Sunday, November 16, 2014

নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন বিদেশীরা:নয়াদিগন্ত

জাল ডলার ও জাল টাকা তৈরি, মাদক ব্যবসায়, আদম পাচার, হুন্ডি ব্যবসায়, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, ভিওআইপি ব্যবসায়, অসামাজিক কর্মকাণ্ড এমনকি জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ছেন বাংলাদেশে অবস্থানকারী কিছু বিদেশী। এদের বেশির ভাগই আফ্রিকান। এরা স্টুডেন্ট ভিসা কিংবা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন। কিছু বিদেশী আবার খেলোয়াড় কোটায়ও এ দেশে ঢুকে জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধে। জানা গেছে, এই চক্রের অনেক সদস্যই আবার বৈধভাবে বাংলাদেশ
ে আসেন না। প্রথমে তারা ভারতে আসেন। এরপর দালালদের মাধ্যমে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। এদের অনেকেই অবৈধভাবে দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করে নানা অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এই চক্রের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনেক সময় তারা খুনের ঘটনাও ঘটাচ্ছেন। সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে এই চক্রের বেশ কিছু সদস্যকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।   গোয়েন্দারা বলছেন, ভিন দেশী অনেক অপরাধী রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল ফ্যাটে জীবন যাপন করছেন। অথচ তাদের নেই কোনোও বৈধ আয়ের পথ! তাই অর্থ সংগ্রহে তারা জড়িয়ে পড়ছেন নানা অপরাধে। বিদেশীদের মধ্যে নাইজেরিয়াসহ অফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা অপরাধে বেশি জড়িয়ে পড়ছে। তাদের সাথে দেশের কিছু দালাল ও ইমিগ্রেশনের অসাধু কর্মকর্তারাও জড়িত রয়েছেন। তাই বিদেশী নাগরিকের কাছে বাড়ি ভাড়া দেয়ার আগে তারা বৈধ না অবৈধ তা যাচাই করে নেয়ার জন্য বাড়িওয়ালাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন গোয়েন্দারা।   এ দিকে ভিনদেশী অপরাধীদের চিহ্নিত করতে অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশীদের তালিকা করছে গোয়েন্দারা। তবে দেশে অবৈধভাবে কত বিদেশী নাগরিক রয়েছেন তার সঠিক কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছেও তা নেই। তবে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) সূত্রে জানা গেছে, দেশে বৈধ ও অবৈধ বিদেশী নাগরিকের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার। এদের মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশের ১৫ হাজার বৈধ ও অবৈধ নাগরিক রয়েছেন। কঙ্গো, ঘানা, নাইজেরিয়া, আলজেরিয়া, আইভরি কোস্ট, সিয়েরালিওন, সেনেগাল, ক্যামেরুন, ইথিওপিয়া ও লাইবেরিয়া থেকে আগত প্রায় আট হাজার বিদেশীর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। গত পাঁচ বছরের বিভিন্ন সময়ে তারা এ দেশে এসে আর ফিরে যাননি। এরাই বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।   জানা গেছে, গত শুক্রবার ভোররাতে রামপুরা, উত্তরা ও গুলশানের ১৪৭টি বাড়িতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সমন্বিত অভিযান চালিয়ে ৩১ জন বিদেশী নাগরিককে আটক করে। ৩১ জনের মধ্যে গুলশান থেকে চারজন, বনশ্রী থেকে ১১ জন এবং উত্তরার কয়েকটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় ১৬ জনকে। এই ১৬ জনের মধ্যে দুইজন নারীও রয়েছেন। এরা সবাই আফ্রিকান। অভিযানকালে আটককৃতদের কেউ পাসপোর্ট কিংবা ভিসা দেখাতে পারেননি। এদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। আটককৃতদের মধ্যে কয়েকজন খেলোয়াড়ও রয়েছেন। পরে ছয়জন বৈধ কাগজপত্র দেখালে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। বাকি ২৫ জনের বিরুদ্ধে নগরীর তিন থানায় ফরেনার্স অ্যাক্টে মামলা করা হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন বিভিন্ন সময় মাদক পাচারের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে জামিনে বের হয়ে এসেছেন। অন্যদের ব্যাপারেও তদন্ত করছে পুলিশ।   ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি আব্দুল আহাদ জানান, প্রায় ৪০০ জন অফিসারের সমন্বয়ে ডিবির ৩২টি টিম এ অভিযানে অংশ নেয়। গ্রেফতারকৃত বিদেশীদের সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় ৯টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে গুলশানে একটি, রামপুরায় দুইটি এবং উত্তরা পশ্চিম থানায় ছয়টি।   পুলিশ বলছে, জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংগঠনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন কর্তৃক প্রদান করা শরণার্থী কার্ড নিয়ে কোনো দেশে অবস্থান করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট দেশের শরণার্থী ক্যাম্পে থাকতে হবে। একই সাথে শরণার্থী কার্ডের সাথে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া একটি অনুমতিপত্র সংযুক্ত থাকতে হয়। কিন্তু গ্রেফতারকৃতদের শরণার্থী কার্ডের সাথে সেটাও নেই।   মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কয়েকজন মাদক ব্যবসায়সহ বিভিন্ন অপরাধে এর আগেও জেল খেটেছে। তেমনই একজন আইভরি কোস্টের যুবতী জুলেবা বিকেটরিস। জুবেলার কাছে পাসপোর্ট-ভিসার পরিবর্তে শরণার্থী কার্ড পাওয়া গেছে। কিন্তু তার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১২ সালে। জুলেবার মতো অনেক বিদেশীই জেল থেকে বের হয়ে ফের একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। তাই এবার গ্রেফতার হওয়া ২৫ জন জামিন পাওয়ার পরও তাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) মাধ্যমে তাদের নিজ দেশে ফেরৎ পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।   পুলিশের বিশেষ শাখার ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে, এদের বেশির ভাগ খেলোয়াড় কোটার পাশাপাশি জাল স্টুডেন্ট ভিসায় দেশে ঢুকছেন। স্থলে পথে আসা এসব নাগরিক প্রথমে ভারতে আসার পর দালালদের মাধ্যমে চোরাইপথে এ দেশে ঢুকছেন। এরপর এ দেশীয় কিছু দালালের সহায়তায় মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বসবাস করছেন। এরা ইংরেজিতে পারদর্শী হওয়ায় যেকোনো পরিবেশে নিজেদের উপস্থাপন করে গড়ে তুলছেন আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জাল ডলার, জাল টাকা, জাল মুদ্রার উপাদান, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অস্ত্র ব্যবসায়, আদম পাচার করার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মাদক ব্যবসায় করছেন। অসামাজিক কাজেও ব্যাপকহারে লিপ্ত হচ্ছেন। এর ফলে আমাদের সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। শিশু বলাৎকারের মতো ঘটনাতেও আফ্রিকান নাগরিকদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। এতে পুরো দেশ একদিকে যেমন লজ্জায় পড়ছে, বহির্বিশ্বেও দেশের ভাবমর্যাদা   ুণœ হচ্ছে।   মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (উত্তর) শেখ নাজমুল আলম বলেন, কিছু বিদেশী নাগরিক বাংলাদেশে এসে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এসব অপরাধীর অনেকেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হচ্ছেন। জামিন পেয়ে তারা আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন এ ধরনের একাধিক নজির রয়েছে। উত্তরায় স্কুলছাত্র জুবায়ের হত্যার পর ডিবি বিদেশী নাগরিকদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। উত্তরা, বনশ্রী, গুলশানের বিভিন্ন বাড়িতে অবস্থানরত বিদেশীদের তালিকা করা হয়। সেই তালিকা ধরে ছয়জন এডিসির সমন্বয়ে গঠিত প্রতিটি টিমে একজন করে এসি ছিলেন।   