১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি জাতিকে নির্মূল ও ধ্বংস করার লক্ষ্যে মতিউর রহমান নিজামী ইসলামিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও মহান আল্লাহর নাম এবং পবিত্র ধর্ম ইসলামকে জেনেশুনে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপব্যবহার করেছিলেন। জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল বুধবার এ অভিমত ব্যক্ত করেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ের ১৬০ থেকে
১৭৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ১৫ পৃষ্ঠাজুড়ে ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার’ শিরোনামে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। পূর্ণাঙ্গ রায়ের ১৬১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, একাত্তরের ৫ আগস্ট দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় নিজামীর একটি বক্তব্য প্রকাশিত হয়। তাতে নিজামী বলেন, ‘পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। আল্লাহ একে বারবার রক্ষা করেছেন। ভবিষ্যতেও রক্ষা করবেন। দুনিয়ার কোনো শক্তি পাকিস্তানকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না।’ ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, নিজামীর এ বক্তব্য স্পষ্টতই সূরা হজের ২৬ নম্বর আয়াতের বিকৃতি। কারণ, এই সূরায় একমাত্র কাবাঘরকে আল্লাহর ঘর বলা হয়েছে। কিন্তু নিজামী পাকিস্তানকে আল্লাহর ঘরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। নিজামী তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাদের ভুল বুঝিয়েছিলেন। তিনি আসলে চেয়েছিলেন, ছাত্র সংঘের তরুণেরা অন্ধভাবে যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের ইসলামের শত্রু মনে করেন। জামায়াতের তখনকার আমির গোলাম আযমও (সদ্য প্রয়াত) একইভাবে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করে বক্তব্য দিতেন। রায়ে আরও বলা হয়, ১৪০০ বছর আগে হজরত মুহাম্মদ (সা.) মুসলিম ও অমুসলিমদের একসঙ্গে বসবাসের চুক্তি করেন এবং একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি মদিনা সনদ নামে পরিচিত এবং এটি দুনিয়ার প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দুদের শত্রু বলে প্রচারণা চালিয়ে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়েছে, হত্যা করেছে। অথচ ইসলামেই ভিন্নধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মাওলানা আকরম খাঁর মোস্তফা চরিত বই থেকে উদ্ধৃত করে ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, ‘মদিনা সনদে বলা হয়েছে, পরস্পর বিপরীত চিন্তা, রুচি ও ধর্মভাবসম্পন্ন ইহুদি, পৌত্তলিক ও মুসলমানদের দেশের সাধারণ স্বার্থ রক্ষা ও মঙ্গল বিধানের জন্য একই কর্মকেন্দ্রে সমবেত করতে হবে। তাদের একটি রাজনৈতিক জাতি বা কওমে পরিণত করতে হবে। তাদের শেখাতে হবে যে এক দেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়গুলো নিজেদের ধর্মগত স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণ রক্ষা করেও দেশের সেবায় একত্রে সমবেত হতে পারে এবং এমন হওয়াই কর্তব্য।’ ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘মদিনা সনদ অনুসারে রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ সমাজেরই একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী রয়েছে, যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্মের মূল বাণীর অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মভীরু মুসলমানদের বড় অংশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।’ রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে নিজামী ইসলাম ধর্ম নিয়ে লেখাপড়া করেছেন। তিনি অনেক ইসলামি বই লিখেছেন। রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্ম বনাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বইয়ে নিজামী লিখেছেন, ‘আল্লাহ সব মানুষের স্রষ্টা। এর পরেও কেউ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে কি আনবে না—এই ব্যাপারে তিনি স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং ঈমান আনার ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ ও জবরদস্তিকে নিষেধ করেছেন।’ মদিনা সনদের ওপর ভিত্তি করে নিজের জীবনে এমন বই লেখার পরও মুক্তিযুদ্ধকালে নিজামীর ভূমিকা ছিল পুরোপুরি বিপরীত। রায়ে আরও বলা হয়, দেশের অনেক ইসলামি পণ্ডিত ও আলেম মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেছেন। বায়তুল মোকাররমের সাবেক খতিব উবায়দুল হক বলেছেন, ‘মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের কোনো জিহাদ হতে পারে না। বরং এটা গুপ্তহত্যা, মানবতাবিরোধী কাজ। ইসলাম মানবতাবিরোধী কাজ কখনো সমর্থন করে না।’ মাওলানা ফজলুল হক আমিনী ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে বলেছেন, ‘এটা ছিল জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ। ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। যারা একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলেছিল, তারা ভুল বলেছিল। জামায়াতের বিরোধিতা মানে ইসলামের বিরোধিতা এটাও ঠিক নয়।’ মাওলানা ইসহাক ওবায়দি বলেন, ‘১৯৭১ সালে জামায়াত স্বাধীনতাযুদ্ধকে ইসলাম এবং কুফরের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে উপস্থাপন করে। কিন্তু রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেই কোনো মুসলমানকে, সে আওয়ামী লীগ বা কমিউনিস্ট পার্টির লোকই হোক—কাফের ভাবা ঠিক নয়। একাত্তর সালে জামায়াতের কিছু নেতার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, ইসলামের দৃষ্টিতে এসব অবশ্যই নাজায়েজ।’ ট্রাইব্যুনাল মত দেন, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ, আলবদর ও রাজাকার বাহিনী হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন, লুণ্ঠনসহ যেসব অমানবিক অপরাধ করেছে, সেগুলো পবিত্র কোরআন ও হাদিস অনুমোদন করে না। আসামিপক্ষ দাবি করেছে, নিজামী একজন সুপরিচিত ইসলামিক পণ্ডিত। কিন্তু ঘাতক আলবদর বাহিনী গঠন ও একে নেতৃত্ব, সমর্থন ও উৎসাহ দিয়ে আসামি নিজামী পবিত্র কোরআনের নিষেধাজ্ঞা এবং রাসুলের অনুশাসন ভঙ্গ করেছেন। তিনি বাঙালি ও বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য আলবদর ও ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের উৎসাহ ও সমর্থন দিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment