Saturday, July 12, 2014

ধর্ষক চিহ্নিত হলেও পুলিশ ধরছে না:যুগান্তর

রুম্মনের দোকান উত্তরা চার নম্বর সেক্টরের উত্তরা টাওয়ারের দোতলায়। নাম ‘এশিয়ান স্কাই শপ’। তরুণীর মা নুরুন্নাহার এ দোকানে পাতলা হওয়ার বিশেষ চা (স্লিমিং টি) ও শরীরচর্চার সরঞ্জাম কিনতে গেলে রুম্মনের সঙ্গে পরিচয়। এরপর রুম্মনের সঙ্গে মেয়েটির পরিবারের ঘনিষ্ঠতা বাড়লে সে মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তরুণীর সঙ্গে আংটি বদলও হয়। কিন্তু একপর্যায়ের মেয়ের পরিবার রুম্মনের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে অস্বীকার করে। এরপর ম
েয়ের অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়। বিষয়টি বরদাশত করল না রুম্মন। সে নেপথ্যে থেকে মেয়েটিকে অপহরণ করায়। রুম্মনের ৫ বন্ধু মেয়েটিকে বাসার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়। সুযোগ বুঝে গাড়ির মধ্যে অপহরণকারীদের একজন মেয়েটির ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। রাজধানীর উত্তরায় ৩ জুলাই মধ্যরাতে তরুণী অপহরণ ও নিরাপত্তাকর্মী খুনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনার এই অভিন্ন বর্ণনা পাওয়া গেছে অপহরণের শিকার ওই তরুণীর পরিবারের সদস্য ও পুলিশের কাছ থেকে। তরুণী নিজেও বলেছে, নেপথ্যে থেকে পুরো ঘটনা ঘটিয়েছে রুম্মন। মেয়েটির পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, ধর্ষক চিহ্নিত হওয়ার পরও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করছে না। তারা পুলিশের অবহেলা ও চরম দুর্ব্যবহারের শিকার হওয়ার অভিযোগও করেছেন। রিমান্ডে সবকিছু স্বীকার করার পরও এখন পর্যন্ত রুম্মনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড না করাও রহস্যজনক বলে মনে করে পরিবারের সদস্যরা। ওদিকে পুলিশ জানিয়েছে ঘটনার রাতেই ওই অপহরণকারীরা একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের একজর নারী সংবাদকর্মীকেও অপহরণ করেছিল। ওই নারী নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর তারা তাকে ছেড়ে দেয়। পুলিশ ওই নারী সংবাদকর্মীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। অপহরণের নেপথ্যে : গত বছর আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার পর মেয়েটির সঙ্গে পারিবারিকভাবে রুম্মনের আংটি বদল হয়ে যায়। বিয়ের দিনক্ষণও চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু মেয়েটির পরিবারের কাছে নানা মাধ্যমে খবর আসতে থাকে- ‘রুম্মন ভালো ছেলে নয়’। তার ভাই রুবেল মাদক ব্যবসায়ী এবং ইয়াবা আসক্ত। রুম্মনের আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল এমন খবরও আসে। রুম্মনের বয়স ৩৮ কিন্তু সে বয়স গোপন করে বলে ২৮ বছর। উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার না হয়েও বলে উত্তরা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। তাছাড়া রুম্মনের সঙ্গে নাতনির বিয়ে দিতে মোটেও রাজি হচ্ছিলেন না নানী সুফিয়া বেগম। ফলে প্রথমে রাজি থাকলেও একপর্যায়ে মেয়েটির মা রুম্মনের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে অস্বীকার করেন। অন্যত্র বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্র খুঁজতে থাকে মেয়ের পরিবার। মেয়েটি দেখতে সুশ্রী হওয়ায় অল্পদিনের মধ্যেই মেয়েটির কলেজেরই পূর্ব পরিচিত শিক্ষক মাহফুজ বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। মেয়ের পরিবার সম্মত হলে মাহফুজের সঙ্গে মেয়েটির আংটি বদল হয়। এ খবর জানার পর রুম্মন ক্ষুব্ধ হয়ে মেয়েটিকে অপহরণ করায় বলে অভিযোগ পরিবারের। যেভাবে অপহরণ : বিয়ে সামনে রেখে কেনাকাটা শুরু করে মেয়েটির পরিবার। ঘটনার দিনও সন্ধ্যার পর মা-মেয়ে কেনাকাটা করতে বের হন। রাতে তাদের সঙ্গে কেনাকাটায় যোগ দেন হবু জামাই মাহফুজ। মেয়ের মা নুরুন্নাহার যুগান্তরকে বলেন, ‘কেনাকাটা শেষে আমরা উত্তরার একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গেলাম। রাত সাড়ে দশটার সময় খাওয়া শেষ করে বাইরে বেরিয়ে দেখি প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে রিকশা পাওয়া যাচ্ছিল না। এ কারণে হেঁটেই আমরা বাসার কাছাকাছি চলে এলাম। চার নম্বর সেক্টরের তিন নম্বর গেটের কাছে আসতেই কয়েকজন যুবক আমাদের ওপর হামলা করল। একজন আমার মাথায় পিস্তল দিয়ে সজোরে আঘাত করল। আমি ছিটকে পাশের ড্রেনে পড়ে গেলাম। ওরা আমার মেয়েকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করতে লাগল। তখন মাহফুজ তাদের বাধা দিতে গেলে মাহফুজের হাতে চাপাতি দিয়ে কয়েকটি কোপ দিল।’ নুরুন্নাহার বলেন, ঘটনার সময় আশপাশে অনেকে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না। আমি বার বার বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করলাম। কিন্তু কারও সাহায্য পেলাম না। সন্ত্রাসীরা যখন আমার মেয়েকে গাড়িতে তুলে নিয়েছে ঠিক তখনই পাশের বাসার নিরাপত্তাকর্মী লিটন দৌড়ে এসে সন্ত্রাসীদের একজনকে ধরে ফেলে। তখন লিটনকে গুলি করে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। লিটন রাস্তায় পড়ে ছটফট করতে থাকে। কিন্তু তাকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। ঘটনাস্থলের পাশেই দু’জন পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকলেও তারা এগিয়ে আসেনি। নুরুন্নাহার বলেন, একমাত্র র‌্যাবের কর্মকর্তা কর্নেল আজাদ বিপদের সময় তার দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু র‌্যাবের সহায়তা নেয়ার কারণে উত্তরা পূর্ব থানার ওসি শাহদাত হোসেন ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বকাঝকা করেছেন। বলেছেন, থানায় না গিয়ে কেন তিনি র‌্যাবের কাছে গেলেন। নুরুন্নাহার বলেন, অথচ পুলিশ প্রথমে জিডি নিতেও চাইছিল না। র‌্যাবের ওই কর্মকর্তার সহায়তায় তিনি জিডি করতে সক্ষম হন। অপহরণের স্বীকার তরুণী যা বললেন : অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার ওই তরুণী বৃহস্পতিবার রাতে যুগান্তরের কাছে অপহরণ ও পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার দীর্ঘ বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, অপহরণের পর তাকে নিয়ে প্রথমে অপহরণকারীরা বিমানবন্দরের দিকে চলে যায়। বিমানবন্দর এলাকায় দু’জন গাড়ি থেকে নেমে যায়। সন্ত্রাসীরা রাস্তা থেকে কিছু খাবার কেনে। এরপর ফ্লাইওভারে উঠে ইউটার্ন নেয়। এরপর তার চোখ বেঁধে ফেলে সন্ত্রাসীরা। তরুণী বলেন, আমাকে ওরা জিজ্ঞেস করে ‘পোলাটা তোর কে হয়? তার সঙ্গে তোর প্রেম? ওকে বিয়ে করবি?’ আমি প্রাণ বাঁচানোর জন্য বলি, ‘না এমন কিছু নয়। সে আমার খালাত ভাই। বিয়ের কোনো ব্যাপার নেই।’ সন্ত্রাসীরা কথার ফাঁকে ফাঁকে তাকে চড় থাপ্পড় মারে। তরুণীটি বলেন, গাড়ির ভেতরে থাকা তিন সন্ত্রাসীর একজনকে তারা লম্বু বলে ডাকছিল। রুম্মনও তার এক বন্ধুকে লম্বু বলে ডাকত। কিন্তু তাকে তিনি কখনও দেখেননি। তাই এই লম্বুই সেই লম্বু কি না তা শনাক্ত করতে পারেননি। তরুণী বলেন, প্রায় দুই ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর একটা গ্রামের মতো জায়গায় গিয়ে গাড়িটি থামানো হয়। গাড়ির কাছে একটা লোক টর্চ লাইট হাতে এগিয়ে আসে। তাকে দেখে গাড়ি বাইরে থেকে লক করে তিনজন একটা বাড়ির ভেতরে ঢোকেন। সন্ত্রাসীদের একজন তাকে হুমকি দেন চিৎকার করলে মেরে ফেলা হবে। প্রায় আধাঘণ্টা পর তারা বাইরে বেরিয়ে আবার গাড়িতে চড়েন। বাড়ির ভেতর থেকে তাদের সঙ্গে তিনজন নারী ও এক যুবক বেরিয়ে আসেন। তারা সন্ত্রাসীদের সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে চলে যান। নির্যাতনের শিকার ওই তরুণী যুগান্তরকে বলেন, যে গাড়ি চালাচ্ছিল তার মোবাইলে একটা ফোন আসে। ফোনের নম্বরটি তিনি দেখার চেষ্টা করে শুধু শেষে দুটো অক্ষর (৪১) দেখতে পান। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘উত্তরা খুব গরম। প্রয়োজনে বিয়ে করে ফেল।’ এরপর চালকের আসনে বসা সন্ত্রাসী তাকে বলেন, ‘আমাকে বিয়ে করবি। তোকে ফ্ল্যাট দিব।’ তরুণী তাকে বলেন, আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন তখন দেখা যাবে। এরপর ওই সন্ত্রাসী তরুণীকে বলে ‘তুই কোন্ দলের সমর্থক? আর্জেন্টিনা না ব্রাজিল।’ তরুণী জানায়, সে ফুটবল বোঝে না। তখন তাকে ‘কেন ফুটবল বুঝিস না’ বলে আরেক দফা মারধর করা হয়। তার কান ও গলা থেকে গয়নাগুলো তারা খুলে নেয়। তরুণী বলেন, গাড়ির ভেতর থেকে তিনি বাইরের স্থানটা বোঝার চেষ্টা করেন। একটা দোকানের সাইনবোর্ডে ‘জামালপুর, কালিগঞ্জ’ লেখা দেখে তিনি বুঝতে পারেন তাকে জামালপুরে নিয়ে আসা হয়েছে। তরুণী বলেন, সন্ত্রাসীরা এলোমেলো কথাবার্তা বলতে থাকে। একজন বলে, তুই জায়গা চিনে রাখছিস? আমাদেরকে পুলিশে দিবি! মনে রাখিস পুলিশে দিলে দু-দিনেই জামিনে বেরিয়ে আসব। তারপর তোরা কিভাবে বেঁচে থাকিস তা দেখব। অপহৃত মেয়েটিকে কি করা হবে এ নিয়ে সন্ত্রাসীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। একজন বলে, ‘ওকে মেরে ফেলি।’ আরেকজন বলে ‘চল ওকে একটা সিএনজিতে তুলে দিয়ে পালিয়ে যাই।’ একপর্যায়ে তারা শেষরাতের দিকে মেয়েটিকে বাসার কাছে নামিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। ‘গাড়ির জাদুকর’ : তরুণীটি যুগান্তরকে বলেন, রুম্মনের সঙ্গে আংটি বদলের দিন পরিবারের সবাই চলে গেলেও রুম্মন তার ভাই রুবেল ও রুবেলের বন্ধু সোহাগ বাসায় অনেক রাত পর্যন্ত থেকে যায়। অনেক রাতে তারা বাসায় ফেরার জন্য সোহাগের এক বন্ধুকে গাড়ি নিয়ে আসার জন্য ফোন করে। সোহাগ ও রুম্মান তাকে বলে, যে বন্ধু গাড়ি নিয়ে আসছে সে ‘গাড়ির জাদুকর’। একহাতে সে ভয়ংকর গতিতে গাড়ি চালাতে পারে। তরুণী বলেন, তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময়ে চালকের আসনে বসে থাকা সন্ত্রাসীও ভয়ংকর দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল। এ সময় বার বার বলছিল ‘সে হল গাড়ির জাদুকর। একহাতে সে দারুণ গাড়ি চালাতে পারে।’ একপর্যায়ে গাড়ির চালকই তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। তরুণী বলেন, এসব কথা পুলিশকে বলা হয়েছে। রুম্মনের ভাই রুবেলকে পুলিশ গ্রেফতারও করে। কিন্তু রুবেল ও তার বন্ধু সোহাগের পরিচিত ওই ‘গাড়ির জাদুকর’কে শনাক্ত করার চেষ্টা করেনি। উপরন্তু পুলিশ রুবেলকেও ছেড়ে দিয়েছে। তরুণী বলেন, অপহরণকারী ৫ সন্ত্রাসীর একজন মুখোশ পরা ছিল। বাকি চার জনকে তিনি দেখলে চিনতে পারবেন। ‘পরিবার তছনছ’ : বৃহস্পতিবার রাতে মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাদের বাসায় গেলে বাসার নিরাপত্তাকর্মী জানান ঘটনার পর থেকে গেট খুলতে তিনি ভয় পাচ্ছেন। অপরিচিত লোক দেখলে তিনি গেট খুলছেন না। মেয়ের মা নুরুন্নাহার যুগান্তরকে বলেন, তার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। পরিবার তছনছ হয়ে গেছে। এখন বেঁচে থাকা নিয়েও তারা সংশয়ে আছেন। তিনি বলেন, তাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। বাড়ি থেকে বেরও হতে পারছেন না। সব সময় তাদের মনে হচ্ছে যে কোনো সময় তাদেরকে হত্যা করা হতে পারে। পুলিশের বক্তব্য : পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ নির্যাতনের শিকার পরিবারের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করছে পুলিশ। পরিবারের চরিত্র হনন করে কটাক্ষ করছে থানার ওসি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা। এমনকি গ্রেফতারকৃত প্রধান সন্দেহভাজন রুম্মনের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে ঘটনা ভিন্ন দিকে নেয়ার চেষ্টা করছে পুলিশ- এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই এখনও রুম্মনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করছে না পুলিশ। এছাড়া রুম্মনের সঙ্গে সমঝোতা করে তার ভাই রুবেলকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ নির্যাতনের শিকার ওই মেয়েটির পরিবারের। এসব অভিযোগের বিষয়ে শুক্রবার যোগাযোগ করা হলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পূর্ব থানার এসআই মহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অভিযোগ মোটেও সঠিক নয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে পুলিশ। রুম্মনের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার প্রশ্নই আসে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। রিমান্ডে রুম্মনের কাছ থেকে কি ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, মামলা এখনও তদন্তাধীন। ঘটনার সঙ্গে রুম্মন একাই জড়িত কি না তা বলার সময় এখনও আসেনি। এই ঘটনার পেছনে অন্য কারও হাতও থাকতে পারে।  

No comments:

Post a Comment