রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া নতুন ৯ ব্যাংকের দুর্দিন কাটছে না। বিনিয়োগ স্থবিরতা আর চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। দীর্ঘ দিন ধরে যারা ব্যাংকিং করছে পুরনো ব্যাংকগুলোরই এখন বিনিয়োগ খরা চলছে। এ পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংকগুলো পড়েছে বিপাকে। লোকবল নিয়োগ করা হয়েছে, ভাড়া করা হয়েছে অফিস। সব আছে, নেই শুধু বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, আন্তঃব্যাংকসহ যেসব
ব্যাংক সামান্য আমানত সংগ্রহ করতে পেরেছে, তাদের বেশির ভাগই অর্ধেকের কম বিনিয়োগ করতে পেরেছে। এখন নিশ্চিত লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পেতে কেউ কেউ আগ্রাসী ব্যাংকিং করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাধ সেধেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নিয়মের বাইরে গেলেই জরিমানা গুনতে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত নতুন ব্যাংকগুলোর অধিকাংশকেই নিয়ম অমান্য করার দায়ে জরিমানা গুনতে হয়েছে। এখনো কয়েকটির জরিমানা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নতুন এক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, তার দীর্ঘ ৩০ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে এমন পরিস্থিতির কখনো মুখোমুখি হননি। উদ্যোক্তারা বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে চান না। তারা ব্যাংকের লাইসেন্স পেয়েই মুনাফা করতে চান। মাস শেষে হিসাব নেন আয়-ব্যয়ের। কিন্তু উদ্যোক্তাদের তারা কাক্সিত হারে আয় দেখাতে পারছেন না। ফলে তাদের প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় এখন তার দীর্ঘ দিনের ব্যাংকিং ক্যারিয়ার ধূলিসাৎ হতে বসেছে। অপর এক ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন যাদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল তাদের নতুন ব্যাংকে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। সুদের হার কমানোসহ নানা সুযোগসুবিধা দেয়ার অফার করা হচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগ খরার কারণে নতুন উদ্যোক্তারা আসতে চাচ্ছেন না। ওই এমডির মতে, তারা পড়েছেন উভয় সঙ্কটে। এক দিকে নতুন ব্যাংক হওয়ায় পুরনো ব্যাংকের চেয়ে বেশি মুনাফা দিয়ে নতুন ব্যাংকে আমানত আনতে হচ্ছে। আবার বিনিয়োগের বেলায় স¤পূর্ণ বিপরীত। বিনিয়োগকারীদের আনতে নানা ধরনের সুযোগসুবিধা দিতে হচ্ছে। এতে আমানতের যেটুকু বিনিয়োগ করছেন তা থেকে আয় তুলনামূলক কম হচ্ছে। এ দিকে উদ্যোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী লোকবল নিয়োগ করতে হচ্ছে। এক দিকে তাদের ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু কাক্সিত হারে আয় বাড়ছে না। সব মিলিয়ে তাদের অস্তিত্বই এখন হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত জুন ভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেটুকু তারা আমানত সংগ্রহ করতে পেরেছে তার গড়ে অর্ধেক বিনিয়োগ করতে পেরেছে। যেমন মধুমতি ব্যাংক আমানতের মাত্র সাড়ে ৪৬ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পেরেছে। মেঘনা ব্যাংক বিনিয়োগ করতে পেরেছে সাড়ে ৪৯ শতাংশ। নতুন আরেক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জোড়াতালি দিয়ে চলতে গিয়ে অনেকেই ঝুঁকির মুখে পড়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাও তারা পরিপালন করতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হচ্ছে নতুন ব্যাংকগুলো। বেশির ভাগ ব্যাংক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার গাইড লাইন মানার ক্ষেত্রে উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছে। ‘নতুন’ হিসেবে দোহাই দিয়ে ব্যাংকগুলো পার পেয়ে যাচ্ছে। নানা অনিয়মকে ‘ভুল’ হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গাইড লাইনও বাস্তবায়ন করছে না ব্যাংকগুলো। জানা গেছে, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার আগে ওই প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাইবাছাই করতে হয়। বর্তমানে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইড লাইন অনুযায়ী নিজেরাই কোম্পানিগুলোর রেটিং করে থাকে। কিন্তু সঠিকভাবে ও আন্তর্জাতিকমানের রেটিং না করায় অনেক সময় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানের সম্মুখীন হয়। তারা এক সময় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত দিতে পারে না। ফলে তারা ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়ে যায়। এতে ব্যাংকের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। খেলাপি ঋণের হার বেড়ে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি দুর্বল হয়ে পড়ে। এক সময় মানুষের আমানতের টাকা ফেরত দেয়ার সক্ষমতা থাকে না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ওই সব ব্যাংককে সমস্যাকবলিত (প্রবলেম) ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করে নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসে। ঋণ ঝুঁকি হ্রাস করতে প্রতিটি ব্যাংকের ঋণ দেয়ার আগে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি দিয়ে কোম্পানিগুলোর রেটিং করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্দেশনা দেযা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে বেশির ভাগ ব্যাংক এ নির্দেশনা মানছে না। এ দিকে বিনিয়োগ স্থবিরতার মাঝে পরিচালনা পর্ষদ থেকে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ঋণ দিচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকের ঝুঁকির পরিমাণ। পরিচালন ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে ঋণ ঝুঁকি। এমনি পরিস্থিতি নতুন লাইসেন্স পাওয়া নতুন ব্যাংকগুলো পড়েছে বিপাকে। ব্যাংকগুলো অফিস খুলেছে। শাখা বাড়ানো হচ্ছে। নিয়োগ দেয়া হচ্ছে নতুন লোকবল। কিছু কিছু ব্যাংক পুরনো ব্যাংকগুলোর চেয়ে বেশি সুদ নিয়ে আমানতও নিচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগ করতে না পারায় ওই অর্থ অলস থেকে যাচ্ছে। কেউ কেউ ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ধার দিয়ে, কেউবা কলমানি মার্কেটে বিনিয়োগ করে কাগুজে মুনাফা করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কোনো কোনো ব্যাংক বেশি মুনাফার আসায় অগ্রাসী ব্যাংকিং করার চেষ্টা করছে। পুঁজিবাজারে মাত্রাতিরিক্ত বিনিয়োগ করছে। একটি ব্যাংককে ইতোমধ্যেই সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, ওই ব্যাংক একজন গ্রাহককে ১৬৫ কোটি টাকা ঋণ দিতে যাচ্ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক করায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ফিরে এসেছে।
No comments:
Post a Comment