ভবনের নকশা অনুমোদন কার্যক্রম কারিগরি বিষয় হলেও রাজউকের ২৬টি ইমারত নির্মাণ কমিটির ২৫টিরই সভাপতি করা হয়েছে এমন ব্যক্তিদের, যাঁরা কারিগরি বিশেষজ্ঞ নন, প্রশাসনিক আমলা। নিয়ম অনুযায়ী কমিটির প্রধান ব্যক্তিকে হতে হয় প্রকৌশলী, স্থপতি বা পরিকল্পনাবিদ। কারণ, স্থাপত্য নকশা ও মাটি পরীক্ষা প্রতিবেদন দেখেই কমিটির প্রধানকে সিদ্ধান্ত দিতে হয়। এ ছাড়া ভবনের কোনো ক্ষতি হলে তার কারণ নির্ণয় করে তাৎক্ষণিক কারিগর
ি সিদ্ধান্ত দেওয়াও কমিটির প্রধানের কাজ। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত ১৪ এপ্রিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অধীন আটটি আঞ্চলিক কার্যালয়ের ২৪টি এবং প্রধান কার্যালয়ের দুটি—মোট ২৬টি ইমারত নির্মাণ কমিটি (বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন—বিসি কমিটি) গঠন করা হয়। আগে এ ধরনের আটটি কমিটি ছিল। কারিগরি বিশেষজ্ঞরাই এগুলোর প্রধান ছিলেন। এখন ২৪টি কমিটি আটতলা পর্যন্ত ভবনের নকশা অনুমোদন করতে পারে। অন্য দুই কমিটি নয়তলা থেকে সর্বোচ্চ তলার অনুমোদন দিতে পারে। এই ২৬ কমিটির দুটির দায়িত্ব নয়তলার ওপরের নকশা অনুমোদনের। এর একটির সভাপতি করা হয়েছে একজন প্রকৌশলী কর্মকর্তাকে। তিনি রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা)। অপর কমিটির প্রধান কারিগরি বিশেষজ্ঞ নন, সরকারের যুগ্ম সচিব। নকশা অনুমোদন ও বসবাস (ব্যবহার) সনদপত্র দেওয়ার দায়িত্ব তাঁর। এটি অনুচিত বলে অভিমত দিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) ও স্থাপত্য ইনস্টিটিউটের নেতারা। আইইবির সহসভাপতি মেজবাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভবনের নকশা অনুমোদন, ভবন নির্মাণ, ভবন নির্মাণের মান নিয়ন্ত্রণ এবং পুরোনো ভবনের অবস্থা বিশ্লেষণ করে এর পরিপ্রেক্ষিতে কী করণীয়, সেটা পর্যবেক্ষণ করে মতামত দেওয়ার কাজগুলো পুরোপুরি প্রকৌশলগত। তাই এখানে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই যথাযথ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া উচিত। স্থাপত্য ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, নকশা অনুমোদন করার আগে অনুসন্ধান ও নিয়ন্ত্রণের যে কাজগুলো করতে হয়, অকারিগরি পেশার কারও পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। শুধু জমির দাগ দেখার জন্য তিনি কাজ করতে পারেন। অকারিগরি পেশার ব্যক্তিকে দিয়ে নকশা অনুমোদনের কাজ করানোর অর্থ হচ্ছে, চিকিৎসাবিদ্যায় পাঠ না করে চিকিৎসকের আসনে বসা। রাজউকের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে স্বীকার করেন যে বিসি কমিটির সভাপতি কারিগরি পেশাদার হলে ভালো, এতে কাজে সুবিধা হয়। স্থাপত্য নকশা, মাটি পরীক্ষা প্রতিবেদন দেখে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় বিসি কমিটি। এটা করতে হয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও জাতীয় বিল্ডিং বিধির (বিএনবিসি) আলোকে সবকিছু বিশ্লেষণ করে। ২৪টি কমিটির সভাপতি করা হয়েছে রাজউকের আটটি অঞ্চলের পরিচালকদের, যাঁরা কারিগরি বিশেষজ্ঞ নন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ রাজউকের প্রশাসন, অর্থ, ভূমি ও সম্পত্তি শাখায় কর্মরত ছিলেন। তাঁদের এসব শাখাতেই পরিচালক হিসেবে পদায়নের সুযোগ ছিল। উপসচিব পদমর্যাদায় দায়িত্ব না দিয়ে করা হয়েছে আঞ্চলিক পরিচালক। প্রতিটি বিসি কমিটিতে মোট পাঁচজন সদস্যের মধ্যে সভাপতি ছাড়াও স্থাপত্য অধিদপ্তরের স্থপতি, গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকৌশলী ও রাজউকের দুজন প্রকৌশলী রয়েছেন। তবে কয়েকজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, সব ক্ষেত্রে তাঁদের মতামত অনুযায়ী নকশা অনুমোদন হয় না। সভাপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। বিসি কমিটির একাধিক সভাপতি নকশায় স্বাক্ষরের জন্য ভবনের তলাভেদে তাঁদের নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ সংগ্রহেরও অলিখিত নির্দেশনা জারি করেন। গত ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার আগে এ ধরনের নির্দেশনা বেশি এসেছে। এতে ভবনের নকশা অনুমোদনের আবেদনকারীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তবে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) আবদুল হাইয়ের মতে, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ বিভাগে এবং বিসি কমিটিতে অকারিগরি লোক থাকলে কোনো সমস্যা নেই। তাঁর যুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব তো টেকনিক্যাল নন। স্বাস্থ্যসচিব চিকিৎসক নন, কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ নন। আসলে প্রশাসনিক লোক সব জায়গাতেই কাজ করতে পারেন। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আমার যদি অসুখ হয়, আমি আগে বুঝব, না ডাক্তার আগে বুঝবেন?’ রাজউকের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া বলেন, তিনি নিজেও উন্নয়ন বিভাগের সদস্য থাকাকালীন একটি কমিটির সভাপতি ছিলেন এবং প্রকৌশলী হওয়ায় বাস্তব কাজে সুবিধা হয়েছে। চেয়ারম্যান বলেন, তার পরও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করলেও কাজ করা যায়। সব বিসি কমিটিতে স্থপতি, প্রকৌশলীরা থাকায় সভাপতিকে তাঁরা সাহায্য করতে পারেন। তবে খুব দ্রুত না হলেও আস্তে আস্তে সঠিক লোককে সঠিক দায়িত্ব দেওয়া হবে।
No comments:
Post a Comment