একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্
ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। চারটি অভিযোগে তাঁকে এই সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে অন্য চারটি অভিযোগে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের গঠন করা ১৬টি অভিযোগের মধ্যে আটটি প্রমাণিত হয়েছে। অন্য আটটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সেসব অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল বুধবার এ রায় ঘোষণা করেন। এ নিয়ে দ্বিতীয় মামলায় নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। এর আগে বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের মামলায় নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। নানা কারণে নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় দীর্ঘায়িত হয়। মামলাটি তিনবার রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়। একবার দিন ধার্য করেও রায় ঘোষণা করা হয়নি। গতকাল দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রায় ঘোষণার পর আদালতে উপস্থিত বিশিষ্টজনরা বলেন, এই রায়ে শুধু ইতিহাসের সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, মানবজাতির জন্য এটি এক যুগান্তকারী রায় হয়েছে। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন এটি। গতকাল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ে বলা হয়, যেহেতু তাঁকে চারটি অভিযোগে আলাদাভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাই একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। তাঁর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার আদেশ দেওয়া হয়। একটি কার্যকর হলে অন্য দণ্ড কার্যকর করার প্রয়োজন নেই। রায়ের শেষ অংশে দেওয়া অভিমতে বলা হয়, অপরাধের ধরন, আসামির অংশগ্রহণ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, আলবদর বাহিনীতে তাঁর অবস্থান বিবেচনায় সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য। তাঁকে শাস্তি দেওয়া হবে ভিকটিমদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির প্রতিফলন। বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর গণহত্যা চালানো, গণহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তাঁর শাস্তি প্রাপ্য। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এসব অপরাধে তাঁর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া না হলে সেটা হবে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে ব্যর্থতা। অভিমতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বিষয়ে নিজামীর ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। খণ্ডন করা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে বিচার করার অভিযোগ। এ ছাড়া বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে নিজামীর সম্পৃক্ত না থাকার বিষয়ে আসামিপক্ষের বক্তব্য খণ্ডন করেও ট্রাইব্যুনালের মতামত তুলে ধরা হয়। এ অভিমত প্রকাশের পর ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান একে একে সাজা ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান সাজা ঘোষণা করার আগে ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই বিচারকের মধ্যে বিচারপতি আনোয়ারুল হক ভূমিকাসহ ১৬টি অভিযোগ এবং বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন অভিমতসহ কিছু অংশ পাঠ করেন। রায় ঘোষণার শুরুতে দুই পক্ষের উপস্থাপিত যুক্তিগুলো তুলে ধরা হয়। যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ২৪ মার্চ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন ট্রাইব্যুনাল। এর তিন মাস পর গতকাল রায় ঘোষণা করা হলো। নিজামীর বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুটপাট, দেশান্তরে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৫টি অভিযোগ এনেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষের ফরমাল চার্জে (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) বুদ্ধিজীবী হত্যায় নিজামীর সম্পৃক্ততার তথ্য থাকলেও অভিযোগের তালিকায় সেটি ছিল না। পরে ট্রাইব্যুনাল সেটি অভিযোগ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ২০১২ সালের ২৮ মে নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগে অভিযোগ গঠন করা হয়। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ২৬ জন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। নিজামীর পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য চার সাফাই সাক্ষী নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল। যদিও প্রথমে ১০ হাজার ১১১ জন এবং পরে ২৫ জন সাফাই সাক্ষীর তালিকা ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছিল আসামিপক্ষ। পরে নিজামীর ছেলেসহ চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন। গতকাল রায়ে আটটি অভিযোগ (নম্বর ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬) প্রমাণিত হয়। অন্য আটটি অভিযোগ (নম্বর ৫, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৫) প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে ওই সব অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীমের নেতৃত্বে তিন বিচারক রায় ঘোষণার জন্য গতকাল সকাল ১১টা ৫ মিনিটে এজলাসে আসন গ্রহণ করেন। এরপর রায় ঘোষণা শুরু করেন। ২০৪ পৃষ্ঠার এ রায়ের অভিযোগ ও আদেশের অংশ সংক্ষিপ্তভাবে পড়ে শোনান বিচারকরা। দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে রায় ঘোষণা শেষ হয়। এর আগে ১২টা ২০ মিনিটে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান। নিজামীকে ১০টা ৫০ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় নেওয়া হয়। কাঠগড়ায় বসেই তিনি পুরো রায় নিবিড়ভাবে শোনেন। এর আগে সকাল ৯টা ২০ মিনিটে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিয়ে রাখা হয়। রায় ঘোষণার পর তাঁকে আবার হাজতখানায় নিয়ে রাখা হয়। এর কিছুক্ষণ পর ট্রাইব্যুনালের অনুমতি নিয়ে হাজতখানায় প্রবেশ করেন নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন এবং আইনজীবী তাজুল ইসলাম। তাজুল ইসলামকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন নিজামী। তিনি তাজুল ইসলামের কপালে চুমু খান। প্রায় আধঘণ্টা ধরে তাঁরা শলাপরামর্শ করেন। একপর্যায়ে তাজুল ইসলাম বেরিয়ে গেলে নাজিব মোমেন বাসা থেকে আনা খাবার খেতে দেন তাঁর পিতাকে। খাওয়া শেষে বেরিয়ে যান নাজিব মোমেন। এ রায় ঘোষণা উপলক্ষে গতকাল সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনাল এলাকায় আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মানুষ ও সংবাদকর্মীরা ভিড় করেন। সকাল থেকে সেখানে কড়া নিরাপত্তা বসানো হয়। রায় শোনার জন্য গতকাল ট্রাইব্যুনাল কক্ষে যান সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিউকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম, মোহাম্মদ আলী, মোখলেসুর রহমান বাদল, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ও সুলতান মাহমুদসহ অন্য প্রসিকিউটররা। এ সময় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খানসহ অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। আসামিপক্ষে নজরুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, ফরিদউদ্দিন চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন মিঠুসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া নিজামীর চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে মেজ ছেলে নাজিব মোমেন উপস্থিত ছিলেন। যত অভিযোগ প্রমাণিত অভিযোগ নম্বর এক. পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে নির্যাতন চালানোর পর ১০ জুন তাঁকে ইছামতি নদীর পাড়ে অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগে নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দুই. একাত্তরের ১০ মে সকাল ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ী গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে বাউশগাড়ী ও ডেমরা গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ ব্যক্তিকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ করে রাজাকাররা। এই অভিযোগে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তিন. একাত্তরের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরে ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। নিজামী ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যেতেন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন। এটিতে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। চার. ২৪-২৫ এপ্রিল নিজামী পাবনার সাঁথিয়া থানার করমজা গ্রামে লোক জড়ো করে তাদের হুমকি দেন। এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় একই বছরের ৮ মে মেঘা ঠাকুরের বাড়িতে হামলা চালিয়ে মেঘা ঠাকুর, তাঁর স্ত্রী-সন্তানসহ আটজনকে হত্যা করা হয়। সেখানে বেশ কয়েকজন নারীকে ধর্ষণও করা হয়। ৪ নম্বর অভিযোগে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ছয়. একই বছরের ২৭ ও ২৮ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়া থানার ধুলাউড়ি গ্রামে ডা. আবদুল আওয়ালের বাড়ি ও আশপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় ৩০ জনকে। সেখান থেকে চারজনকে ধরে ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। সেখানে শাহজাহান আলীকে জবাই করে ফেলে যাওয়া হলে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। সাত. ৩ ডিসেম্বর বেড়া থানার বিশালিখা গ্রামে হামলা চালিয়ে সোহরাব আলীকে হত্যা করা হয়। সোহরাব আলীকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আট. ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট নিজামী নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে গিয়ে সেখানে আটক বদি, রুমী, জুয়েল, জালাল ও আজাদকে হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা দেন। এই অভিযোগে নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ষোল. একাত্তরে বিজয়ের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে বলে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিচারিক কার্যক্রম : ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর নিজামীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এতে হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ১৫টি অভিযোগ ছিল। ওই বছরের ১৫ মার্চ নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি হয়। নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ না থাকায় বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে ২০১২ সালের ২৮ মে ১৬টি অভিযোগে নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠনকালে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ যুক্ত করা হয়। নিজামীর বিরুদ্ধে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা, কয়েকজনকে ধর্ষণে সহযোগিতা করা, পাঁচটির বেশি গণহত্যাসহ ১৬টি অভিযোগে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ) এবং ৪(১) ও (২) ধারায় এ অভিযোগ গঠন করা হয়। এর মধ্যে ৪(১) ও ৪(২) ধারায় আনা হয় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগ। এরপর এ মামলায় ২০১২ সালের ২৬ আগস্ট থেকে গত বছরের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানসহ রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২৬ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। তবে