ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রিত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর এ ধরনের ঘটনার নজির আর নেই। মন্ত্রিসভা থেকে লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণ কার্যকর করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে গতকাল রবিবার বঙ্গভবনে যান। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করেন। এ বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণের প্র
জ্ঞাপন জারি করে। ওদিকে গত রাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় লতিফ সিদ্দিকীকে দলের সভাপতিমণ্ডলী ও দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে সভা সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে দলের গঠনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতার কারণে প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে কেন তাঁকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না- এ মর্মে লতিফ সিদ্দিকীকে একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছ থেকে এ ধরনের প্রস্তাব এলে উপস্থিত সবাই তা সমর্থন করেন বলে সভায় উপস্থিত এক নেতা জানান। এক সপ্তাহের মধ্যে সন্তোষজনক উত্তর না পেলে লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্যপদও বাতিল হয়ে যাবে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের পালকি পার্টি সেন্টারে যুক্তরাষ্ট্রের টাঙ্গাইল জেলা সমিতির মতবিনিময় অনুষ্ঠানে হজ, তাবলিগ ও প্রধানমন্ত্রীপুত্র জয় নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার ১৫ দিনের মাথায় লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিল সরকার। লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণের সংবাদ জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর নিয়োগের অবসান ঘটানোর জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেন, রাষ্ট্রপতি তাতে সই করেছেন এবং আমরা প্রজ্ঞাপন জারি করেছি।’ লতিফ সিদ্দিকী পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে আসা খবরের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই।’ ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী পদে নতুন কেউ নিয়োগ না পাওয়া পর্যন্ত এ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদসচিব। আওয়ামী লীগ নেতা লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়। সেদিন টাঙ্গাইল সমিতির এক অনুষ্ঠানে লতিফ বলেন, ‘আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী।’ এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘বিপুল সংখ্যক মানুষ হজে যাওয়ায় দেশের অর্থ আর শ্রম শক্তির অপচয় হয়।’ তাঁর ওই বক্তব্যের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে কয়েকটি ইসলামী দল আন্দোলনের হুমকি দেয়। তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার পাশাপাশি গ্রেপ্তারের দাবিও তোলে বিএনপি। এর মধ্যেই ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দেওয়ার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় অন্তত দুই ডজন মামলা হয়েছে। নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরে গত ৩ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন লতিফ সিদ্দিকী আর মন্ত্রিসভায় থাকবেন না। তবে রাষ্ট্রপতি হজ পালনে সৌদি আরবে থাকায় লতিফ সিদ্দিকীকে বাদ দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা ঝুলে থাকে। গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুযায়ী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রী পদে নিয়োগের অবসান ঘটানোর জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেন। পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের (১) দফার (গ) উপ-দফা অনুযায়ী ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রী পদে নিয়োগের অবসান হয়েছে। কেন লতিফের মন্ত্রিত্বের ‘অবসান’ ঘটানো হলো- সে বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। মন্ত্রিপরিষদসচিবও এর বাইরে কিছু জানাননি। টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে পাঁচবার এমপি নির্বাচিত হন লতিফ সিদ্দিকী। গত মহাজোট সরকারের পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। শেখ হাসিনা টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর চলতি বছরের শুরুতে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সমালোচনা থাকায় শেখ হাসিনার গত সরকার থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে। এ ছাড়া অর্থ কেলেঙ্কারিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করলেও তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করে রাখা হয়েছিল। এর আগে বিএনপি ও জামায়াত জোট সরকারের আমলে সাবেক জ্বালানিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররাফ হোসেন ২০০৫ সালে পদত্যাগ করেছিলেন। এ ছাড়া ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর বিভিন্ন মন্ত্রী তাঁদের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর কোনো মন্ত্রীকে অপসারণের নজির তাদের জানা নেই। এই সময় বিভিন্ন মন্ত্রী ‘বাধ্য হয়ে’ বা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন। টাঙ্গাইলে প্রভাবশালী সিদ্দিকী পরিবারের সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর দেওয়া তাঁর তীর্যক বক্তব্য নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নিজের ভাই কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গেও তাঁর বৈরী সম্পর্ক। তিনি কর্মকর্তাদের সঙ্গেও ভালো আচরণ করতেন না। সম্প্রতি তিনি বাড়িতে ডেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক প্রকৌশলীকে পিটিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অর্থমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রীর সঙ্গেও লতিফ সিদ্দিকী পেশাগত বিতর্কে জড়িয়েছেন। বাংলাদেশে সব পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন চালুর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মধ্যেই গত বছর রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে একটি চিঠি লেখেন তখনকার বস্ত্রমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। চিঠিতে তিনি মজিনাকে বলেছিলেন- ‘ট্রেড ইউনিয়ন প্রশ্নে আপনি বলার কে?’ ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে ১৯৬৪-৬৫ সালে তিনি করটিয়া সাদত কলেজ ছাত্রসংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ’৬৬ সালের ছয় দফা ও ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় এই নেতা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসেবেও ভূমিকা রাখেন।
No comments:
Post a Comment