ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এবার এসএসসির ফরম পূরণের ফি নির্ধারণ করেছে সর্বোচ্চ এক হাজার ৪০০ টাকা। কিন্তু অভিভাবকদের গুনতে হচ্ছে
স্কুলভেদে পাঁচ হাজার থেকে ১১ হাজার টাকা পর্যন্ত। ফরম পূরণের সঙ্গে কোচিং ফি, মডেল টেস্ট ফি, বার্ষিক চার্জ, পরিবহন, তিন মাসের বেতন, পিকনিক ইত্যাদি খাত দেখিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ এই মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছে। অধিকাংশ স্কুলই আগামী দুই মাসের জন্য সব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বাধ্যতামূলক কোচিং ও মডেল টেস্ট ফি নিচ্ছে। স্কুলভেদে এই ফি দেড় হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকার মতো। রাজধানীর বেসরকারি স্কুলগুলো নির্ধারিত ফিয়ের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ অর্থ আদায় করলেও বরাবরের মতো এবারও নিশ্চুপ রয়েছে ঢাকা বোর্ড। তাই অভিভাবকরা নিরুপায় হয়েই স্কুল নির্ধারিত ফি দিতে বাধ্য হচ্ছেন। গত রবিবার মাহফুজা আক্তার নামের এক অভিভাবক অতিরিক্ত ফি আদায়ের লিখিত অভিযোগ করেন ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর। রাজধানীর দক্ষিণখান ইউনিয়নের ফায়দাবাদের দ্য চাইল্ড ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে মাহফুজা আক্তারের মেয়ে ফাতেমা বেগম। ফরম পূরণের ফি বাবদ ১১ হাজার টাকা না দিলে তাঁর মেয়েকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে না বলে স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আতিক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দপ্তরে বসেই কথা হয় মাহফুজা আক্তারের সঙ্গে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার পক্ষে মেয়ের ফরম পূরণের জন্য এত টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়েই এখানে অভিযোগ জানাতে এসেছি। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা ধরে বসে রয়েছি, কারো সাক্ষাৎই পাচ্ছি না। পরে একজনের পরামর্শে লিখিত অভিযোগ জানিয়ে গেলাম। দেখি কিছু হয় কি না।’ বিভিন্ন স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণখান ইউনিয়নের ফায়দাবাদের দ্য চাইল্ড ল্যাবরেটরি স্কুলে ১১ হাজার টাকা, মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৯ হাজার ৩৩৫, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সাড়ে চার হাজার, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে চার হাজার ৭৯০, রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে ছয় হাজার ৬৫২, রামপুরা একরামুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে ছয় হাজার ৫০০, মগবাজার নজরুল শিক্ষালয়ে আট হাজার, বাসাবোর কদমতলা স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৯ হাজার, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পাঁচ হাজার, খিলগাঁও ন্যাশনাল আইডিয়াল হাই স্কুলে পাঁচ হাজার ৯০০, সদরঘাটের পোগোজ স্কুলে ছয় হাজার, হাটখোলার মিতালী বিদ্যাপীঠে সাড়ে ছয় হাজার, মিরপুর জান্নাত একাডেমি হাই স্কুলে সাত হাজার ৭০০, মিরপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে আট হাজার, মিরপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে ছয় হাজার ৭০০, মিরপুর বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজে সাড়ে ছয় হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ বলেন, ‘প্রতিবছরই ফরম পূরণে বেশি ফি নেওয়ার কথা আমরা শুনতে পাই। কিন্তু আমাদের এমন কোনো লোকবল নেই, যাদের দিয়ে সব স্কুল মনিটরিং করব। অভিভাবকরা যদি লিখিত অভিযোগ করেন, তাহলে তা আমরা খতিয়ে দেখতে পারি। তবে ফি নির্ধারণের আগে আমরা স্কুলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নিই। তখন একমত হলেও পরে অধিকাংশ স্কুল ঠিকই বেশি নেয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগে এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। সাধারণত দেখা যায়, বেসরকারি স্কুলগুলোই টাকা বেশি নেয়। তারা এমপিওভুক্ত না হওয়ায় অনেক সময় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। মনিটরিংয়ের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এবং বোর্ডগুলো মিলে একটি কমিটি থাকলে তারা সমন্বিতভাবে এ বিষয়ে কাজ করতে পারে। এককভাবে এসব অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করাটা দুরূহ ব্যাপার।’ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তথ্য মতে, ২০১৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নির্বাচনী পরীক্ষার ফল ৬ নভেম্বরের মধ্যে প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। এই ফল প্রকাশের পর থেকে ১৯ নভেম্বরের মধ্যে বিলম্ব ফি ছাড়া পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণ করে নির্ধারিত ফি বোর্ডে জমা দিতে হবে। আর প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর জন্য ১০০ টাকা বিলম্ব ফিসহ ফরম পূরণের ফি জমা দেওয়ার শেষ সময় ২৫ নভেম্বর। নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফি প্রতি পত্র ৬৫ টাকা, ব্যবহারিক পরীক্ষার ফি ৩০, একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট ফি ৩৫, মূল সনদ ফি ১০০, বয়েজ স্কাউট ও গার্ল গাইডস ফি ১৫, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ফি পাঁচ টাকা করে বোর্ড থেকে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর সঙ্গে যাদের ব্যবহারিক পরীক্ষা নেই তাদের ক্ষেত্রে ২৫০ এবং যাদের ব্যবহারিক পরীক্ষা আছে তাদের ৩০০ টাকা কেন্দ্র ফি দিতে হবে। অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের এসব ফিয়ের সঙ্গে বাড়তি আরো ১০০ টাকা দিতে হবে। সেই হিসাবে একজন পরীক্ষার্থীর সর্বোচ্চ এক হাজার ৪০০ টাকা ফরম পূরণের ফি দেওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে কয়েক গুণ বেশি ফি নিচ্ছে স্কুলগুলো। জানতে চাইলে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর দিলারা হাফিজ কালের কণ্ঠকে বলেন, “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সাধারণত ফি বাবদ সর্বোচ্চ এক হাজার ৪০০ টাকা বোর্ডকে পরিশোধ করতে বলা হয়ে থাকে। তবে স্কুলগুলো অবকাঠামো, বার্ষিক চার্জ, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতের জন্য নির্ধারিত ফিয়ের বাইরে কিছুটা বেশি ফি আদায় করতে পারে। তাই বলে নানা খাত দেখিয়ে ‘কয়েক গুণ’ টাকা আদায় করা বোর্ডের নীতিমালা লঙ্ঘন। অভিভাবকদের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” দ্য চাইল্ড ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জি এম শরীফ বলেন, ‘আমরা মূলত এবার সাড়ে আট হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করেছি। এই টাকার সঙ্গে কোচিং ফিও নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আর যারা দু-এক বিষয়ে ফেল করেছে তাদের ক্ষেত্রে বেশি নেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি স্কুলের সবাই বেশি নেয়। ফেল করলে নামি-দামি স্কুল এক লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়। আমরা সেই হিসাবে কমই নিচ্ছি। এখন যার ক্ষমতা আছে সেই পরীক্ষা দেবে, নয়তো পরের বছর দেবে। এটা আমাদের স্কুল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ আমার নেই।’ মিরপুর বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক মো. বদরউদ্দিন হাওলাদার বলেন, ‘ফরম পূরণের ফিয়ের সঙ্গে তিন মাসের বেতন, সেশন ফিসহ আরো কিছু চার্জ নেওয়া হয়। আশপাশের স্কুলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই আমরা ফি নির্ধারণ করেছি। শিক্ষা তো এখন বিনা পয়সায় দেওয়ার সুযোগ নেই। যতই কম নেওয়া হবে, অভিভাবকরা আরো কম নেওয়ার কথা বলবে।’ অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘শুধু এসএসসি নয়, সব পাবলিক পরীক্ষায় নান খাতের অজুহাতে স্কুল কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে। অভিভাবকরা স্কুল নির্ধারিত ফি দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ বাদানুবাদ করলে তাঁর সন্তানকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে না বলেও হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসন এ ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার। বেশি ফি নেওয়ার ব্যাপারে বোর্ডগুলোর পক্ষ থেকে মনিটরিং টিম গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে।’
No comments:
Post a Comment