বিদ্যুতের প্রয়োজন নেই। জলীয় বাষ্পের খুব সাধারণ একটি ধর্মকে কাজে লাগিয়ে ঘর ঠান্ডা রাখা হবে। আর বাঁশের তৈরি আরেক ধরনের প্রযুক্তি বাতাসের আর্দ্রতা টেনে শুষে নেবে। এ পদ্ধতিতে এই প্রথম একটি বিকল্প ‘হিমাগার’ তৈরি করা হয়েছে। ৩০০ টন ধারণক্ষমতার এই হিমাগারটি তৈরিতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৪ লাখ টাকা। প্রচলিত পদ্ধতিতে এ ধরনের একটি হিমাগার তৈরিতে প্রায় আড়াই কোটি টাকা প্রয়োজন। এটি তৈরি করেছেন রাজশাহী বিশ্
ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম মনজুর হোসেন। এতে অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের হিমাগারটি উদ্বোধন করার কথা। মনজুর হোসেন জানান, আর কোথাও এ ধরনের হিমাগার নেই। এটা হচ্ছে স্বল্প আয়ের কৃষকের জন্য ব্যয়সাশ্রয়ী পচনশীল শস্য সংরক্ষণাগার। তবে অন্তত এক বছর ব্যবহার না করা পর্যন্ত এর উপযোগিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে না বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রাজশাহী নগরের নামোভদ্রা এলাকায় হিমাগারটি নির্মাণ করা হয়েছে। ৩ নভেম্বর রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক নিয়ামুল বারি এটি পরিদর্শন করেন। তিনি গ্রিন টেকনোলজি নিয়ে কাজ করেন। এই হিমাগারের সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, এর কাঠামো, ভেতরের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিমাপ যা দেখা যাচ্ছে তা থেকে আশা করা যায়, এটি প্রাকৃতিকভাবেই কাজ করবে। তবে আরও এক বছর দেখার পর বলা যাবে, এটি হিমাগারের মতো কাজ করবে কি না। অল্প খরচে সুরক্ষা: এই হিমাগারে কৃষক অল্প খরচে ফসল সংরক্ষণ করতে পারবেন। ৮৫ কেজির এক বস্তা আলু এখন হিমাগারে রাখতে কৃষকের ৩৫০ টাকা লাগে। এই হিমাগারে লাগবে মাত্র ১০০ টাকা। দেশে আদা ও পেঁয়াজের কোনো সংরক্ষণাগার নেই। এ জন্য কৃষকের ঘরে পেঁয়াজ ও আদা ৬০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। এই হিমাগারে আদা, পেঁয়াজ ছাড়াও এক মাসের জন্য মরিচ, বেগুন, ফুলকপি ও বাঁধাকপি সংরক্ষণ করা যাবে। নির্মাণসামগ্রী: হিমাগারটি তৈরি করতে সময় লেগেছে ছয় মাস। নির্মাণকাজ শুরু হয় গত ২৮ এপ্রিল। ৩০০ টন ধারণক্ষমতার তিনতলাবিশিষ্ট এই হিমাগারের আয়তন এক হাজার ৭০০ বর্গফুট। বাইরের আয়তন ৬০ বাই ৩০ ফুট। আর ভেতরের ৫৮ বাই ২৮ ফুট। তৈরির উপকরণ হচ্ছে বাঁশ, খড়, টালি, বালু ও সিমেন্ট। এর মধ্যে বাঁশ হচ্ছে ৬০ ভাগ। ১২ ভাগ খড় আর বাকি অংশ ইট-বালু-সিমেন্ট। হিমাগারের ছাউনি দেওয়া হয়েছে খড়ের। দেয়াল তৈরি করা হয়েছে ইট দিয়ে। দেয়াল প্লাস্টার না করে তার ওপর টালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তিটি কাজ করে যেভাবে: দেয়াল ও টালির মাঝখানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে। ফাঁকা অংশে বালু ও পানি থাকবে। এখান থেকে জলীয় বাষ্প তৈরি হবে। এই প্রক্রিয়ায় ঘরের ভেতরের তাপ শোষণ করা হবে। হিমাগারের ভেতরে তিনতলাবিশিষ্ট বাঁশের মাচা তৈরি করা হয়েছে। ওপরে ওঠার জন্য বাঁশের সিঁড়ি বানানো হয়েছে। নিচতলা থেকে ঠান্ডা বাতাস যাতে প্রাকৃতিক উপায়ে ওপরে উঠে যায়, সে জন্য দেয়ালের নিচের দিকে একটু করে ফাঁকা রাখা হয়েছে। সেখান দিয়ে বাইরের গরম বাতাস ভেতরে ঢুকে প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা বাতাসকে ঠেলে ওপরে নিয়ে যাবে। হিমাগারের ভেতরে যাতে অন্ধকার না হয়, সে জন্য তৃতীয় তলার ওপরে দুই পাশে দুটি কাচের জানালা আছে। আর কখনো নিচের ঠান্ডা বাতাস যদি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ওপরে না ওঠে, সেই ঠান্ডা বাতাস ওপরে তোলার জন্য দুটি ফ্যানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই ফ্যান সোলার প্যানেলের সাহায্যে চালানো হবে। পথ প্রদর্শক: এম মনজুর হোসেন জানান, দিনাজপুরের এক ব্যক্তি ভারতে দেখে এসে একটি প্রাকৃতিক হিমাগার তৈরি করেছেন। তাতে মেঝেতে পানি দিয়ে রাখতে হয়। পানির কারণে ঘর যতটুকু ঠান্ডা থাকে, তাতেই যতটুকু কাজ হয়। এটা দেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান তাঁকে ডেকে পাঠান। তিনি তাঁকে আধুনিক প্রযুক্তির একটি প্রাকৃতিক হিমাগার তৈরি করতে বলেন। এ জন্য তিনি একটি প্রকল্প প্রস্তাব দিতে বলেন। তিনি ১৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠান। এরপর করপোরেট রেসপনসিবিলিটি ফান্ড (সিআরএফ) থেকে ১৪ লাখ টাকা দেওয়া হয়। মনজুর বলেন, প্রথমবার পরীক্ষামূলকভাবে কাজ করার জন্য ব্যয় বেশি হয়েছে। পরেরবার ব্যয় আরও কম হবে। ঘরামির বক্তব্য: রাজশাহী নগরের মুশরইল এলাকার মিছের আলী নামের একজন ঘরামি এই কাজ করেছেন। তিনিই খড়ের ছাউনি ও ভেতরের বাঁশের কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ছাউনির জন্য চিকন উলুখড় আনা হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আর বাঁশ আনা হয়েছে রংপুর থেকে।
No comments:
Post a Comment