মাত্র ২২ মিটার লম্বা ছোট্ট কাঠের ট্রলার থেকে একে একে বেরিয়ে আসছিলেন নারী, কিশোর, যুবা, বৃদ্ধ। ছিল মায়ের কোলে ১১ মাস বয়সী শিশুও। মলিন বসন, বিধ্বস্ত চেহারা। পাচার হওয়া থেকে বেঁচে যাওয়ায় অনেকেই ছাড়ছিলেন স্বস্তির নিঃশ্বাস। আটক মালয়েশিয়াগামী ট্রলারের যাত্রীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কথিত ‘স্বপ্নিল’ জীবনের হাতছানিতে সব তুচ্ছ করে সাগরে নেমেছিলেন তাঁরা। এঁদের মধ্যে শিশুসন্তান নিয়ে নারীরা
যাচ্ছিলেন মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত স্বামীর কাছে। কিশোর-যুবকদের বেশির ভাগ যাচ্ছিলেন ভালো উপার্জনের আশায়, স্বেচ্ছায়। কয়েকজনকে রাস্তা থেকে অপহরণ করে পাচার করা হচ্ছিল। গত সোমবার বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর মঙ্গলবার তাঁদের নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রাম নৌবাহিনীর একটি জেটিতে। ট্রলার থেকে নামিয়ে রাখা হয় চট্টগ্রাম ‘রেডি রেসপন্স বার্থের’ পাশে শামিয়ানা টাঙানো একটি জায়গায়। ট্রলার থেকে উদ্ধার ৫৯২ জনের মধ্যে ৪৯৬ জনকে বাংলাদেিশ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। বাকি ৯০ জন মিয়ানমারের নাগরিক। ছিলেন ১১ নাবিক ও পাঁচজন পাচারকারী। প্রতারণার শিকার বাংলাদেশিদের গতকাল নাম-ঠিকানা ও জবানবন্দি নিয়ে পতেঙ্গা থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ ও অনুপ্রবেশের দায়ে বাংলাদেশের তিনজন ও মিয়ানমারের ৮২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। শিশুসন্তান নিয়ে সাগরপাড়ি: আটক নারীদের অধিকাংশের স্বামীই কয়েক বছর আগেই একইভাবে ট্রলারে চেপে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া গেছেন। সেখানে থিতু হওয়ার পর স্বামীদের পরামর্শে দালালদের সহায়তায় তাঁরাও ট্রলারে চেপে বসেন। এই যাত্রীদের মধ্যে ১৪ জন নারী ও ২১ শিশু টেকনাফ ও কক্সবাজার এলাকার। আর মিয়ানমারের ১৯ জন নারী ও ১২ শিশু। তিন সন্তানের মা এলম বাহারও স্বামীর কাছে থাকতে মালয়েশিয়ায় যাচ্ছিলেন। বাহার বলেন, তাঁর বাড়ি টেকনাফে। দুই বছরের জান্নাত আরা, ছয় বছরের মামুন ও নয় বছরের তারেককে নিয়ে ট্রলারে সাগরে ভাসেন তিনি। স্বামী ইমাম হোসেন দুই বছর আগে মালয়েশিয়ায় যান। স্বামীর পরামর্শে তাঁকে শিশুসন্তানদেরসহ ট্রলারে তুলে দেন দালালেরা। ১৩ বছরের সন্তান মুন্নাকে নিয়ে মনোয়ারা বেগমও রওনা হন মালয়েশিয়ার পথে। স্বামী হামিদ হোসেন কয়েক বছর আগে একইভাবে মালয়েশিয়া গেছেন। মনোয়ারা বলেন, ‘সবকিছু স্বামী ঠিক করে রেখেছিল। কিছু লোক আমাদের নৌকায় করে পরে ট্রলারে ওঠায়। স্বামী বলেছিল, “ট্রলারে থাইল্যান্ড পৌঁছে দিলে লোকজন ঠিক করা আছে। এরপর সে-ই মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাবে।”’ দুই শিশুসন্তান নিয়ে অনিশ্চিত জীবনের পথ ধরেছিলেন মিয়ানমারের মেরুল্লা এলাকার আয়েশা বেগমও। স্বামী অজিউল্লাহ দেড় বছর আগে মালয়েশিয়ায় গেছেন। আয়েশার মতোই সাগরে পা বাড়িয়েছিলেন টেকনাফের সাবরাং এলাকার আছমা খাতুন তিন ছেলে নিয়ে, আর তৈয়বা বেগম চার সন্তান নিয়ে। সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন: যশোরের মনিরামপুরের হুমায়ুন কবিরের (২০) সঙ্গে একদিন মুঠোফোনে যোগাযোগ করেছিলেন একই এলাকার মিলন হোসেন। মিলন ১০-১২ বছর ধরে মালয়েশিয়া আসা-যাওয়া করেন। দুই বছর আগে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে পড়াশোনার ইতি টানেন হুমায়ুন। মিলন হুমায়ুনকে বলেছিলেন, তিন দিন কষ্ট করে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে পারলেই মাসে মিলবে ৫০-৬০ হাজার টাকা বেতন। পৌঁছানোর পর গ্রামে মিলনের লোকজনের কাছে তুলে দিতে হবে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা। পরিবারের দুঃখ ঘোঁচানোর এমন স্বপ্নে বিভোর হয়ে মালয়েশিয়া যেতে রাজি হন হুমায়ুন। একই স্বপ্ন দেখে হুমায়ুনের সঙ্গে রওনা হন এলাকার কৃষক বিল্লাল হোসেন, সাবের আলী ও যুবক হারুন। ২ নভেম্বর কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় যান তাঁরা। এরপর তাঁদের কাছ থেকে মুঠোফোন, টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে একটি ঘরে আটকে রাখেন দালালেরা। ভোররাতে পাহাড়ি পথ বেয়ে সাগরপাড়ে নিয়ে যান তাঁরা। সেখানে আগেই জড়ো করা হয়েছিল ২০-২৫ জনকে। সবাইকে তোলা হয় একটি নৌকায়। ভাত খেতে দেওয়া হয় শুকনো মরিচ ও লবণ দিয়ে। একটু নড়াচড়া করলেই পাইপ দিয়ে জোটে পিটুনি। উদ্ধার হওয়ার পর হুমায়ুন বলেন, ‘এখন বুঝতে পেরেছি, কত বিপজ্জনক পথে পা বাড়িয়েছিলাম।’ যশোরের বাঘাপাড়ার তরুণ ইমতিয়াজ উদ্দিনকে (১৭) লোভের শিকার বানিয়েছিলেন গ্রামের সোনিয়া নামের এক নারী দালাল। ইমতিয়াজ বলে, ‘যশোর থেকে কক্সবাজার হয়ে সাগরপািড় দিয়ে নৌকায় ওঠার আগে বারবার হাতবদলকালে মনে হয়েছিল, শুধু বিক্রিই হচ্ছি। প্রতিবার হাতবদল হওয়ার সময় দালালেরা টাকা-পয়সা বিনিময় করছিল।’ সে বলে, ‘নৌকায় তোলার সময় যাব না বলছিলাম দালালদের। এরপর মারধর শুরু করলে নৌকায় না উঠে পারিনি। উদ্ধারের পর মনে হচ্ছে, যেন মৃত্যুর পথ থেকে ফিরে এলাম।’ অপহরণের পর পাচার!: কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা এলাকার তরুণ রহিম উদ্দিন (১৬) জানায়, তিন বন্ধুর সঙ্গে সে টেকনাফে বেড়াতে গিয়েছিল। তিন বন্ধুই হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। পরে পথ চিনতে না পেরে সে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছিল। এরপর এক লোক তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে নিজ বাড়িতে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে আরেকজন এসে তাকে নিয়ে সাগরের দিকে যায়। নৌকায় তুলে দেওয়ার সময় সে উঠতে রাজি না হলে কষে চড় মারে লোকটি। এরপর বাধ্য হয়ে নৌকায় ওঠে। সেখান থেকে পাচারের ট্রলারে। কক্সবাজারের ইসমাইল হোসেনও (২০) শিকার হয়েছিলেন অপহরণকারীদের। তাঁর দাবি, সপ্তাহ খানেক আগে কক্সবাজারের খুরুসকুল এলাকা থেকে দুই বন্ধুসহ বোনের বাড়ি যাচ্ছিলেন। টেকনাফের হ্নীলায় বাস থেকে নামার পর তাঁরা একটি সিএনজি ভাড়া করে রওনা হন। পথে দুটি সিএনজি তাঁদের পথরোধ করে। সিএনজির যাত্রীরা পাশের একটি পাহাড়ে নিয়ে যায় তাঁদের। রাতভর সেখানে আটকে রেখে জোর করে নৌকায় তুলে দেওয়া হয়। ছিনিয়ে নেওয়া হয় মুঠোফোন ও টাকা-পয়সা। পরে হাফপ্যান্ট পরিয়ে মালয়েশিয়াগামী ওই ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়। স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বিদেশগামী এই মানুষগুলোর অভিন্ন ওই বিপজ্জনক যাত্রাটি নৌবাহিনীর অভিযানে ভেস্তে গেলেও গতকাল ছাড়া পাওয়া ব্যক্তিরা খুশি মনেই বাড়ি ফিরে গেছেন। আর দালাল, অনুপ্রবেশকারীরা মামলার আসামি হয়ে ঠাঁই পেয়েছেন কারাগারে।
No comments:
Post a Comment