Saturday, December 20, 2014

উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি রাজনীতি:প্রথম অালো

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি রাজনীতি। দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মকাণ্ড আধুনিক ও সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে দল দুটির রাজনৈতিক আচরণ এ পর্যন্ত অর্জিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘শাসন পরিস্থিতি, বাংল
াদেশ ২০১৩: গণতন্ত্র, দল, রাজনীতি’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এ কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিকাশ কেন পিছিয়ে আছে, তা বের করাই এই গবেষণার উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আজ শনিবার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার কথা রয়েছে। জরিপ, সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার, গুণগত ও পরিমাণগত গবেষণায় পাওয়া ফলাফলের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনে বিশ্লেষণগুলো করা হয়েছে। প্রতিবেদনে দেশে একচ্ছত্র দলতন্ত্রের বিকাশ এবং এর ফলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা তুলে ধরা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বেড়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক সংঘাত। এই সংঘাতের ক্ষেত্রে বরাবরই এগিয়ে আছে ক্ষমতাসীন দল। এ ছাড়া দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে কারা আসছেন, কেন আসছেন, তার পর্যালোচনাও আছে এ প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, রাজনীতিতে এখন ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের অবস্থা রমরমা। ব্যবসায়ীদের আনা হচ্ছে, কারণ তাঁরা দলের জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারেন। তা ছাড়া দেশে রাজনীতির মূলধারায় নারীর অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যায়ন আছে প্রতিবেদনে। রাজনৈতিক অগ্রগতির বাধা একচ্ছত্র দলতন্ত্র: গবেষণায় দেশের রাজনৈতিক পরস্থিতির একটি উদ্বেগজনক বিষয় উঠে এসেছে, তা হলো বহুদলীয় গণতন্ত্র থেকে একচ্ছত্র দলতন্ত্রের বিকাশ। রাষ্ট্রগঠন, গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা ও আইনের শাসন—রাজনৈতিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় এই তিন সূচকের নাজুক অবস্থা থেকেই দলতন্ত্রের বিষয়টি পরিষ্কার। সরকার ও বেসরকারি সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের ওপর একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রকট। বড় দলগুলো ‘সফলভাবে’ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেদের ‘দখলে’ নিয়েছে এবং এর মাধ্যমে তারা ওই সব প্রতিষ্ঠানের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের পক্ষে কাজ করিয়ে নিতে পারছে। সুশীল সমাজ, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন, পুলিশ বাহিনী এবং জেলা পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ওপর পড়েছে দলতন্ত্রের প্রভাব। সুশীল সমাজ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দলীয়করণ এবং স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব দুর্বল হয়ে পড়ায় রাজনীতিতে বহুমতের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এতে করে দলগুলোর কর্তৃত্ববাদী প্রবণতাও বেড়েছে। এ পরস্থিতির প্রভাব পড়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের ওপরও। এই একচ্ছত্র দলতন্ত্রের ভয়ানক প্রভাব পড়েছে দেশের সুশীল সমাজের ওপর। একসময়ের সেই সরব সুশীল সমাজ এখন মিইয়ে গেছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যাদের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তারা এখন অকেজো, বিশেষ করে গত কয়েক বছরের চিত্র এটাই। রাজনৈতিক অগ্রগতিতে বাধা দলীয় কর্মকাণ্ড দলে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও চর্চার ফারাক: গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং তার চর্চার মধ্যে বিস্তর ফারাক। এর থেকে বোঝা যায়, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি তাদের অঙ্গীকার খুবই দুর্বল। আদর্শের ক্ষেত্রে দলের ভেতরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি জোরদার করতে পারেনি। আর চর্চার ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে দলের মধ্যে প্রতিযোগিতার বিষয়টি কেন্দ্র থেকে ভালোভাবে নেওয়া হয় না। আদর্শ ও তা চর্চার বিভক্তি থাকলে গণতান্ত্রিক সুশাসন ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসনে পরিণত হওয়া ঝুঁকি থাকে। বেড়েছে হানাহানি: ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশে রাজনৈতিক সংঘাত ৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। হানাহানিতে সব সময় এগিয়ে আছে ক্ষমতাসীন দল, সেটা প্রধান দুই দলের যে যখন ক্ষমতায় থাকে। আর এ ধরনের হানাহানির বেশির ভাগ ঘটে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে। রাজনৈতিক এই সংঘাতের কারণ আদর্শগত সমন্বয়ের অভাব। এসব হানাহানি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সুপারিশে বলা হয়, দলের শীর্ষ নেতাদের এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে করে দলের মধ্যকার সব মতের নেতা-কর্মীরা তাদের পাশে আসতে