Wednesday, December 17, 2014

স্কুল শিশুদের রক্তে ভাসল পাকিস্তান:কালের কন্ঠ

সকাল সাড়ে ১০টা। হঠাৎ বোমার বিকট শব্দে কেঁপে ওঠল ‘আর্মি পাবলিক স্কুল’। সঙ্গে মুহুর্মুহু এলোপাতাড়ি গুলি। একটু আগেও যেসব শিশু ছাত্রছাত্রী ক্লাসের পড়া বা শরীর চর্চা শিক্ষ
ায় ছিল মনযোগী, প্রাণবন্ত ও উচ্ছল, তারাই এখন চিৎকার ও আর্তনাদ করতে করতে প্রাণভয়ে ছুটছে দিগি¦দিক। ছুটছেন শিক্ষক-কর্মচারীরাও। কিছু সময়ের মধ্যেই তাদের কেউ কেউ গুলি ও বোমায় রক্তাক্ত, কেউ কেউ নিথর। এখন স্কুলের সর্বত্র ছোপ ছোপ করছে তাজা রক্ত। বাতাসে শুধুই রক্তের গন্ধ। নিষ্পাপ শিশু শিক্ষার্থীদের রক্তস্রোতে যেন ভাসছে পুরো পাকিস্তান। দেশটির খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের রাজধানী পেশোয়ারের ওয়ারসাক রোডে সেনাবাহিনী পরিচালিত স্কুলটিতে গতকাল মঙ্গলবার বর্বর এ হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে তালেবান জঙ্গিরা। এ পর্যন্ত অন্তত ১৪১ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ছাত্রছাত্রীই ১৩২, যাদের বয়স ৯ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। নিহত অন্যরা হলেন শিক্ষক-কর্মচারী। এ ছাড়া হামলাকারী ছয় জঙ্গিও সেনা সদস্যদের গুলিতে নিহত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে। আহত অনেককে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে ঘোষণা করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। লেডি রিডিং হাসপাতালের চিকিৎসক ইজাজ খানা জানান, তাদের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঘটনাস্থলের আশপাশ ও হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের প্রিয়জন-অভিভাবকদের বুকফাটা আর্তনাদ ও আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এদিকে তেহেরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বলেন, ‘হামলাকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না।’ জঙ্গি দমনে করণীয় ঠিক করতে আজ বুধবার সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছেন তিনি। তিনদিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার। স্কুলের বেঁচে আসা শিক্ষক-কর্মচারীদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থাগুলো জানায়, ছয়-সাতজন জঙ্গি সামরিক পোশাক পরে সীমানাপ্রাচীর টপকিয়ে স্কুলটিতে ঢোকে। এরপর তারা বোমা ফাটিয়ে ও মুহুর্মুহু গুলি ছুড়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের জিম্মি করে ফেলে। খবর পেয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও সেনা সদস্যরা স্কুলের দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করলে শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। এ সময় বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া যায়। স্কুলটিতে প্রবেশের জন্য নিরাপত্তা বাহিনী দেওয়াল ধসিয়ে দিতে বিস্ফোরণ ঘটায় বলেও স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে। দীর্ঘ সময়ের অভিযানে স্কুলটির ওপর দিয়ে ঘন ঘন সামরিক হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যায়। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের চিফ মিনিস্টার কে পি পারভেজ খাটকের বরাত দিয়ে পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, নিহত ১৪১ জনের মধ্যে ১৩২ জনই শিক্ষার্থী। প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরের পরিচালক (তথ্য) বাহরামান্দ খান বলেন, ‘নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।’ সাত ঘণ্টা অভিযানের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আসিম বাজওয়া জানান, সেনা সদস্যদের গুলিতে হামলাকারী ছয় জঙ্গি নিহত হয়েছে। স্কুলের ৫০০ শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশকে বের করে আনা সম্ভব হয়েছে। জঙ্গিরা স্কুলের ভেতর অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ফাঁদ তৈরি করায় এ অভিযানে অনেক সময় লেগে যায় বলে জানান তিনি। তবে জঙ্গিদের গুলি বা আত্মঘাতী বোমায় এত শিশুর মৃত্যু হয়েছে, নাকি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে জঙ্গিদের বন্দুকযুদ্ধের মধ্যে পড়ে শিশুদের প্রাণহানি বেড়েছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলেননি এই সেনা কর্মকর্তা। স্কুলের কর্মচারী মুদাচ্ছির আওয়ান জিও টিভিকে জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে (বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ১১টা) জঙ্গিরা যখন স্কুলে প্রবেশ করে, তখন স্কুলের অডিটরিয়ামে সেনাবাহিনীর একটি দল শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘গোলাগুলি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ক্লাসরুমের দিকে ছুটে যাই। ওরা প্রতিটি ক্লাসে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।’  প্রত্যক্ষদর্শী এক শিক্ষার্থী জানায়, গোলাগুলি শুরু হতেই শিক্ষকরা তাদের শুয়ে পড়তে বলেন। পরে সেনাবাহিনীর লোকজন তাদের বের করে আনে। বেরিয়ে আসার সময় বারান্দায় সহপাঠীদের অনেকের রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখার কথাও জানিয়েছে ওই শিক্ষার্থী। স্কুলটির বাসচালক জামশেদ খান বলেন, ‘আমরা স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হলে আর্তচিৎকার ও হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়।’ স্কুলটি পাকিস্তানের আর্মি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হয়। দেশজুড়ে এমন ১৪৬টি স্কুল আছে। সেনা সদস্য ও বেসামরিক নাগরিকদের সন্তানরা এসব স্কুলে লেখাপড়া করে। স্কুলের শিক্ষকদের বেশির ভাগই সেনা সদস্যদের স্ত্রী। পাকিস্তানে গত কয়েক বছরের মধ্যে ভয়ংকরতম এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনসহ বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান। শেখ হাসিনা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এই বর্বর ও ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড সারা বিশ্বের মানুষকে শোকাহত ও স্তম্ভিত করেছে।’ দেশটির নারীশিক্ষা আন্দোলনের কর্মী ও শান্তিতে নোবেলজয়ী কিশোরী মালালা ইউসুফজাই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছেন, পেশোয়ারে জ্ঞানবুদ্ধিহীন ও ঠাণ্ডা মাথায় ঘটানো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের যে চিত্র আমাদের সামনে উন্মোচিত হলো, তাতে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে।’ খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে ক্ষমতাসীন দল তেহরিক-ই-ইনসাফের প্রধান ইমরান খানও হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। বিকেলের দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছান নওয়াজ শরিফ ও সেনাবাহিনী প্রধান রাহিল শরিফ। তালেবানের দায় স্বীকার : উত্তর ওয়াজিরিস্তান ও খাইবার উপত্যকায় সামরিক বাহিনীর অভিযানের জবাবেই এই হামলা- উল্লেখ করে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) মুখপাত্র মুহাম্মদ ওমর খোরাসানি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা হামলার জন্য সেনাবাহিনীর স্কুলকেই বেছে নিয়েছি, কারণ সরকার আমাদের পরিবার ও নারীদের হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছে। আমরা চাই, তারাও ওই ব্যথা অনুভব করুক।’    বিবৃতিতে খোরাসানি আরো বলেন, ছয়জন তালেবান যোদ্ধা এই হামলায় অংশ নিয়েছে। তাদের মধ্যে স্নাইপার ও আত্মঘাতী হামলাকারীও আছে। হামলাকারীদের স্কুলের বড় শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছোড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে শিশুদের ওপর গুলি না ছোড়ার কথা বলা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ওই দুটি এলাকায় জঙ্গি দমনে সেনা অভিযানে কয়েক হাজার তালেবান নিহত হয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের অক্টোবর ও নভেম্বরে পাকিস্তানের দুটি বালিকা বিদ্যালয়ে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। আর ২০১৩ সালে ৭৮টি স্কুলে হামলা চালায় আধুনিক ও নারীশিক্ষার বিরোধী ধর্মান্ধ তালেবান জঙ্গিরা।

No comments:

Post a Comment