তাঁর ছবির একটা অসামান্য বৈশিষ্ট্য ছিল, দেখলেই বোঝা যেত, ওই ছবিটা ফুটিয়ে তুলেছে বাংলাদেশকেই। কথাটা তাঁকে আমি বলেওছিলাম। সাংবাদিক সায়মন ড্রিংকে একবার মুক্তিযুদ্ধে জাদুঘরে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, তখন তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা একটা তৈলচিত্র। সবুজ পটভূমি, বাংলার শ্যামল নিসর্গের, তার মধ্যে একটা লালশাড়ি বধূ, আমি বললাম, স্যার, সায়মন ড্রিং একটা ছবি নিয়ে যাচ্ছেন না কেবল, তিনি
এক টুকরা বাংলাদেশকেই নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আমাদের প্রকাশনা জগৎকে সুন্দর করেছেন, তিনি আমাদের বাংলা বর্ণমালাকে তাঁর হস্তাক্ষর দিয়ে সুন্দর করে দিয়ে গেছেন, তিনি আমাদের মাস্টার পেইন্টারদের একজন, তিনি চারুকলা ইনস্টিটিউটের পথিকৃৎ শিক্ষকদের অন্যতম, নক্ষত্রের মতো বিশাল মানুষটি, গত পরশু রাতেও বেঙ্গলের উচ্চাঙ্গসংগীতের আসরে তাঁর সঙ্গে দেখা, আমি তাঁর পেছন থেকে গিয়ে স্পর্শ করলাম, যেমনটা তার আগের রাতেও করেছি। রোজ গেছেন তিনি বেঙ্গলের উচ্চাঙ্গসংগীতের আসরে, পরশু রাতে দেখি, তাঁর দীর্ঘ চুল বেয়ে ঝরে পড়ছে সন্তুরের জলতরঙ্গধ্বনি, তিনি হেঁটে হেঁটে নিজের আসনে গিয়ে বসছেন, মনে হলো সুন্দরের রূপকার মানুষটির সবকিছুই কতই না সুন্দর। আর গত রাতে, মঞ্চে উঠে ভাষণ দিতে গিয়ে ওই শিল্পতীর্থেই, তিনি ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হলো তাঁকে, সেখান থেকেই সংবাদ এল, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আর নেই। ৬৫ বছরের শিল্পসাধনার অবসান হলো ধ্রুপদি সংগীতের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মঞ্চটিতেই। আমাদের মনে পড়বে, ১৯৮৭ সালে আরেক শিল্পগুরু কামরুল হাসানও এমনি করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন জাতীয় কবিতা উৎসবের মঞ্চে। শিল্পই জীবন তাঁদের, মৃত্যুও রচিত হলো শিল্পের ক্যানভাসেই। তিনি ছবি আঁকতেন, তেলরঙে, জলরঙে, কালি ও কলমে, পেনসিলে, কার্টুনও এঁকেছেন তিনি, যুক্ত থেকেছেন প্রকাশনাজগতের সঙ্গে, সাংবাদিকতার সঙ্গে, পুস্তক প্রকাশনার সঙ্গে, বাংলাদেশের বইয়ের প্রচ্ছদকে চিরকালের জন্য সুন্দর করে দিয়ে গেছেন তিনি। মাত্র সেদিনই, প্রথমার বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এবিএম মূসাকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জানালেন, কীভাবে তিনি অবজারভার পত্রিকায় যোগ দিয়েছিলেন এবং সেখানে তাঁর জন্মস্থান (১৯৩২) যে ফেনী, সে তথ্যটা বিশেষভাবে কাজে লেগেছিল। অবজারভার-এ ব্যানার হেডিংয়ের জন্য তাঁর হস্তাক্ষর ব্যবহৃত হতো, সেখান থেকে আজকের প্রথম আলোর মাস্টহেড-সমেত প্রায় প্রত্যেকটা সাময়িকীর লোগোগুলোয় তাঁরই হাতের ছোঁয়া। সে ছুটির দিনেই হোক, কিংবা সাময়িকী হোক। দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন সচিত্র সন্ধানী আর সন্ধানী প্রকাশনীর সঙ্গে। তিনি একাত্তর সালে চারুকারুশিল্পীদের সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক-সমেত দেশি-বিদেশি বহু পুরস্কার আর স্বীকৃতি পেয়েছেন সারা জীবন ধরে। ছিলেন মাটির মানুষ। বাংলাদেশের প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীদের বন্ধু, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক থেকে শুরু করে বহু নাম বলা যাবে সে তালিকায়। চলচ্চিত্র বিষয়ে তাঁর উৎসাহ ছিল, যেমন মাত্র সেদিনই প্রথম আলোর ঈদুল আজহার উপহারে লেখা দিয়েছেন সংগীত বিষয়ে, সংগীত আর চিত্রকলা যে শিল্পেরই দুটো আলাদা উৎসারণ মাত্র, তাঁকে দেখলেই তা বোঝা যেত। জানি না কেন, গত রাত সাড়ে আটটার দিকে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলাম, জয় গোস্বামীর কবিতা উদ্ধৃত করে—এই মালঞ্চ নিয়তিময় ফুল ধরেছে মৃত্যুগাছে, বাইরে যাবার রাস্তা কোথায়, শুধাও না ঝাউপাতার কাছে। যখন লিখছি, তখন কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুগাছে ফুল ফুটছিল। সৈয়দ শামসুল হকের একটা কবিতা আছে, আমার শহর, এখন আমার কাছে এ শহর ধূসর ধূসর বলে মনে হয়, তাতে তিনি বর্ণনা করেছেন, এই শহরে এক সময় জয়নুল আবেদিন হাঁটতেন, কামরুল হাসান পট রাঙাতেন, মুনীর চৌধুরী নাটকের সংলাপ আওড়াতেন, তাঁদের কেউ নেই, ক্রমশ শহরটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন কী বলব, সৈয়দ শামসুল হক? মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে আমরা হারালাম মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, এবিএম মূসা, অধ্যাপক সালাহ্ উদ্দীন আহমেদ এবং কাইয়ুম চৌধুরীকে। এ শহরে আমরা অনাথ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছি কি না। কাইয়ুম চৌধুরীকে ছাড়া আমরা প্রথম আলোর পাতা কীভাবে সাজাব? ঈদসংখ্যা? গল্পের অলংকরণ? প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কার্ড? প্রথমার বইয়ের প্রচ্ছদ? অন্য পত্রিকাগুলোই বা কী করবে? উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠানের মঞ্চে বক্তৃতা দিয়ে নেমে গিয়েছিলেন। আবার উঠেছিলেন আরেকটা কথা বলার আছে বলে। সেটা আর বলতে পারলেন না। সেই কথা আমরা আর কোনো দিনও শুনতে পাব না। কিন্তু তাঁর কাজ রয়ে যাবে, তাঁর স্মৃতি আমাদের জন্য আদর্শ হয়ে রইবে। তিনি প্রথম আলোকে দিয়ে গেছেন পুরো বর্ণমালার ক্যালিগ্রাফি, সেটা ফন্ট হিসেবে আমরা বহুদিন ব্যবহার করতে পারব। তিনি শিল্পের শহীদ, শিল্পে সমাহিত এবং তাঁকে অনুসরণ করবে অমরত্ব।
No comments:
Post a Comment