চোখের জলে ভেসে আর বুকের কষ্ট চাপা দিয়ে সহায়-সম্পত্তি ফেলে শুধু প্রাণটুকু সম্বল করে যাঁরা দেশ ছেড়েছিলেন, তাঁদের উত্তরাধ
িকারীর কাছে সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারের এ প্রগতিশীল ভাবনায় যোগ্য সঙ্গী হতে বা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি প্রশাসন। তাদের গড়িমসিতে সরকারের এই ‘সময়ভিত্তিক কর্মসূচিটাই’ পণ্ড হওয়ার মুখে। পরিধি ছোট না হয়ে দিন দিনই বড় হচ্ছে সমস্যাটি। সংকট জিইয়ে রাখার কৌশল হিসেবে বারবার আইনটি সংশোধন করা হয়েছে। তিন বছরের মধ্যে ষষ্ঠবারের মতো গতকাল সোমবার আইনটি আবারও সংশোধনের জন্য উপস্থাপন করা হলে তাতে আপত্তি জানায় মন্ত্রিসভা। এ অবস্থায় সংশোধনকে বড় করে না দেখে সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের কার্যকর উপায় খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়কে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সচিবালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি মালিক বা তাঁদের উত্তরাধিকারীদের ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ২০০১ সালের ১১ এপ্রিল ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১’ জারি করা হয়। ক্ষমতার পালাবদল হলে রাজনৈতিক বিবেচনায় আইনটি অকার্যকর করে রাখে চারদলীয় জোট সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ফের ক্ষমতায় এসে ২০১১ সালে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্পিত সম্পত্তির সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলার জন্য আইনটিতে বড় ধরনের সংশোধন করে আওয়ামী লীগ সরকার। সেই সংশোধনীতে ১২০ দিনের মধ্যে সরকারের দখলে থাকা অর্পিত সম্পত্তি সঠিক মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তালিকা তৈরির কাজই শেষ করতে পারেনি প্রশাসন। অথচ এ তালিকা তৈরি থাকার কথা ছিল। কারণ এসব সম্পত্তি সরকার বিভিন্নজনকে লিজ দিয়েছে। এরপর সমস্যাগুলোকে দীর্ঘায়িত করে ২০১২ সালে দুই দফা ও ২০১৩ সালে আরো দুই দফায় সংশোধনী আনা হয়। প্রতিবারই আইনের সংশোধনীতে সময় নির্ধারণ করে দিয়ে তার মধ্যেই সমস্যার সমাধানের কথা বলা হয়। এ অবস্থায় গতকাল মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০১৪’ উপস্থাপন করা হয়। আলোচ্যসূচিতে অর্পিত সম্পত্তির এজেন্ডা দেখে মন্ত্রিসভার অনেকেই বিস্মিত হন। বিরক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী একপর্যায়ে জানতে চান, আর কত সংশোধন হবে অর্পিত সম্পত্তি আইন? তখন মন্ত্রীরা তাঁদের বিস্ময়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে জানান, যে সমস্যা সমাধানের জন্য আইনটি করা হয়েছিল তারই সমাধান হয়নি। কৃত্রিমভাবে সমস্যা আরো বাড়ানো হচ্ছে। আইনটির বারবার সংশোধনীতে সমস্যা জিইয়ে রাখা হচ্ছে। তখন প্রধানমন্ত্রী আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে জানতে চান, আইনটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের আগে কি আপনার সঙ্গে পরামর্শ করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়? না, সোজা জবাব আইনমন্ত্রীর। এ সময় অন্যান্য মন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে তাঁদের নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথা জানান প্রধানমন্ত্রীকে। