্টেইনার থেকে মালামাল চুরি করতে গেলে এমদাদ বাধা দেন। তিনি চোরদের হাতেনাতে ধরেন এবং সবাইকে চিনে ফেলেন। ফলে চুরির বিষয়টি এমদাদ ফাঁস করে দিতে পারে আশংকায় দুর্বৃত্তরা তাকে গলায় রশি বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করেছে। হত্যাকাণ্ডের পরপরই সেখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে রাখা হয়েছে কন্টেইনারটি। ওই এলাকায় ভেতরের কারোর সংশ্লিষ্টতা না থাকলে বাইরের কেউ ঢুকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব নয় বলেও জানান ওই কর্মকর্তা। আইসিডি আনসার ক্যাম্পের ওই সময়ের ক্যাম্প ইনচার্জ দুলাল মিয়া যুগান্তরকে বলেন, রাত ২টায় আনসার সদস্য মাসুদ দায়িত্ব বুঝে নিতে গিয়ে এমদাদকে না পেয়ে তাকে অবহিত করেন। তিনিসহ অপর আনসার সদস্যরা খোঁজাখুঁজি করে আইসিডির ভেতরের একটি ড্রেনে গলায় রশি বাঁধা অবস্থায় এমদাদের মৃতদেহ পান। রাত ১০টা থেকে ২টার মধ্যে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তিনি বলেন, আইসিডির ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে হলে তিনটি গেট পার হয়ে প্রবেশ করতে হয়। এ গেটগুলোতে নিরাপত্তা কর্মীরা দায়িত্বে থাকেন। খুনিরা যদি বাইরের হয়, তাহলে এ নিরাপত্তা ভেদ করে কিভাবে ভেতরে প্রবেশ করল এবং খুন করে বেরিয়ে গেল। এটা রহস্যজনক। নিহতর ভাই মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘আমার ভাইকে কারা কেন খুন করেছে, সে রহস্য এখনও পুলিশ বের করতে পারেনি। সংরক্ষিত এলাকায় ভেতরে যাদের যাতায়াত তাদের সম্পৃক্ততা ছাড়া এ হত্যাকাণ্ড সম্ভব নয়। আর যদি বাইরের লোক এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েও থাকে, তাহলে ভেতরের ও গেটে দায়িত্বরত কারোর সহযোগিতা রয়েছে।’ তিনি জানান, ঘটনাস্থল ওয়ার্কশপ এলাকায় রাত-দিন মানুষ কাজ করে। গাড়ির ড্রাইভাররাও থাকে সেখানে। ওই রাতেও সেখানে অনেকে ছিল। তার অভিযোগ, ওপর মহলের কারোর চাপ থাকার কারণে হয়তো খুনিদের মুখোশ উন্মোচন করা হচ্ছে না। একটি সূত্র জানিয়েছে, মামলাটির প্রথমে তদন্তভার ছিল শাহাজাহানপুর থানা পুলিশের কাছে। এসআই মাসুদ ছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা। মামলার তদন্ত করতে গিয়ে নানা চাপে পড়েন তিনি। এ কারণেই পরে মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়। আনসার ভিডিপির পূর্ব জোনের অধিনায়ক আসলাম সিকদার যুগান্তরকে বলেন, আইসিডির মধ্যে আনসার সদস্য খুন হওয়া রহস্যজনক। ঘটনার আড়াই মাস পার হলেও পুলিশ আসামিদের সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি। নিহত এমদাদের বাড়ি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের নাসুল্লাহ গ্রামে। বাবা রাজ উদ্দিন কৃষিকাজ করেন। হত্যাকাণ্ডের আট মাস আগে এমদাদ আনসার ভিডিপিতে যোগ দেন এবং প্রথম পোস্টিং হয় আইসিডিতে। ৩১ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে লাশ ময়নাতদন্তের সময় মতিঝিল থানা আনসার ভিডিপি কর্মকর্তা সানাউল ইসলাম বলেছিলেন, এক নম্বর ভবনের একটি কক্ষের তালা ভেঙে নথিপত্র তছনছ করা হয়েছে। তছনছ করার সময় দুর্বৃত্তদের দেখে ফেলায় তাকে খুন করা হয়ে থাকতে পারে। সে সময় কমলাপুর আইসিডিতে কর্মরত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিবহন পরিদর্শক শাহজাহান চৌধুরী বলেছিলেন, ওই কক্ষে থাকা নথিপত্র তছনছ করা হলেও কিছু খোয়া যায়নি। তবে ওই কক্ষে তেমন কোনো মূল্যবান নথিও থাকে না, যা চুরি করলে বড় রকমের ক্ষতি হতে পারে।
No comments:
Post a Comment