Monday, November 3, 2014

মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড:যুগান্তর

মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘বাঙালি খান’ নামে। ছিলেন কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান। জামায়াতে ইসলামীর মজলিশে শুরার সেই সদস্য মীর কাসেম আলীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। রোববার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ১৯৮৫ সাল
থেকে জামায়াতে ইসলামীর মজলিসে শুরার (কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ) সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৯টিতে সর্বসম্মতভাবে এবং একটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দণ্ড ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল। বাকি চারটিতে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে নির্যাতনসংক্রান্ত আটটি- ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০ ও ১৪ এবং হত্যাসংক্রান্ত দুটি- ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। হত্যাসংক্রান্ত দুটি অভিযোগে মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে রায়ে। এছাড়া আটটি অপরাধে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২ নম্বর অভিযোগে ২০ বছর; ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগের প্রতিটিতে ৭ বছর করে এবং ১৪ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, এই সাজা তাকে যুগপৎভাবে ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ মোট সাজা ৭২ বছর হলেও সর্বোচ্চ ২০ বছর সাজা ভোগের মাধ্যমে অন্যগুলোও ভোগ করা হয়ে যাবে। রায়ে আরও বলা হয়েছে, আটটি অপরাধে দেয়া কারাদণ্ডের আদেশ মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে। রায়ের পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় মীর কাসেমের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম দাবি করেন, যে তথ্য-প্রমাণাদির ভিত্তিতে দণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে, তাতে এই রায় দেয়া যায় না। প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। এই রায়ের মধ্য দিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।’ অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই বিচারের মধ্য দিয়ে দায়মুক্তির আরেকটি ধাপ পেরোল জাতি।’ যেসব অভিযোগে আসামিকে ট্রাইব্যুনাল খালাস দিয়েছেন, সেগুলোতে আপিল করা হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরে নেয়া হবে বলে জানান আরেক প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ। রায় ঘোষণা উপলক্ষে রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মীর কাসেমকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় হাজির করা হয়। পৌনে ১১টার দিকে তাকে নেয়া হয় ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায়। কাঠগড়ায় ওঠার সময় তিনি সবার উদ্দেশে একটি ‘লম্বা’ সালাম দেন। সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মজিবুর রহমান মিঞা ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম এজলাসে আসেন। সকাল ১০টা ৫৮ মিনিটে সূচনা বক্তব্য দিয়ে রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি বলেন, ৪ মে এই মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। আজ রায় দেয়া হচ্ছে। মামলায় মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি অভিযোগের ক্ষেত্রে আমরা একমত পোষণ করেছি। একটির ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে। পূর্ণ রায় ৩৫১ পৃষ্ঠার, এর মধ্যে ১১ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত রায় পাঠ করেন চেয়ারম্যান। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের এটি ১১তম রায়। এর আগে ১০টি রায়ে ১১ জনকে দণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ৬২ বছর বয়সী মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসেবে। তিনি ওই সময় ছিলেন জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তার বিস্তারিত উঠে এসেছে রায়ে। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের ডালিম হোটেল ছিল এক ভয়াবহ নির্যাতন কেন্দ্র। আলবদর সদস্যরা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের ধরে এনে ডালিম হোটেলে আটকে রাখত। সেখানে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হতো। কোনো কোনো ব্যক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ডালিম হোটেলে স্থাপিত এই নির্যাতন কেন্দ্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব ছিল মীর কাসেম আলীর। নির্যাতন ও নির্মমতার মাত্রা এতটাই ছিল যে, তাকে ‘বাংলার খান সাহেব’ হিসেবেও অনেকে উল্লেখ করেছেন। জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পর মীর কাসেম আলী ছিলেন কেন্দ্রীয় আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান ব্যক্তি। একাত্তরে তার নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিসসংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় সেখানে অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়, যাদের লাশ পরে ফেলে দেয়া হতো চাক্তাই চামড়ার গুদামসংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে। গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মীর কাসেমের বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল-১। চলতি বছর মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়। ২৩ এপ্রিল সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। রাষ্ট্রপক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৪ জন এবং আসামি পক্ষে তিনজন সাক্ষ্য দেন। এর আগে ২০১২ সালের ১৭ জুন ট্রাইব্যুনাল-১ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী জামায়াত নেতা ও দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেমকে গ্রেফতার করে। সেই থেকে তিনি কারাগারে আছেন।  

No comments:

Post a Comment