তিনি বলেন, এসব বিদেশী অবৈধভাবে অবস্থান ছাড়াও অন্য কোনো অপরাধে জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অবৈধ বিদেশীদের তালিকা করা হচ্ছে। সেই তালিকায় বিদেশীর নাম এবং ঢাকার কোন বাড়িতে অবস্থান করছেন সেই বাড়ির তালিকা করা হচ্ছে। পরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, নিকুঞ্জ ও ধানমন্ডিতে অভিযান চালানো হবে।   কোনো বিদেশী নাগরিক বাড়ি ও অফিস ভাড়া নেয়ার েেত্র মালিকদের কাছে পাসপোর্ট, ভিসা ও কাজের অনুমতিপত্র দেখাতে হয়। কিন্তু বাড়ি বা অফিসের মালিকেরা আফ্রিকান এসব অবৈধ নাগরিকের কাছে কাগজপত্র না দেখে বেশি টাকার লোভে ভাড়া দিয়ে দেন উল্লেখ করে শেখ নাজমুল আলম বলেন, পরবর্তী অভিযানে অবৈধ বিদেশীদের ভাড়া দেয়ার অভিযোগে বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বৈধ কাগজপত্র ছাড়া কোনো বিদেশীকে বাড়ি ভাড়া না দেয়ার জন্য বাড়ির মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানান।   জানা গেছে, গত ৫ সেপ্টেম্বর ইংলিশ মিডিয়াম ছাত্র জুবায়ের আহমেদের (১৭) লাশ উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের খেলার মাঠসংলগ্ন পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় আলজেরিয়ান অবৈধ নাগরিক আবু ওবায়েদ কাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। কাদের ভালো ফুটবল খেলার পাশাপাশি ইংরেজি ও আরবিতে দ। ফুটবল কোচ পরিচয়ে উত্তরায় শিশু-কিশোরদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। আর এই ‘বন্ধুত্ব’কে বিকৃত যৌনাচারে রূপান্তর করতে গিয়ে কাদের হত্যা করেন ‘ও’ লেভেলের শিার্থী জুবায়ের আহমেদকে। শুধু এই আলজেরিয়ান নাগরিকই নন, অতি সম্প্রতি ক্যামেরুনের তিন নাগরিককে উত্তরা থেকে জাল ডলারসহ গ্রেফতার করা হয়। এরা হলেনÑ পেরেজ ইফরেইন, সেন কেরিন ন্যাটি ও মিকো স্যান্ডিও নাটালি। কিন্তু এক মাসের মধ্যে তারা জামিনে বের হয়ে আবারো একই অপরাধ কার্যক্রম চালাচ্ছেন বলে ডিবির কাছে তথ্য এসেছে। সম্প্রতি এসব অবৈধ আফ্রিকান নাগরিকের বিরুদ্ধে যৌন উত্তেজক নি¤œমানের ওষুধ, মানব ভ্রƒণ নষ্টকারী গায়োনিক এসিডের অলিভা ও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকারক কসমেটিকস সামগ্রীর ব্যবসায় করার অভিযোগ রয়েছে।   ১১ জুন কারওয়ান বাজারের একটি আবাসিক হোটেল থেকে সাড়ে তিন কেজি কোকেনসহ পেরুর নাগরিক জুয়ান পাবলো রেফায়েলকে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে কোকেন বহনকারী লাগেজ নিয়ে বিমানবন্দর দিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। বিমানবন্দরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় এ ধরনের একাধিক ঘটনা ঘটলেও তারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২ জুন ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির বিভিন্ন সরঞ্জাম, বিদেশী মুদ্রা ও জাল ভিসাসহ শ্রীলঙ্কার নাগরিক মোহনাথারাস পন্নুথারাইকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। ২ মে উত্তরা এলাকায় রিকশা ভাড়াকে কেন্দ্র করে এক রিকশাচালককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে পাঁচ বিদেশী নাগরিক। এরা হলেনÑ ঘানার নাগরিক মির আজাদ ও কামরা ইব্রাহিম, নাইজেরিয়ার নাগরিক মারফুজ উফুন এবং গিনির নাগরিক মিলি মক রবেট ও বাই স্কুট। পরে উত্তরা থানা পুলিশ তাদের আটক করে। গত বছর ২৪ অক্টোবর ৬৮৪টি পাসপোর্টসহ তিন লিবীয় নাগরিক সামির আহম্মেদ ওমর, আমরা মাহমুদ আমরা, মোবারক সেলিম এবং বাংলাদেশী মডেল কন্যা প্রিয়াংকা জামানকে গ্রেফতার করে ডিবি। তারা লিবিয়ায় কাজের সুযোগ দেয়ার কথা বলে বাংলাদেশীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।    

No comments:

Post a Comment