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী আইনটি ফেরত পাঠান এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে দ্রুত সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দেন। মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে একজন সিনিয়র মন্ত্রী কালের কণ্ঠকে এ ঘটনা জানান। তিনি বলেন, ২০১১ সালে যখন আইনটির ব্যাপক সংশোধন করা হয় তখন সরকারের দখলে থাকা ‘ক তফসিলের’ সম্পত্তি ছিল এক লাখ ৮৯ হাজার একর। অথচ সেটা বেড়ে এখন সোয়া দুই লাখ একরে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে সরকারের দখলে নেই যেসব সম্পত্তি অর্থাৎ ‘খ তফসিলের’ সম্পত্তিও বেড়ে গেছে। ‘খ তফসিলের’ সম্পত্তি ছিল চার লাখ ৪২ হাজার একর, যা এখন সাত লাখ একরের কাছাকাছি। কিভাবে এসব সম্পতি বাড়ল জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, সরকারের দখলে থাকা সম্পত্তি বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ ‘ক তফসিল’ হচ্ছে সরকারের নিয়ন্ত্রণে, যা রয়েছে সেসব সম্পত্তি। এসব সম্পত্তি বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ দেওয়া আছে। সেই সম্পত্তি বৃদ্ধি পেল কিভাবে তা বোধগম্য নয়। আর বেসরকারি অর্পিত সম্পত্তির তালিকা দীর্ঘ করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার জন্য। কারণ অর্পিত সম্পত্তি কোনগুলো তার সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই। তহসিল অফিসের সংরক্ষিত জমির ডকুমেন্টের কোনায় কেউ হয়তো ভিপি (ভেস্টেট প্রপার্টি বা অর্পিত সম্পত্তি) লিখে রাখল, একসময় সেটিই অর্পিত সম্পত্তি হয়ে গেল। কে ভিপি লিখল, কেন লিখল, কিভাবে লিখল, সে তথ্য কে খুঁজবে? কিন্তু যে ব্যক্তিটির জমি অর্পিত সম্পত্তির কথিত তালিকায় উঠে গেল তাঁর হয়রানির শেষ নেই। তিনি এসব জমির খাজনা দিতে পারেন না, বিক্রিও করতে পারেন না। তিনি আরো বলেন, অর্পিত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত প্রগতিশীল চিন্তার ফসল। সরকার যে চিন্তা থেকে এ আইনটি করেছে আমলারা তার গুরুত্বই বুঝতে পারেননি। অথচ আইনটি বাস্তবায়ন করবেন তাঁরাই। এ ক্ষেত্রে তাঁরা যে শুধু অদক্ষতারই পরিচয় দিয়েছেন তাই নয়, তাঁরা অর্পিত সম্পত্তির তালিকা তৈরিতে গড়িমসি করেছেন, কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে নিরীহ মানুষের সাধারণ সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আমলারাই প্রথম আইনের খসড়া তৈরি করেন। তাঁরা আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যে সমস্যা হয় তার আলোকে সংশোধনী আনার প্রস্তাব দেন। একটা আইন কিভাবে তাঁরা তিন বছরের মধ্যে ছয়বার সংশোধন করতে বলতে পারেন? তাঁদের দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে বলেই আইনটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। ৪৪ জন জেলা প্রশাসক (ডিসি) সময় আরো বাড়ানোর জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছেন। এসবই অদক্ষ প্রশাসনের আলামত। যত ভালো কাজই করা হোক না কেন, দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়তে না পারলে সরকারের আধুনিক চিন্তাভাবনা কোনো কাজে আসবে না। ওই মন্ত্রী আরো বলেন, আইনটি সংশোধনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় যে প্রস্তাব দিয়েছে সেখানেও কর্মকর্তাদের অদক্ষতার ইঙ্গিত রয়েছে। তাঁদের পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়েছে, “স্বল্প সময়ের মধ্যে এ বিশাল কাজ করতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে ভুলসহ কোনো কোনো জেলায় কিছু কিছু সম্পত্তি ‘ক তফসিল’ থেকে বাদ পড়ে। বিষয়টি নজরে আসার পর ‘ক তফসিলের’ বাদ পড়া ও সংশোধনী তালিকা প্রকাশের সময়সীমা বৃদ্ধি করে আইনে সংশোধনী আনা হয়। উক্ত বর্ধিত সময়সীমার মধ্যে অধিকাংশ বাদপড়া ও সংশোধনী তালিকা বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু সংশোধিত সময়সীমা উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরেও কিছু কিছু জেলায় এখনো কিছু বাদপড়া ও সংশোধনী তালিকা গেজেটে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি মর্মে জেলা প্রশাসকগণের নিকট হতে জানা গিয়েছে।’’ ভূমি মন্ত্রণালয়ের এ প্রস্তাব উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, যেসব কর্মকর্তা ভুল করেছেন, তাঁদের কি বিচার হয়েছে? সংশোধিত সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও কাদের অবহেলায় গেজেট প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি সেটা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এসব তথ্য উল্লেখ করে মন্ত্রিসভায় প্রস্তাব পাঠানো বাংলাদেশেই সম্ভব। অন্য কোনো দেশ হলে যাঁরা ভুল করেছেন আগে তাঁদের আইনের আওতায় আনা হতো। ভূমি সংস্কার বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘ক’ তফসিলের বাদপড়া ও সংশোধনী তালিকা প্রকাশের সময়সীমা আবারও বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে অর্পিত সম্পতি ফিরে পাওয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করার সময় গত ৩১ ডিসেম্বর পার হয়ে গেছে। অনেকেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন করতে পারেনি বলে ভূমি মন্ত্রণালয় অবগত হয়েছে। এ জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদনের সময়ও বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। আপিল ট্রাইব্যুনালে আবেদন করার সময়ও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে সংশোধনীতে। এ ছাড়া বিভাগীয় সদরে বিশেষ আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করার সুযোগ দিয়ে নতুন ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার ২০১১ সালে যখন আইনটি সংশোধন করে, তখন ‘ক’ তফসিলের বিধান ছিল। যেসব অর্পিত সম্পত্তি সরকারের দখলে ছিল না সেগুলো ছিল ‘খ’ তফসিলভুক্ত। কিন্তু ২০১৩ সালে এসে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ‘খ’ তফসিল বাদ দেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্ত সংসদে পাস হওয়ার পরও তা কার্যকর করতে গড়িমসি করে ভূমিসংক্রান্ত অফিসগুলো। এই তফসিলের সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি মুক্ত হওয়ার পর নামজারিতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু ভূমি অফিস সাধারণ মানুষের নামে নামজারি করেনি। কেন করেনি তার ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে নতুন সংশোধনী প্রস্তাবে। সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার অভিজিৎ ভট্টাচার্য গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, “আমার পাঁচ বিঘা সম্পত্তি ‘খ’ তফসিলভুক্ত ছিল। আইনের সংশোধনীর মাধ্যমে পুরো ‘খ’ তফসিলকে অর্পিত সম্পত্তি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সংসদে আইনটি সংশোধনী করার পর আমি আমার জমির মালিকানাসংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে ভূমি অফিসে যাই। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আমাকে ঘুরাচ্ছে। এটা-সেটা বলে আমাকে নামজারি করে দিচ্ছে না। তাহলে ‘খ’ তফসিল বাদ দিয়ে কী লাভ হলো?” ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ভারত যুদ্ধের পর ‘ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস, ১৯৬৫’ অনুসারে ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যেসব নাগরিক পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে যান, তাঁদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি শত্রু সম্পতি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে শত্রু সম্পত্তির নাম অর্পিত সম্পত্তি রাখা হয়। সেসব সম্পত্তি বৈধ উত্তরাধিকারীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন করা হয়। পরে ক্ষমতায় এসে তা অকার্যকর করে দেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। মহাজোট সরকার নতুন করে এ আইনটি কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়। কার্যকর করতে গিয়ে দফায় দফায় আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment