পুলিশের ভেতরে অপরাধীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায়, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে পুলিশের কিছু সদস্য। যেসব অপরাধীর কবল থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষ পুলিশের সহযোগিতা চেয়ে থাকেন, সেই সব অপরাধেই জড়িয়ে পড়ছে কিছু পুলিশ, যার কারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশের যেসব সদস্য অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে
তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের মধ্যে জবাবদিহিতা কমে যাওয়ায় অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টারের দেয়া এক তথ্য মতে, অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৯ মাসে প্রায় আট হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। সূত্র মতে, চলতি মাসের ১ তারিখে অপহরণ ও চাঁদাবাজির অভিযোগে রাজধানীর ভাটারা থানার দুইজন এএসআইসহ চার পুলিশ সদস্যকে আটকের পর সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হলেন এএসআই মীর সিরাজুল ইসলাম, এএসআই কাউছার আহমেদ, কনস্টেবল আব্দুর রহমান, গাড়িচালক আসাদুজ্জামান। তাদের কবল থেকে বর্ষা নামে এক নারী ও শাহজাহান ওরফে সামসু নামে এক চাকরিজীবীকে উদ্ধার করে র্যাব। জানা যায়, ঘটনার দিন রাতে ভাটারা থানাধীন সাইফনগর এলাকার লিটন মিয়ার বাসায় অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে শাহজাহান ও বর্ষাকে আটক করে ওই চার পুলিশ। এরপর তাদের পুলিশের গাড়িতে তুলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘোরানো হয়। এ সময় পুলিশ শাহজাহানকে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে তার কাছে বড় অঙ্কের টাকা দাবি করে। কিন্তু ওই সময় শাহজাহানের কাছে টাকা ছিল না, যার কারণে বাসায় ফোন করে টাকা আনতে বলে পুলিশ। এরপর শাহজাহান তার মামা আবু জাফরের কাছে ফোন করে মুক্তিপণের এক লাখ টাকা আনতে বলেন। আবু জাফর টাকা দেয়ার আগে ভাগ্নে অপহরণ হয়েছে বলে ভাটারা থানায় জিডি করে। জিডির একটি কপি র্যাবকেও দেয়। জিডির অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব অভিযান চালিয়ে গাড়িসহ চার পুলিশ, বর্ষা ও শাহজাহান সামসুকে এক সাথে আটক করে। বিষয়টি ব্যাপকভাবে জানাজানি হলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহল ওই চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। ঠিক একই দিন বেলা ২টার দিকে বিমানবন্দর এলাকা থেকে মোহাম্মাদ ইকবাল নামে এক পাকিস্তানি নাগরিককে আটক করেন বিমানবন্দর থানার এএসআই তুহিন ও এএসআই আব্দুল্লাহ। ইকবাল পাকিস্তানের করাচি থেকে ঢাকার বিমানবন্দরে পৌঁছেছিলেন। ওই দুই পুলিশ সদস্য নিজেদের ডিবি পরিচয় দিয়ে ইকবালকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে বিভিন্ন এলাকায় ঘোরায়। গাড়িতে বসে তারা ইকবালকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। পরে তাকে বিমানবন্দরের গোল চত্বরের পুলিশ বক্সের ভেতরে নিয়ে তার কাছে থাকা ১৬০০ পাকিস্তানি রুপি ছিনিয়ে নেয় ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পাকিস্তানি নাগরিক ইকবাল বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। পুলিশের উপর মহল থেকে দুই এসআইকে চাপ দেয়া হলে তারা রুপিগুলো ফিরিয়ে দেয়। এই ঘটনার পর বিমানবন্দর গোলচত্বর পুলিশ বক্সের ইনচার্জ এসআই মাসুদ অভিযুক্ত দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে আটক করেন। পরে তাৎক্ষণিক তাদের কোজ করা হয়। এর কিছু দিন যেতে না যেতে গত ৮ তারিখ শনিবার দুপুরে জাহাঙ্গীর নামে আরো এক পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব। এই ঘটনায় জড়িত পুলিশের দুই এএসআইকে ধরতে মাঠে নেমেছে র্যাবের একাধিক সদস্য। জাহাঙ্গীর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রটেকশন বিভাগে কর্মরত। জানা যায়, গত ৬ তারিখ বেলা ১১টায় কনস্টেবল জাহাঙ্গীর, এএসআই রাশেদ ও এএসআই কবিরসহ তিনজন কারওয়ানবাজার এলাকা থেকে আব্দুল মান্নান মৃধা নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে। এরপর যথারীতি তাকে পুলিশের গাড়িতে তুলে বিভিন্ন এলাকা ঘুরানো হয়। ওই ফাঁকে তার কাছে বড় অঙ্কের চাঁদা দাবি করা হয়। কিন্তু ওই সময় মান্নানের কাছে টাকা না থাকায় তাকে বাসায় ফোন করে ব্যাংকের চেক আনার জন্য হুমকি দেয়া হয়। বাধ্য হয়ে মান্নান তার বনানীর বাসায় ফোন করে চেক বই নিয়ে আসতে বলেন। মান্নানের এক আত্মীয় চেক আনার পর এএসআই কবীর ওই চেক দিয়ে ব্র্যাক ব্যাংক গুলশান শাখা থেকে দেড় লাখ টাকা তোলেন। আর জাহাঙ্গীর কৌশলে ছয় লাখ টাকার একটি চেক লিখে মান্নানের কাছ থেকে স্বাক্ষর করিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেয়ে আব্দুল মান্নান মৃধা বিষয়টি র্যাবের কাছে অভিযোগ করলে র্যাব-২ এর একটি দল অভিযান চালিয়ে কনস্টেবল জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করে। এর আগে ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে চার পুলিশ সদস্যকে শাস্তি দেয়া হয়। উল্লেখ্য, এর আগে গত বছর প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার পুলিশ সদস্যকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়েছিল বলে পুলিশ হেডকোয়ার্টার সূত্র জানায়। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের ক্রিমিনলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জিয়া রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, পুলিশের ভেতরে জবাবদিহিতা কমে গেছে, যার কারণে কিছু পুলিশ সদস্যের ভেতরে অপরাধমূলক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তা ছাড়া বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এলেই পুলিশকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করে, যার কারণে কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশ এখন উন্নতির দিকে যাচ্ছে। প্রসারিত হচ্ছে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্র। বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন সেক্টরে আদান-প্রদান হচ্ছে। এতে করে পুলিশ অসাধু চিন্তা করে সুযোগটাকে খারাপভাবে কাজে লাগাচ্ছে। জিয়া রহমান বলেন, দেশ আধুনিকতার দিকে এগোলেও পুলিশসহ বেশ কিছু সেক্টর এখনো পিছিয়ে রয়েছে, যার কারণে একটি গ্যাপ সৃষ্টি হচ্ছে। সে কারণে নিয়োগ থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রে পুলিশের অধুনিকায়ন (রিফর্ম) করলে সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন। পুলিশের এআইজি (মিডিয়া), মো: জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, অপরাধী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। কেউ কোনো অপরাধ করলে এবং তা প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান। এআইজি বলেন, সব সময় পুলিশদের কোনো অপরাধের সাথে না জড়ানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। তারপরও কেউ জড়িয়ে পড়লে তার কোনো ক্ষমা নেই।
No comments:
Post a Comment