Tuesday, December 2, 2014

অর্জনে পূর্ণ বসুন্ধরা সিরিজ:কালের কন্ঠ

আলো-ছায়ার খেলা মনে হতে পারে। কিংবা কুয়াশা-রোদ্দুরের লুকোচুরি। ভুল। আসলে আকাশের ওপারের আকাশে কাল অলক্ষে মঞ্চস্থ হয়েছে পরাক্রমশালী যোদ্ধাদের প্রবল লড়াই। আলোর সঙ্গে ছায়ার। কুয়াশার সঙ্গে রোদ্দুরের। তাতে রোদ্দুরের আলো কখনো কখনো ঠিকরে বেরিয়েছে ঠিক, তবে জয় শেষ পর্যন্ত কুয়াশার ছায়ারই। উপুড়-আকাশের নিচে শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের মাঠের সবুজও তখন লড়াইয়ের মঞ্চ। যেখানে বাংলাদেশের দৃশ্যমান প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে। আর
অদৃশ্যে ভিড় করে ২০১৪ সালের বিবর্ণ সব পারফরম্যান্স। কুয়াশায় ঢাকা ছায়া ছায়া ম্যাচগুলো। যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত ক্ষণগুলো। ওই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার পথে অবশ্য কালকের আগেই অনেক দূর এগিয়েছিল বাংলাদেশ। টেস্ট সিরিজে জিম্বাবুয়েকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে, ওয়ানডে সিরিজেও ৪-০ ব্যবধানে এগিয়ে গিয়ে। এর পরও শেষ ভালো না হলে কি আর চলে! রোদ্দুরের আলো যে তখন আর ঠিক উপভোগ্য থাকে না! মাশরাফি বিন মর্তুজার দল হতে দেয়নি তা। জিম্বাবুয়েকে কাল পাঁচ উইকেটে হারিয়ে টেস্টের মতো বসুন্ধরা সিমেন্ট ওয়ানডে সিরিজও বাংলাদেশ জিতল নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্বে। ‘হরিষে বিষাদ’-এর আশঙ্কা তাড়িয়ে ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ করল ঠিকই। ২০১৪-র দুঃস্বপ্ন কবরচাপা দিয়ে ছায়াকে তাড়িয়ে অবশেষে ফুটল আলোর রেখা। কুয়াশা উড়িয়ে উড়ল রোদ্দুরের নিশান। পাঁচ সপ্তাহ আগে শুরু হওয়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে লড়াইয়ের আগে কে ভেবেছিলেন এতটা! প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে, খেলাও ঘরের মাঠে- বাকি সব কাটছাঁট করে এ দুটি তথ্য মাথায় রাখলে অত দূর ভাবায় দোষ নেই কোনো। কিন্তু বাকি সব উপেক্ষার উপায় কোথায়? বিশেষত নিজেদের মাঠেই এ বছর আফগানিস্তান-হংকংয়ের মতো ‘পুঁচকে’দের বিপক্ষে হারের তেতো অতীতটা যখন রীতিমতো বর্তমান। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের আগে তাই আশার বেলুন সাত আসমানে ওড়ানোর সুযোগ ছিল সামান্য! ঘুণে ধরা আত্মবিশ্বাস সামর্থ্যওে মরচে ধরায় কি না-  এ আশঙ্কা বরং আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনকে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুটো ‘বাংলাওয়াশ’ তাই কেবল দুটো সিরিজ জয় নয়। এর চেয়ে ঢের বেশি। বাংলাদেশের ক্রিকেটের বিশ্বাস ফেরানো ফল এই ৩-০ ও ৫-০। সেশনের পর সেশনের গল্পের মালা দিয়ে গাঁথা টেস্ট। উত্থান-পতনের উপস্থিতি সেখানে প্রায় অনিবার্য। নিত্যনতুন চিত্রনাট্যে সেখানে রোমাঞ্চের রেণু ছড়ায় অনেক বেশি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের টেস্ট সিরিজ জয়ও এর বতিক্রম ছিল না। তবে ওয়ানডে সিরিজের চিত্রনাট্য ছিল অনেকটা অনুমেয়। আগে ব্যাটিং করে স্বাগতিকরা আড়াইশর ওপর রান তুলবে, যেখানে কার্যত আঁকা ম্যাচের গতিপথ- প্রথম চার খেলা এগিয়েছে এই চেনা পথেই। ব্যতিক্রম কাল পঞ্চম ওয়ানডেতে। আগে ব্যাটিং করতে নামল জিম্বাবুয়ে। এবং তাতেই জয়ের অচেনা বাতিঘরের আলো