Saturday, November 8, 2014

জামায়াত পর্যুদস্ত, নেতারা হতোদ্যম:প্রথম অালো

মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে দলের তিন শীর্ষস্থানীয় নেতার ফাঁসির রায়ে আরও পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে জামায়াতে ইসলামী। এঁদের মধ্যে একজনের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার প্রক্রিয়া চলছে। এ অবস্থায় রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়া দলটির নেতা-কর্মীরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। জামায়াতের নেতারা জানিয়েছেন, নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি দলের নীতি-নির্ধারকেরা আরও উদ্বেগে আছেন অপরাধী সংগঠনের বিচারের জন্য প্রণীত আন্তর্জাতিক অপর
াধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের খসড়া নিয়ে। এটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। বস্তুত এ আইনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। এ অবস্থায় দলের ভবিষ্যৎ নিয়েও জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের ভেতরে ঘোরতর অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, এর আগে জামায়াতের চিন্তাশীল ব্যক্তি ও নেতাদের একটি অংশের চিন্তা ছিল, দল নিষিদ্ধ হলে নতুন নামে রাজনৈতিক দল গঠন করা। এ লক্ষ্যে কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু দলের ভেতর থেকে একটি অংশের আপত্তির পাশাপাশি প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে সে চিন্তা আর এগোয়নি। একসময় জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও দলের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী চেয়েছিলেন, জামায়াতের নাম বাদ দিয়ে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে আরেকটি দল গঠনের। কিন্তু জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ মূল নেতৃত্ব এ চিন্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত সোমবার কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন। এখন তাঁর দণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায় আছে। একই অপরাধে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধেও গত রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। এর আগে গত ২৯ অক্টোবর নিজামীরও মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয় ট্রাইব্যুনালে। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী ও কর্মপরিষদের একাধিক নেতা জানান, নেতাদের প্রাণদণ্ডের পাশাপাশি দলের নীতিনির্ধারকেরা এখন গভীর চিন্তায় আছেন জামায়াতের ভবিষ্যৎ নিয়ে। নেতাদের দণ্ড রহিত করা বা দল নিষিদ্ধ হলে পরবর্তী করণীয় এখনো ঠিক করতে পারেননি। তাঁরা এ সংকট থেকে উত্তরণে দীর্ঘমেয়াদি এবং জুতসই উপায় খুঁজছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পর আর কী কী পদক্ষেপ নেয়, তা দেখে ধীরেসুস্থে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চান দলের নীতিনির্ধারকেরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামায়াত এর আগেও একাধিকবার নিষিদ্ধ হয়েছে। এ নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তিত না। সে প্রস্তুতি আমাদের আছে। নিষিদ্ধ হলে কীভাবে কাজ করতে হয়, সে অভিজ্ঞতা আমাদের আছে।’ উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় আপাতত হরতাল বা বিক্ষোভের মতো গতানুগতিক কর্মসূচিতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াত। দলের নেতাদের কারও ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হলেও এ কর্মসূচির বাইরে ভিন্ন কিছু চিন্তা করা হচ্ছে না বলে দলের দায়িত্বশীল নেতারা জানান। যদিও দলের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর তিন দফায় ঘোষিত পাঁচ দিনের হরতাল ছিল ঢিলেঢালা ও অসফল। তবে এ বিষয়ে জামায়াতের বক্তব্য হচ্ছে, তারা চরম বৈরী পরিবেশে কর্মসূচি দিয়েছে। দলীয় সূত্রগুলো জানায়, ট্রাইব্যুনালে দলের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের পর জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা সারা