পারেন। মুক্তচিন্তা ও বিতর্কের সুযোগ পান। একই সঙ্গে দলের মধ্যে যাঁরা মৌলিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো লঙ্ঘন করবেন, তাঁদের জবাবাদিহি ও শাস্তির ব্যবস্থাও করতে হবে। পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ: বর্তমানে রাজনীতিতে ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের অবস্থা রমরমা। দলীয় সদস্যদের পরিচয় পর্যালোচনা, জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব, বাজেট বক্তৃতায় অংশগ্রহণ, সংসদীয় কমিটিতে প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনীতিকের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য এখন আর সার্বিক রাজনৈতিক বিকাশে কাজে লাগছে না। এমনিক দলের কোন নেতা সংসদে সরব হবেন, তাও ঠিক করে দিচ্ছে দলগুলো। এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে, সেসব ব্যবসায়ী ও নেতারাই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন, সংসদে যাদের উপস্থিতি কম। স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলো সেসব লোকজনকেই দলে ভেড়াচ্ছে উদ্দেশ্য সাধনে, যাঁদের কাজে লাগানো যাবে। পরামর্শে বলা হয়, দলীয় নেতৃত্বের জন্য রাজনীতিবিদের সার্বিক জীবনচরিত পর্যালোচনা করা জরুরি। তাহলে ‘নেতা কে হবে’ আর তাদের ‘আচরণ হবে কেমন’—এসব বিষয়ে বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড় করানো যাবে। আর কেবল তখনই দলীয় নেতা এবং তাঁদের চরিত্রের মধ্যে একটি মেলবন্ধন খুঁজে বের করা যাবে। নারীর অংশগ্রহণ হতাশাজনক: প্রধান দুই দলে নেতৃত্ব পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ খুবই হতাশাজনক। প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীরা শুধু ব্যবহৃত হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী হিসেবে। আর দলের নীতিনির্ধারণী শীর্ষ পর্যায়ে কর্তৃত্ব করছেন পুরুষেরা। সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির কারণে যে এমনটা ঘটছে, তা নয়। বরং রাজনৈতিক দলগুলো ইচ্ছাকৃতভাবেই তা করছে। কেননা, পুরুষের কাছ থেকে দলের জন্য অর্থের জোগান পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অর্থায়নে স্বচ্ছতা প্রয়োজন: উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক দলের অর্থায়ন কীভাবে হয়, সে সম্পর্কিত গবেষণা করে দেখা গেছে, এ বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বাংলাদেশেও একই অবস্থা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দলগুলো আগের চেয়ে এখন আরও বেশি হারে ব্যবসায়ীদের নিয়ে আসছে। কারণ, দলের প্রত্যাশা থাকে, ব্যবসায়ীরা দলের জন্য অর্থের সংস্থান করবেন। প্রধান দলগুলো দাবি করে, দলের সদস্য ফি-ই জেলা পর্যায়ে অর্থসংস্থানের প্রধান পথ। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দলগুলো তাদের ব্যয় নির্বাহের জন্য মূলত বেসরকারি খাতের অনুদানের ওপরই নির্ভরশীল। প্রয়োজন জাতীয় সংলাপ: সার্বিক পরিস্থিতি আলোচনার পর প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়, দেশের গণতন্ত্র বর্তমানে যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন জাতীয় সংলাপ। তা না হলে গণতান্ত্রিক অর্জন পশ্চাদমুখী হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, দেশে এখন যে গণতন্ত্র আছে, তাতে কার কী অসুবিধা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এক হাতে তালি বাজে না। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল সরকারেরই একটি অংশ। বিএনপি নির্বাচনে না এলে আমরা কী করব? তারা যদি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংলাপে আসত, তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধী দলের কর্ম সম্পর্কে একটা নতুন মাইলফলক রচিত হতো। গণতন্ত্রচর্চা এবং নির্বাচনী রাজনীতিতে এর প্রভাব হতো সুদূরপ্রসারী।’ ওবায়দুল কাদের দাবি করেন, ‘রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রের চর্চা যেটুকু আছে, তা আওয়ামী লীগেই আছে। বিএনপি ইচ্ছা করলেই দলে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগে সে সুযোগ নেই। তবে আমরা যে একেবারে বিশুদ্ধ, এ কথা বলব না। ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে।’ দুই প্রধান দলের অগণতান্ত্রিক চর্চায় দেশের বিচার ও শাসনব্যবস্থায় সংকটের বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কেউই ধোয়া তুলসীপাতা নয়। ১৯৭৫ সালের পর যেভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নষ্ট করা হয়েছে, সেগুলোকে আবার ট্র্যাকে আনতে হলে রাতারাতি সম্ভব নয়। এর জন্য সময় লাগবে।’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, তাতে গণতন্ত্র ব্যাহত হতে পারে। এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়েছেও।’ তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বাকশাল গঠনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের ওপর প্রথম আঘাত আসে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে গণতান্ত্রিক চলার পথ আবারও ব্যাহত করে তারা। বিএনপির এই নেতা স্বীকার করেন, এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রচর্চার অভাব রয়েছে। তবে এর জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করেন তিনি।

No comments:

Post a Comment