যেন ক্রমশ উজ্জ্বল সফরকারীদের জন্য। ১৭ ওভারে ১ উইকেটে ৮৯ রান- এই সফরের বিবেচনায় এটি যে জিম্বাবুয়ের জন্য রীতিমতো স্বপ্নের স্কোর! সেটিকে দুঃস্বপ্নের রূপান্তরিত করতে বেশি সময় অবশ্য নেয়নি বাংলাদেশ। আরো নির্দিষ্ট করে বললে বাংলাদেশের স্পিনাররা। প্রথম চার ওয়ানডেতে তিন পেসার, দুই স্পিনার নিয়ে একাদশ সাজিয়েছে স্বাগতিকরা। সেটি যতটা এই সিরিজের জন্য, এর চেয়ে কম নয় অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপের কথা ভেবে। একাদশে পেসারদের প্রাধান্য থাকলেও জিম্বাবুয়ে বরাবর খাবি খেয়েছে স্পিনারদের বিপক্ষে। আর কাল তো বাংলাদেশ একাদশে তিন স্পেশালিস্ট স্পিনার- সাকিব আল হাসান, জুবায়ের হোসেন ও তাইজুল ইসলাম। এই ত্রয়ী মিলেই কাল ধসিয়ে দিয়েছেন জিম্বাবুয়েকে। এমনভাবেই যে, ১৭.৩ ওভারে ১ উইকেটে ৯৫ রান থেকে ৩০ ওভারে ১২৮ রানের মধ্যে অলআউট তারা। অর্থাৎ এই ১২.৩ ওভারে ৩৩ রান তুলতে শেষ ৯ উইকেট হারায় সফরকারীরা। যে উইকেটগুলো ভাগাভাগি ওই তিন স্পিনারের। শুরুতে সিকান্দার রাজাকে আউট করে ব্রেক থ্রু মাশরাফির। এরপর হ্যামিল্টন মাসাকাদজা-ভুসি সিবান্দার ৭৭ বলে ৭৯ রানের জুটি চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। আগের ম্যাচে অভিষিক্ত লেগ স্পিনার জুবায়ের গুগলিতে মাসাকাদজাকে (৫২) বোল্ড করে ভাঙেন সেই জুটি। পরের দুটি উইকেট সাকিবের। এরপর জুবায়েরের আরেক শিকার। এই ম্যাচে ওয়ানডে অভিষেক হওয়া তাইজুল ইসলাম তখনো উইকেটশূন্য। প্রথম স্পেলটি মন্দ নয় যদিও, ৫-০-১১-০। এরপর দ্বিতীয় স্পেলে এই বাঁহাতি স্পিনার এমন বিধ্বংসী হয়ে উঠলেন যে, প্রথম স্পেলটির কথা মনে রইল কই! ২৭তম ওভারে আক্রমণে ফিরে প্রথম বলে সলোমন মায়ারকে আউট করা দিয়ে শুরু। ওভারের শেষ বলে ফেরালেন টিনাশে পানিয়াঙ্গারাকে। পরের ওভারের প্রথম বলে আরেক শিকারে অনন্য অর্জনের সামনে এসে দাঁড়ান তাইজুল- ওয়ানডে অভিষেকে হ্যাটট্রিক। নির্বোধের মতো তেড়েফুঁড়ে মারতে গিয়ে টেন্ডাই চাতারা ব্যাট ছোঁয়াতে পারলেন না বলে। বল ঠিকই ছুঁয়ে দিল স্টাম্প। হ্যাটট্রিক! এর আগে ৪৩ বছরে হওয়া ৩৫৫৮ ওয়ানডে ম্যাচে তাইজুলের মতো ওয়ানডে হ্যাটট্রিকের কীর্তি নেই কারো। এরপর সাকিব নিজের তৃতীয় উইকেট নিয়ে জিম্বাবুয়েকে থামিয়ে দেন ১২৮ রানে। এবার আগে বোলিং করলেও তাই সেই এক ইনিংস শেষে বাংলাদেশের নিশ্চিত বিজয়ের চিত্রনাট্য লেখা হলো কালও। এরপর যা হয়েছে, সেটি কেবলই হয়তো খেলায় উত্তেজনা নিয়ে আসার জন্য। না হয় ৫৮ রানে চার উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ! চার হাজার ওয়ানডে রানের ক্লাবে না হয় কালও ঢোকা হলো না তামিম ইকবাল (১০), সাকিব আল হাসানদের (০)। আউটের ধরনে ফুটে উঠল এনামুল হকের (৮) অবিবেচনা, অভিষিক্ত সৌম্য সরকারের (২০) অনভিজ্ঞতা। তবু কি আর ১২৯ রান করতে পারবে না বাংলাদেশ! পঞ্চম উইকেট মাহমুদ উল্লাহ ও মুশফিকুর রহিম ঝড় সামাল দিয়েছেন। এরপর মাহমুদ অপরাজিত হাফ সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশের তরীকে ভিড়িয়েছেন তীরে। ২৪.৩ ওভারে পাঁচ উইকেট হারিয়ে জিতে যায় বাংলাদেশ। পূর্ণ করে টেস্টের পর ওয়ানডেতেও ‘বাংলাওয়াশ’-এর স্বপ্ন। স্বাগতিকদের রোদ্দুরমাখা আলোকিত এই অর্জন কাল হেমন্তের হিমসন্ধ্যায় তাই নিয়ে এলো বসন্তের ঝংকার। সুর-ছন্দে! সৌরভ-আনন্দে!

No comments:

Post a Comment