দেশে যে উগ্র ও সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, এবার সে ধরনের প্রতিক্রিয়া না দেখানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে। এর কারণ, গতবারের সহিংসতার ফল হিতে বিপরীত হয়েছে। তাই আবারও সহিংসতায় জড়িয়ে নতুন করে জনবলের ক্ষয় করতে চান না জামায়াতের নীতিনির্ধারকেরা। এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সহকারী মতিউর রহমান আকন্দের কথায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামায়াত গণতান্ত্রিকভাবেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে। আমাদের নেতা-কর্মীরা রায়ে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা ধৈর্যহারা হয়ে কোনো ধ্বংসাত্মক কাজে নিয়োজিত হবেন না।’ দলটির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, হঠাৎ করে তিন নেতার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর জামায়াতের নীতিনির্ধারকেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ওপরও। অবশ্য দলের নেতাদের একের পর এক সর্বোচ্চ দণ্ডকে ‘পরীক্ষা’ বলে মন্তব্য করেন মুজিবুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। তিনি যাঁর হায়াত রেখেছেন, তাঁকে কেউ মারতে পারবে না। আর যাঁর ভাগ্যে শাহাদাত আছে, তিনি শহীদ হয়ে জান্নাতে যাবেন। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াই এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ।’ জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, তিনটি কারণে অপেক্ষমাণ রায়গুলোকে দ্রুত সামনে আনা হয়েছে। এক, জামায়াতের নেতৃত্ব ও দলকে নিশ্চিহ্ন করা। এতে বাইরের কোনো দেশের চাপ থাকতে পারে। দুই, বিরোধী দল নতুন করে আন্দোলনের যে ঘোঁট পাকছে—তা অঙ্কুরেই নস্যাৎ করা। তিন, গোলাম আযমের জানাজায় বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি সরকারের জন্য যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তা আড়াল করা। মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘গোলাম আযমের জানাজায় মানুষ পঙ্গপালের মতো ছুটে এসে সরকারকে একটা বার্তা দিয়েছে। তা হচ্ছে, সরকার জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করেছে, জনগণ তা বিশ্বাস করে না। জানাজায় মানুষের জাগরণ দেখেই মাত্র চার কার্যদিবসে তড়িঘড়ি করে তিনটি মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে।’ আমান আযমীকে নিয়ে গুঞ্জন: গোলাম আযমের জানাজায় তাঁর ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমীর নামাজ পড়ানো, তার আগে বাবা সম্পর্কে উত্তেজক বক্তব্য, এরপর গেলাম আযমের জানাজায় বিএনপির কেউ না আসায় ফেসবুকে বিএনপিকে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলে তাঁর মন্তব্যের পর গুঞ্জন ছড়ায় যে আমান আযমী জামায়াতে যোগ দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ এ নিয়ে মাতামাতি শুরু করে। অবশ্য, আবদুল্লাহিল আমান আযমী এ গুঞ্জন নাকচ করে দেন। গত বুধবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করছি না। এ মুহূর্তে আমি দেশে কিছু দক্ষ সুনাগরিক তৈরি করতে একটি স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছি।’ জামায়াতের নেতাদের বড় একটি অংশ মনে করে, গোলাম আযমের মৃত্যুর পর তাঁর জানাজায় নেতা-কর্মীদের লক্ষণীয় উপস্থিতি দলকে নতুন করে সরকারের রোষানলে ফেলেছে। যদিও ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বায়তুল মোকাররমের উত্তর ফটকে জনসভার পর গত ২৫ অক্টোবর গোলাম আযমের জানাজা ঘিরে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা বায়তুল মোকাররমে নীরবে দলীয় জনশক্তি প্রদর্শনের সুযোগ পান। যদিও বায়তুল মোকাররমে জানাজা অনুষ্ঠানে জামায়াতের দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না বলে জানিয়েছেন আমান আযমীসহ দলের একাধিক নেতা। বরং গণমাধ্যমে আমান আযমী জানাজার স্থানের নাম আগাম প্রকাশ করায় জামায়াতের নীতিনির্ধারকেরা অস্বস্তিতে পড়েন। সরকার ও বিরোধীপক্ষ কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে, সে আশঙ্কায় ভুগছিলেন নেতারা।

No comments:

Post a Comment