Saturday, December 20, 2014

দশে মিলে করি কাজ:প্রথম অালো

স্বেচ্ছাশ্রমে নিজের গ্রামের সড়ক মেরামত ও বাঁশের সাঁকো তৈরি করেন তাঁরা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন নিজেদের এলাকা। অভাব জয়ে লড়াই করেন একসঙ্গে। অভাবী শিশুদের শিক্ষা উপকরণ দেওয়া, বাল্যবিবাহ বন্ধ, চিকিৎসায় সহায়তাসহ নানা কাজ তাঁরা করেন জোট বেঁধে। তাঁদের এই জোটবদ্ধ করেছে একটি সমবায় সমিতি। এই সমিতির উদ্যোক্তা একজন—মেহেদুল রহমান মিদুল। গ্রামের লোকজনকে নিয়ে সমিতি গঠনের মধ্য দিয়ে মিদুলের আলো ছড়ানোর শু
রু। এরপর ধীরে ধীরে আঁধার কাটিয়ে আলোকিত হয়ে উঠছে গ্রামটি। বলা হচ্ছে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার জাহাঙ্গীরাবাদ গ্রামের কথা। শুরুর কথা: উপজেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের ওই গ্রামটিতে হাজার তিনেক মানুষের বাস। বছর দশেক আগেও বেশির ভাগ মানুষ ছিলেন দিনমজুর। গ্রামের বাইরে গিয়ে কাজ পেলে খাবার জুটত, না হলে উপোস। গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মিদুল। খুব কাছ থেকে দেখা গ্রামের মানুষের এমন কষ্ট তাঁকে নাড়া দিত। ২০০২ সালের কথা। গ্রামের নিলুফা বেগমের স্বামী আফজাল হোসেন তিন সন্তান রেখে মারা যান। নিলুফা পাশের শাহপুর গ্রামের একজনের কাছ থেকে চড়া সুদে দুই হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মুড়ির ব্যবসা শুরু করেন। একদিন গাছ থেকে পড়ে বড় মেয়ে আয়েশার পা ভেঙে গেলে নিলুফা ওই টাকায় মেয়ের চিকিৎসা করান। পাঁচ মাসেও লাভ-আসল কিছু দিতে না পারায় ঋণদাতা সেই ব্যক্তি নিলুফারের একমাত্র টিনের চালাটি ভেঙে নিয়ে যান। বিষয়টি গভীরভাবে নাড়া দেয় মিদুলকে। তিনি নিজের দুটি ছাগল বিক্রি করে পাওয়া দুই হাজার টাকা ব্যবসা করতে দেন নিলুফাকে। এক বছরে ঘুরে দাঁড়ান নিলুফা। আশাবাদী হন মিদুল। গ্রামের অন্যদের অভাব দূর করতে কিছু একটা করার কথা ভাবেন। সেই ভাবনা থেকে সমিতি গড়ার চিন্তা মাথায় আসে। বিষয়টি গ্রামের মানুষকে বোঝাতে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর ডাকে সাড়া দেন গ্রামের নারী-পুরুষ। সাফল্যের পথে: ২০০২ সালের ২০ জানুয়ারি। মিদুল ১৫০ জন নারী-পুরুষকে নিয়ে গঠন করেন ‘জাহাঙ্গীরাবাদ সমাজ কল্যাণ সমিতি’। সিদ্ধান্ত হয়,¯নিজেদের জমানো টাকা চার বছর পর সদস্যরা ভাগ করে নেবেন। জমানো টাকা থেকে ঋণও নিতে পারবেন সদস্যরা। সপ্তাহে ২০ টাকা করে জমানো শুরু করেন তাঁরা। মিদুল জানান, শুরুর দিকে সদস্যরা প্রতিদিন রান্না করার চাল থেকে দু-এক মুঠো চাল জমিয়ে টাকা জোগাড় করেছেন। এভাবে চার বছরে সমিতির সঞ্চয় আর এই সময়ের মধ্যে বিনিয়োগ করে পাওয়া লাভে সমিতির তহবিলে জমা হয় ১২ লাখ টাকা। ২০০৬ সালে সদস্যরা সেই টাকা ভাগ করে নেন। ওই টাকা নিয়ে কেউ করলেন ধান-চালের ব্যবসা; কেউ কিনলেন গাভি, ছাগল, রিকশা-ভ্যান; কেউবা করলেন মুদির দোকান। এভাবে সমিতির সদস্যরা স্বাবলম্বী হতে থাকেন। ২০০৬ সালে সমবায় সমিতি হিসেবে নিবন্ধন নিয়ে সদস্যদের সিদ্ধান্তে সাপ্তাহিক জমার পরিমাণ করা হয় ৪০ টাকা। এ সময় পুরোনো সদস্যদের সঙ্গে আরও নতুন কিছু সদস্য যুক্ত হন। ২০১০ সালে আবার তাঁদের মধ্যে জমানো টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে থাকেন সদস্যরা। বর্তমানে এই সমিতির সদস্য রয়েছেন ৪২০ জন। সমিতির তহবিলে জমা আছে ১৮ লাখ টাকা। দ্বিতীয় মেয়াদের সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মিদুল। সমিতিতে একদিন: সম্প্রতি এক সকালে সেই সমিতিতে গিয়ে দেখা গেল, সদস্যরা মিদুলের কাছে সাপ্তাহিক চাঁদার টাকা জমা দিচ্ছেন। এ সময় কথা হয় রশিদা বেগম, মরজিনা খাতুন, শারমিন বেগমসহ অনেকের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, সমিতির আয়ের মূল উৎস গরু মোটাতাজাকরণ ও মাছ চাষ। ইজারা নেওয়া চার একরের পাঁচটি পুকুর থেকে আসা টাকা সমিতির তহবিলে জমা হচ্ছে। ১৫ কিলোমিটার সড়কে লাগানো গাছ এবং ১২ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে লাগানো ঔষধি গাছের পাতা বিক্রির একটি অংশও তহবিলে জমা হয়। সমিতির সদস্য সুলতানা বেগমের বাড়িতে দুটি টিনের ঘর রয়েছে। গোয়ালে আছে গাভি ও ছাগল। তিনি জানালেন, একসময় তাঁর খড়ের ঘর ছিল, এখন টিনের ঘর হয়েছে। চাষবাসের জন্য তিনি ৫০ শতক জমি বন্ধক নিয়েছেন। সবজির ব্যবসা করছেন তাঁর স্বামী