সারা দেশে তিন লাখ ১৩ হাজার যানবাহন চলাচলযোগ্যতা (ফিটনেস) সনদ ছাড়াই চলছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাতেই ফিটনেস সনদবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৯৩ হাজার ৬০৪। শতকরা হিসাবে প্রায় ৩৩ ভাগ যানবাহনেরই ফিটনেস নেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) গত ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত তৈরি করা হিসাবে এই তথ্য উঠে এসেছে। মোটরযান আইনে ফিটনেস পেতে অন্তত ৩০ ধরনের কারিগরি ও বাহ্যিক বিষয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার আইন আছে। কিন
্তু বিআরটিএ পরীক্ষার কাজে কোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে না। চোখে দেখে ফিটনেস দেয়। আবার ফিটনেস পেতে বিআরটিএ কার্যালয়ে গাড়ি হাজির করার নিয়ম। অভিযোগ আছে, বাস, ট্রাকসহ অধিকাংশ গণপরিবহন বিআরটিএ কার্যালয়ে না নিয়েই ফিটনেস সনদ পেয়ে যাচ্ছে। মোটরযান আইনে ফিটনেস সনদহীন যানবাহন রাস্তায় নামানোই নিষেধ। ধরা পড়লে সোজা জব্দ করার নিয়ম। বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশের কার্যকর তৎপরতা না থাকায় ফিটনেস সনদ নেওয়া যানবাহন মালিকের ইচ্ছার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফিটনেস সনদ নেওয়ার উল্লেখযোগ্য শর্তগুলো হলো: নির্মাণকালীন নকশা অক্ষত থাকা, ব্রেক-গিয়ার ঠিক থাকা, প্রয়োজনীয় বাতি থাকা, কালো ধোঁয়া বের না হওয়া, গাড়ির রং ঠিক থাকা। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি কী, তা রাজধানীর রাস্তায় নজর রাখলেই বোঝা যায়। রাজধানীর মিরপুর থেকে চলাচল করে বাহন, সেফটি ও শিখর পরিবহন। বাহন যায় মিরপুর থেকে খিলগাঁও তালতলা পর্যন্ত। সেফটির পথ মিরপুর-ঢাকেশ্বরী মন্দির। আর শিখর পরিবহনের চলাচল মিরপুর-যাত্রাবাড়ীর মধ্যে। গত বুধবার দুপুর ১২টায় মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে তিনটি পরিবহনের তিনটি বাস যাত্রী তুলছিল। এর মধ্যে সেফটি ও শিখর পরিবহনের দুটি বাসের ‘গায়ের চলটা ওঠা’ অবস্থা। যেটুকু রং আছে তা বলতে গেলে দৃষ্টিকে পীড়া দেয়। ডান, বাম, সামনে, পেছনে—বাসের সারা গা ট্যাপ খাওয়া। খুঁটিয়ে না দেখলে নিবন্ধন নম্বরও বোঝার জো নেই। বাহন পরিবহনের বাসটির চালকের পাশের জানালার কাচ ভাঙা। যাত্রী আসনের পাশেও অনেক জানালা কাচশূন্য। মোটরযান বিধি অনুযায়ী, এই তিনটি বাসই ফিটনেস সনদ পাওয়ার যোগ্য নয়। কিন্তু বিআরটিএতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনটি বাসেরই ফিটনেস সনদ হালনাগাদ আছে। বাহন পরিবহনের ওই বাসের নম্বর (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-২৮৫২), সেফটির নম্বর (ঢাকা মেট্রো ব-১১-৩৪৬৭) এবং শিখরের নম্বর (ঢাকা মেট্রো জ-১১-১০০৩)। মালিক সমিতির নেতারা বলেন, আইন মানলে এই তিনটি বাসসহ লক্কড়ঝক্কড় অনেক যানবাহনই অভিযানের বাইরে থেকে যাবে। কারণ, তাঁদের হাতে ফিটনেস সনদ আছে। সমিতি জানায়, ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের আগে ফিটনেসহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান চালানো হয় ঢাকায়। তবে তা ছিল জরিমানা করা পর্যন্ত। সাম্প্রতিক বড় কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনার পর লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন, লাইসেন্সবিহীন চালক ও নছিমন-করিমনের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনার জন্য ২৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়ে নিজ নিজ এলাকায় আগামীকাল সোমবার থেকে অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছে। এ সময় ঢাকায় বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেটরাও বিশেষ অভিযান চালাবেন। জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, এবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করায় অভিযান সফল হবে বলে আশা করা যায়। সনদ আছে কিন্তু যানবাহন লক্কড়ঝক্কড় এমন ক্ষেত্রে কী করা হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিশ্চয় সনদ দেওয়ার প্রক্রিয়া সঠিক হচ্ছে না। এটা অবশ্যই বন্ধ করা হবে। দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ২১ লাখ পাঁচ হাজার ১৪০টি। মোটরসাইকেল বাদ দিলে ফিটনেস নিতে হয় এমন যানবাহনের সংখ্যা নয় লাখ ৭৪ হাজার ৭৩৫। সারা দেশে হালনাগাদ ফিটনেস সনদ ছাড়া চলছে প্রায় ৩৩ শতাংশ যানবাহন। আর ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা আট লাখ ৩৫ হাজার ৮১২টি। এর মধ্যে ফিটনেস ছাড়া চলছে ৯৩ হাজার ৬০৪টি যানবাহন। মোটরযান আইনে মোটরসাইকেলের ফিটনেস সনদের আওতার বাইরে। নতুন গাড়ির প্রথম পাঁচ বছরের ফিটনেস দেওয়া হয় শুরুতেই। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, হরতাল-অবরোধ, রাজনৈতিক কর্মসূচি, ছাত্রদের বিক্ষোভ—সবকিছুর লক্ষ্য হলো রাস্তার বাস। এ ছাড়া যানজটে আটকা পড়ে চালকেরা আয় বৃদ্ধির জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। এ জন্য নতুন বাসও এখানে দ্রুত লক্কড়ঝক্কড় হয়ে যায়। এনায়েত উল্যাহর দাবি, মহাসড়কে পুরোনো নছিমন-করিমন-অটোরিকশা সড়ক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। তবে অভিযান শুরু হলে তাঁরা সহায়তা করবেন বলেও জানান তিনি। ঢাকা মেট্রো চ-৯৪৬৭ নম্বরের একটি রংচটা বাসকে সম্প্রতি আর্মড পুলিশের সদস্যদের বহন করতে দেখা যায়। বাসটির সামনের কাচে লেখা ‘পুলিশ ডিউটি’। বিআরটিএতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮৯ সালের পর ওই বাসটির ফিটনেস সনদ নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি নাটোরে কেয়া ও অথৈ পরিবহনের দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩৩ জন প্রাণ হারান। ওই দুটি বাসের কোনোটিরই ফিটনেস সনদ হালনাগাদ ছিল না। পরে বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গাবতলীতে কেয়া পরিবহনের গ্যারেজে অভিযান চালিয়ে কোম্পানির ১৫টি ফিটনেসহীন বাসের সন্ধান পান। এর জন্য কোম্পািনটিকে জরিমানা করা হয়। এই বাসগুলো প্রতিদিন যাত্রী নিয়ে চলাচল করলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। হাইওয়ে পুলিশের হিসাবে, গত ঈদুল আজহার আগে-পরে তিন দিনে ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের গাজীপুর ও টাঙ্গাইল অংশেই অন্তত ১৫টি যানবাহন বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিটনেসহীন যানবাহন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়। পথে হঠাৎ বিকল হয়ে যানজট তৈরি করে দুর্ভোগ বাড়ায়। ফিটনেস পরীক্ষা কার্যক্রমের বড় অংশই কারিগরি। কিন্তু বিআরটিএর একজন পরিদর্শক খালি চোখেই মোটরযানের নানা ত্রুটি পরীক্ষা করেন। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করলে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ যানবাহনই ফিটনেস সনদ পাবে না। ১৯৯৮ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থে বিআরটিএর ঢাকা, কেরানীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা কার্যালয়ের জন্য পাঁচ কোটি টাকায় পাঁচটি ভেহিক্যাল ইনস্পেকশন সেন্টার (ভিআইসি) স্থাপন করা হয়। এই যন্ত্রগুলো কোনো দিনই ব্যবহার করা হয়নি। এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিটনেসের সবগুলো শর্ত পরীক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু সচিব এম এ এন সিদ্দিক জানান, বিদেশ থেকে প্রকৌশলী এনেও যন্ত্রগুলো চালু করা যায়নি। আগামী তিন মাসের মধ্যে নতুন করে যন্ত্র স্থাপন করা হবে। এই পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, বিআরটিএ যে প্রক্রিয়ায় যানবাহনের ফিটনেস দেয় সেটা অবৈজ্ঞানিক। ফলে ফিটনেস থাকা না-থাকার মধ্যে আসলে কোনো পার্থক্য নেই। এ ছাড়া তারা কেবল নিবন্ধন আছে, এমন যানবাহন থেকে ফিটনেসহীন যানের তালিকা তৈরি করে। এর বাইরে অন্তত আট লাখ নছিমন-করিমন-ভটভটিসহ অন্য যানবাহনের নিবন্ধন-ফিটনেস কোনোটাই নেই। তিনি বলেন, এ অবস্থায় দুটি কাজ করতে হবে, প্রথমত নিবন্ধন ও ফিটনেসহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে সড়ক-মহাসড়কে কার্যকর অভিযান চালাতে হবে। দ্বিতীয়ত ফিটনেস সনদ দেওয়ার সময় কড়াকড়ি আরোপ ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা অভিযানে খুব একটা ফল পাওয়া যাবে না। ফিটনেস নেই ৪৫% অটোরিকশা, টেম্পো, হিউম্যান হলার ৪২% ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক্টর ৩৭% বাস, মিনিবাস ২২% কার, পিকআপ, মাইক্রোবাস, ট্যাক্সিক্যাব ৩০% অ্যাম্বুলেন্স সূত্র: বিআরটিএ
No comments:
Post a Comment