Friday, December 19, 2014

বনের খাদ্যচক্র ক্ষতির মুখে:প্রথম অালো

সুন্দরবনের প্রাণিকুলের পাশাপাশি খাদ্যচক্রের ওপরও ফার্নেস তেলের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। শ্যালা নদী ও পশুর নদের পানিতে দ্রবীভূত তেলের পরিমাণ বিপজ্জনক মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে বনের খাদ্যচক্রের প্রাথমিক স্তর অর্থাৎ ক্ষুদ্র প্রাণী ও উদ্ভিদকণা মারা যাচ্ছে। ৯ ডিসেম্বর তেলের ট্যাংকারডুবির ঘটনার পর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ সুন্দরবনের ১৫টি স্থান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে। ১০ সদস্যের
গবেষক দলটি তেল ছড়িয়ে পড়া ৬০ কিলোমিটার এলাকা পর্যবেক্ষণ করে বনের খাদ্যচক্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এই চিত্র দেখতে পেয়েছে। এ ঘটনায় ৩৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় কয়েক লাখ লিটার তেল ছড়িয়ে পড়ে। তবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বলছে, ‘সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদ আশঙ্কামুক্ত’। সুন্দরবনের নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ দেখে তারা এই মতামত দিয়ে গণমাধ্যমে গত সোমবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে। আবার মন্ত্রণালয়ের অধীন বন বিভাগ বুধবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, তেল ছড়িয়ে পড়ার পর তারা সুন্দরবনে মৃত প্রাণীর সন্ধান পেয়েছে। সুন্দরবন গবেষকেরা মন্ত্রণালয়ের দাবিকে ‘অবৈজ্ঞানিক ও প্রতারণামূলক’ হিসেবে মনে করছেন। তাঁরা বলেছেন, সুন্দরবনের যা ক্ষতি হয়েছে, তা স্বীকার করে নিয়ে এর সমাধান খোঁজা উচিত। সুন্দরবনে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সভাপতি নুরুল করীমের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সুন্দরবন এলাকা পর্যবেক্ষণ করেছি। পরিবেশ অধিদপ্তর বনের পানি পর্যবেক্ষণ করেছে। ডলফিন বিশেষজ্ঞ স্মিথসহ অন্যদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বনের পানি প্রাণীদের জন্য আশঙ্কামুক্ত রয়েছে।’ মন্ত্রণালয় সুন্দরবনকে আশঙ্কামুক্ত বললেও বনের ক্ষতি নিরূপণে সরকারের আমন্ত্রণে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ থেকে একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে এসেছে। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে তারা কাজ শুরু করবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি বিশেষজ্ঞ দলও খুব শিগগির সুন্দরবনের ক্ষতি নিরূপণে আসবে বলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ক্ষতি সম্পর্কে এখনই কোনো মন্তব্য করা যাবে না। গবেষণা করে বলা যাবে, কী ক্ষতি হয়েছে বা হয়নি। মন্ত্রী লিমায় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন থেকে গতকালই দেশে ফিরেছেন। খাদ্যচক্রে বড় ক্ষতি: তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় সুন্দরবনে কী প্রভাব পড়ছে, তা নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে বছরব্যাপী একটি গবেষণা শুরু হয়েছে। এই গবেষণার আওতায় ১১ ডিসেম্বর থেকে বনের ১৫টি স্থান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। সুন্দরবনের ওপর বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় প্রতি লিটার পানিতে ৩০০ থেকে ৪০০টি উদ্ভিদকণা এবং ২০ থেকে ৩০টি প্রাণিকণা থাকে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রতি লিটার পানিতে ২০ থেকে ৩০টি উদ্ভিদকণা এবং এক থেকে দুটি প্রাণিকণা পাওয়া গেছে। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনে স্বাভাবিকভাবে প্রতি বর্গমিটারে ১০ থেকে ১৫টি শামুক থাকে। তেল ছড়িয়ে পড়ার পর পাওয়া গেছে দুই থেকে চারটি, তা-ও মৃত। শীতের এই সময়ে শ্যালা নদী ও পশুর নদে পাইস্যা মাছ ডিম পাড়ে। এই সময়ে পানির ওপর ডিম ও লার্ভা ভেসে থাকে। গত পাঁচ দিনে পানি পরীক্ষা করে কোনো এলাকাতেই ওই ডিম ও লার্ভা পাওয়া যায়নি। অধ্যাপক আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ মেপে কেউ যদি সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদ আশঙ্কামুক্ত বলে, তাহলে তা হবে প্রতারণামূলক। কেননা, জোয়ার-ভাটা হয় এমন নদীতে, যেখানে যত বড় দুর্যোগই হোক, অক্সিজেনের পরিমাণ এমনিতেই বেশি থাকে। ফলে শুধু দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ দিয়ে প্রাণী ও উদ্ভিদ আশঙ্কামুক্ত বলাটা গবেষণার দৃষ্টিতে প্রতারণামূলক। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) এবং যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবিষয়ক জাতীয় সংস্থা ইপিএর মানমাত্রা অনুযায়ী, প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত রাসায়নিকের পরিমাণ ১০ মিলিগ্রামের বেশি হলেই তা প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় পশুর নদ ও শ্যালা নদীর পানিতে দ্রবীভূত তেলের পরিমাণ ৫০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত পাওয়া গেছে। এ ধরনের পানিতে ছোট মাছের প্রধান খাদ্য উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা বাঁচতে পারে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিজ্ঞানের সাধারণ সূত্র অনুযায়ী পূর্ব সুন্দরবনের তেল ছড়িয়ে পড়া এলাকায় প্রাণীদের একটা বড় অংশ মারা যাবে বা ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে যাবে। কেননা উদ্ভিদকণা, প্রাণিকণা, কাঁকড়া, শামুকের দেহে ওই তেল প্রবেশ করে অক্সিজেন গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করবে। এতে এরা মারা যাবে। শ্বাসমূলীয় বনের শ্বাসমূলে অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে, যা দিয়ে তারা নিঃশ্বাস নেয়। তেলের কারণে তারা ধীরে ধীরে মারা যেতে পারে। প্রাণিবিদ্যার খাদ্যশৃঙ্খল অনুযায়ী, সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান বা খাদ্যচক্রের প্রাথমিক স্তর হচ্ছে উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা। বনের সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রাণী ছোট মাছ, কাঁকড়া ও শামুক এই কণাগুলো খেয়ে বেঁচে থাকে। ছোট মাছ আবার মাঝারি ও বড় মাছ এবং পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর প্রধান খাবার। পাখি আর হরিণ হচ্ছে শক্তিশালী প্রাণী বাঘের খাবার। ফলে উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা মারা গেলে সর্বস্তরের প্রাণীদের খাদ্য জোগান বন্ধ হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক পরিসরে শ্বাসমূলীয় বন এবং সুন্দরবন নিয়ে ২৫ বছর ধরে গবেষণা করছেন জুনায়েদ কে চৌধুরী। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বনে তেল ছড়িয়ে পড়ার প্রভাব নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘বিশ্বে যত ধরনের বন আছে তার মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল হচ্ছে শ্বাসমূলীয় বা ম্যানগ্রোভ বন। তেল ছড়িয়ে পড়ায় এমন অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে, তা হয়তো আগামী দু-এক মাস তো নয়ই, দু-তিন বছরেও বোঝা যাবে না। হয়তো ১০-২০ বছর পর আমরা দেখতে পাব, বনের কোনো একটি প্রাণীকে আর দেখা যাচ্ছে না।’ তেল ছড়িয়ে পড়ায় সুন্দরী গাছ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

No comments:

Post a Comment