মনোয়ার হোসেন। সব হয়েছে সমিতিতে যোগ দেওয়ার পরে। বিদ্যালয়মুখী করা ও পাঠদান: শুধু অভাব দূর করা নয়, ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সমিতির পক্ষ থেকে ২০০৭ সালে চালু করা হয় একটি শিক্ষাকেন্দ্র। গ্রামের শিশুরা এই কেন্দ্রে লেখাপড়া শিখে পরে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। নিরক্ষর নারী-পুরুষদেরও এ কেন্দ্রে লেখা শেখানো হয়। শিক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে মাসে দুই হাজার টাকা ভাতা দেয় সমিতি। গ্রামের শিশুদের শতভাগ স্কুলমুখী করতে সমিতির উদ্যোগে ১৫ জন নারী ও একজন পুরুষকে নিয়ে একটি শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির সদস্যরা শিশুদের শিক্ষার বিষয়টি ছাড়াও ঘরে ঘরে গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে নারীদের ধারণা দেন। শিশুদের সময়মতো টিকা দেওয়া হয়েছে কি না, তার খোঁজ নেন। সমিতির পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ১১৩ জন শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে খাতা-কলম, ব্যাগ দেওয়া হয়েছে। চার বছর ধরে জেএসসি, এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। চিকিৎসা সহায়তা: সমিতির খরচে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে সদস্যদের একটি পরিচয় কার্ড দেওয়া হয়েছে। গ্রামে কারও রক্তের প্রয়োজন হলে তাঁরা স্বেচ্ছায় রক্ত দেন। অসচ্ছল রোগীদেরও হাসপাতালে নেওয়া এবং ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়। সমিতি থেকে চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে অন্তত চারজনকে চার শ টাকা দেওয়া হয়। বাল্যবিবাহ দূর: ২০০৭ সালে গ্রামের সাইদুল ইসলাম তাঁর ১২ বছরের শিশুকন্যার বিয়ের আয়োজন করেন। শুনে মিদুল বাড়িতে গিয়ে বিয়ে বন্ধের অনুরোধ করেন। সাইদুল গালমন্দ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন মিদুলকে। মিদুল সমিতির সদস্য ও প্রতিবেশীদের ডেকে এনে বাল্যবিবাহের বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। শেষ পর্যন্ত সাইদুল মেয়ের বিয়ে বন্ধ করতে রাজি হলেও শর্ত দেন, বিয়ের আয়োজন করতে যে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে, তা দিতে হবে। মিদুল শর্ত মেনে নিয়ে শিশুটিকে বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা করেন। এর পর থেকে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই চলছে। এই লড়াইয়ে মিদুলের সঙ্গে কাজ করছেন সমিতির সদস্যরা। গত ছয় বছরে ২১টি শিশুকে এই অভিশাপ থেকে রক্ষা করেছেন তাঁরা। সমিতির তহবিল থেকে অসচ্ছল পরিবারের ৩৭ মেয়ের বিয়েতে সহযোগিতা করা হয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান: মাসে একবার সমিতির সদস্যরা জোটবদ্ধ হয়ে ডালি, কোদাল, ঝাড়ু নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পরিষ্কার করেন ইউনিয়নের জনবহুল গুরুত্বপূর্ণ কোনো জায়গা। সম্প্রতি তাঁরা জাহাঙ্গীরাবাদ উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের সড়ক পরিষ্কার করেছেন। তাঁরা যা বলেন : পাঁচগাছি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, মিদুল সমিতির তহবিল থেকে ঈদ ও পূজায় আশপাশের গ্রামের অভাবীদের কাপড়, টাকা, সেমাই, চিনি এবং শীতে কম্বল বিতরণ করেন। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন বলেন, ওই সমিতির কর্মকাণ্ড প্রশংসার দাবিদার। উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আর দশটা সমিতির চেয়ে এ সমিতির কাজ বেশ আলাদা। এটি সমবায় অধিদপ্তরে নিবন্ধনভুক্ত এবং উপজেলার মধ্যে এক নম্বর সমিতি। মিদুলের কথা: গ্রামের কৃষক মহব্বর আলীর ছেলে মিদুল দুই ভাইয়ের মধ্যে বড়। পড়াশোনা করেছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তিনি ২০১০ সালে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম লাকী বেগম। তাঁর একমাত্র সন্তান লামীম হোসেন, বয়স এক বছর। মিদুল জানান, স্বপ্ন দেখতেন একটি অভাবমুক্ত সমাজের। গ্রামের মানুষকে স্বাবলম্বী করার কাজে অনেক আঘাত এসেছে কিন্তু তিনি পিছু হটেননি। এখন তাঁর স্বপ্ন—গ্রামে কৃষিভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সমিতির মাধ্যমে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।

No comments:

Post a Comment