সপ্তম সাক্ষী প্রদীপ কুমার দেবকে বৈরী ঘোষণা করে তাঁকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। নিজামীর পক্ষে তাঁর ছেলে ব্যারিস্টার মো. নাজিবুর রহমান ওরফে নাজিব মোমেনসহ চারজন সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন। উভয় পক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলে গত বছর ৩ নভেম্বর থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দিন রাষ্ট্রপক্ষকে এবং ৬, ৭, ১০ ও ১১ নভেম্বর মোট চার দিন আসামিপক্ষকে যুক্তি উপস্থাপনের সময় নির্ধারণ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। এ আদেশের পর রাষ্ট্রপক্ষ গত বছর ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত চার কার্যদিবস যুক্তি উপস্থাপন করে। ফলে আসামিপক্ষ ৭ নভেম্বর থেকে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করে। তারা এক দিন যুক্তি উপস্থাপনের পর ১০ নভেম্বর থেকে শুরু হয় টানা হরতাল। এ কারণে আসামিপক্ষের সিনিয়র আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালে যাননি। কয়েক দিন ধরে আসামিপক্ষে সিনিয়র আইনজীবীরা না যাওয়ায় ট্রাইব্যুনাল গত বছর ১৩ নভেম্বর এক আদেশে এ মামলায় যেকোনো দিন রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখার আদেশ দেন। কিন্তু হরতাল শেষে ১৪ নভেম্বর আসামিপক্ষ ওই আদেশ রিভিউ করার আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষকে পুনরায় যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ দেন। ১৭ নভেম্বর থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত টানা তিন দিন যুক্তি উপস্থাপন করে আসামিপক্ষ। ২০ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করে। এরপর ট্রাইব্যুনাল ওই দিনই মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। কিন্তু রায় দেওয়ার আগেই গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান অবসরে চলে যান। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পাওয়া নতুন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীম ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেন। সেদিনই নতুন করে যুক্তিতর্ক শোনার সিদ্ধান্ত নিয়ে যুক্তিতর্ক শোনেন তিনি। এরপর গত ২৪ মার্চ ট্রাইব্যুনাল এ মামলা সিএভি ঘোষণা করেন। গত ২৪ জুন নিজামীর বিরুদ্ধে মামলায় রায়ের জন্য দিন ধার্য ছিল। এ জন্য সব প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু নিজামীর অসুস্থতার কারণে রায় ঘোষণা না করে আবারও অপেক্ষমাণ রাখার আদেশ দেওয়া হয়। প্রায় চার মাস পর রায় ঘোষণা করা হলো। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এর পর থেকে তিনি কারাগারে আছেন। রাষ্ট্রপক্ষের মতে প্রত্যাশিত রায় : গতকাল এ রায়ের পর আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলীসহ রাষ্ট্রপক্ষ স্বাগত জানিয়ে বলেছে, প্রত্যাশিত রায় হয়েছে। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, এ রায় ন্যায়ভ্রষ্ট। তাঁরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানান। আইনমন্ত্রী গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই রায় একটি বড় প্রাপ্তি। ১৯৭১ সালে গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত কুখ্যাত নায়কদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হচ্ছে- এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। আজ (বুধবার) খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত।’ তিনি বলেন, এরপর আপিলের একটি বিষয় আছে। তবে রাষ্ট্রপক্ষের চেষ্টা থাকবে যেন আপিলে এই রায় বহাল থাকে। তিনি বলেন, ‘আমাদের আশা, দেখে যেতে পারব এই কুখ্যাত খুনিদের সাজা কার্যকর হয়েছে।’ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, ‘এই রায়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এটি একটি বড় বিজয়। একাত্তরে নিজামী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ও মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছে তার সঠিক সাজা সে পেল। আশা করি সরকার এই মৃত্যুদণ্ড যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর করবে।’ একই রকম মন্তব্য করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী। জামায়াতের বিচারে মডেল হিসেবে কাজ করবে : অন্য প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ বলেন, মতিউর রহমান নিজামীর মামলায় দেওয়া রায় অপরাধী সংগঠন জামায়াতকে বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে একটি ‘মডেল’ হিসেবে কাজ করবে। ১৯৭১ সালের বাস্তবতায় এ ধরনের সংগঠনের বিচারে সুবিধা হবে। গতকাল রায় ঘোষণার পর সাংবাদিকদের তুরিন অফরোজ বলেন, ‘এ রায়ে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো যে নিজামী ও তাঁর দোসররা ধর্মবেত্তা হিসেবে নিজেদের দাবি করেছেন। কিন্তু কোরআনের শিক্ষা, রাসুলের শিক্ষার বিরুদ্ধে তাঁরা কাজ করেছেন।’ ‘আনহ্যাপি জাজমেন্ট’ : রায়ের পর ট্রাইব্যুনাল চত্বরে নিজামীর আইনজীবী তাজুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা মোস্ট আনহ্যাপি জাজমেন্ট। আমরা এর বিরুদ্ধে আপিল করব।’ ‘ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো’ : সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘এই রায় প্রমাণ করল নিজামী বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক ছিলেন। তিনি আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। শুধু তাই নয়, মানবজাতির জন্য যুগান্তকারী রায় হয়ে থাকল এটি।’ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ বলেন, বাংলাদেশ এক নতুন জায়গায় এসে দাঁড়াল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিরাট অর্জন নিজামীর ফাঁসির রায়।
No comments:
Post a Comment