দেশের বিভিন্ন বিমান ও স্থলবন্দরে আটক মূল্যবান সামগ্রী যথাযথভাবে কাস্টম হাউস ও বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছে কি না তা তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আটক মূল্যবান পণ্যের মালিকানা দাবি করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অনুমতিতে যেসব ব্যক্তি পণ্য ছাড়িয়ে নিয়েছে তারা ওই পণ্যের সত্যিকারের মালিক কি না, বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া চোরাই পণ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও নিলামে বিক্রি করা হয়েছে কি না তাও যাচাই করা হবে। তদন্তে
অনিয়ম পাওয়া গেলে দায়ী ব্যক্তিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হবে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান এই তদন্তের সুপারিশ করেছেন। এ জন্য গত ২৫ নভেম্বর তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান গোলাম হোসেনের কাছে একটি চিঠিও দিয়েছেন। তাতে উল্লেখ করেছেন, আটক চোরাই পণ্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ। আটকের পর থেকে সর্বশেষ পর্যায় পর্যন্ত এসব পণ্য কী হয় তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। তাই অচিরেই পুরো প্রক্রিয়াটি তদন্তের প্রয়োজন। মহাপরিচালকের সুপারিশ অনুমোদন করে এনবিআরের পক্ষ থেকে তদন্ত শুরুর অনুমতি চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। তদন্তের জন্য ইতিমধ্যে সাত সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এনবিআর সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে চলতি সপ্তাহ থেকেই তদন্ত শুরু হবে। এনবিআর সূত্র জানায়, গত বছরের ১ জুলাই থেকে গত ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত চোরাই সোনা, বিদেশি মুদ্রা, সিগারেট, মোবাইল ফোনসেট, উচ্চ সিসির মোটরসাইকেলসহ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের জমা দেওয়া সোনার পরিমাণে গরমিল দেখা দিয়েছে। আবার সোনা পাচারকাজে বিমান বাংলাদেশের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় শুল্ক গোয়েন্দাপ্রধান চোরাই পণ্য আটকের পুরো প্রক্রিয়াটি তদন্তের সুপারিশ জানান। এনবিআর চেয়ারম্যানও ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি তদন্তে আগ্রহী। তদন্ত কমিটিতে কাস্টম হাউসের একজন যুগ্ম কমিশনার, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের একজন সহকারী পরিচালক, একজন সহকারী পরিচালক, সংশ্লিষ্ট রাজস্ব বিভাগের একজন সহকারী কর্মকর্তা এবং এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) তিনজন কর্মকর্তা রয়েছেন। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে চোরাই পণ্য আটক, জমা, সংরক্ষণ ও মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়ার কার্যক্রম তদন্তের সুপারিশ করে গত ২৭ নভেম্বর এনবিআর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এনবিআর চেয়ারম্যানের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের সর্বশেষ সময় পর্যন্ত পাচারকারীদের কাছ থেকে চোরাই সোনা, বৈদেশিক মুদ্রা, মোবাইল ফোনসেট, বিদেশি সিগারেটসহ বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী উদ্ধারের পর আটক স্থান থেকে সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউসে জমা দেওয়া, সেখান থেকে বাংলাদেশে ব্যাংকে স্থানান্তর, প্রকৃত মালিককে ফেরত দেওয়া, মালিকানাবিহীন পণ্য সংরক্ষণ এবং নিলাম পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে তদন্তের প্রয়োজন।’ তদন্তে কারো বিরুদ্ধে অনিয়ম পাওয়া গেলে দায়ী ব্যক্তিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশ জানানো হয়েছে চিঠিতে। এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, শুল্ক গোয়েন্দা শাখাসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনীর নজরদারির ফলে চোরাই পথে আসা সোনা, বৈদেশিক মুদ্রা, সিগারেটসহ বিভিন্ন পণ্য আটক সম্ভব হচ্ছে। তবে আটক পণ্য কোথায়, কিভাবে জমা হয় এবং সেগুলো সংরক্ষণ, প্রকৃত মালিককে সরবরাহ বা প্রয়োজনে যাতে নিলামে বিক্রি হয় তার পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান কালের কণ্ঠকে বলেন, গত এক বছরেরও বেশি সময়ে রেকর্ড পরিমাণ সোনা, বৈদেশিক মুদ্রাসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। আটক চোরাই পণ্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ। পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতেই তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্র জানায়, গত বছরের ১ জুলাই থেকে গত ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত শুল্ক গোয়েন্দাদের আটক করা চোরাই পণ্যের মধ্যে ৬৭৭ কেজি সোনা, প্রায় ২৯ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা, প্রায় ২৫ কোটি টাকা মূল্যের বিদেশি সিগারেট এবং উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোনসেটসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে। এসব পণ্যের মোট মূল্য হবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। চোরাই সোনা বা বিদেশি মুদ্রা আটকের পর তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কাছাকাছি কাস্টমস হাউসে জমা দেয় শুল্ক গোয়েন্দারা। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলাও হয়। এরপর কাস্টম হাউসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আটক সোনা বা মুদ্রা গ্রহণের অনুরোধ করেন। নির্ধারিত সময়ে সেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেন কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা যাচাই শেষে সেসব পণ্য গ্রহণ করেন। তবে অতি মূল্যবান সামগ্রী না হলে সেগুলো কাস্টম হাউসের গুদামেই রাখা হয়। সূত্র জানায়, অতীতে বিভিন্ন সময় আটক পণ্যের মালিকানা দাবি করে সোনা ও মূল্যবান সামগ্রী ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে অনেকে। এ ক্ষেত্রে কাস্টমস কর্মকর্তাদের আদালতে পণ্যের মালিকানা নিশ্চিত করতে হয়। কাস্টমস আদালত কাগজপত্রের ভিত্তিতে রায় দেন। মালিকানার পক্ষে কাগজপত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে দেখালে আটক পণ্য ছেড়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, কাস্টম হাউস ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অসাধু অনেক কর্মকর্তা জাল কাগজপত্র দেখিয়ে অতীতে শুল্ক দিয়ে সোনাসহ মূল্যবান সামগ্রী ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। পরে সেই কাগজপত্র নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এতে জালিয়াতিতে জড়িত কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন। গত এক বছরের কার্যক্রমের ওপর তৈরি করা শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, রাজধানীর হযরত শাহজালাল, চট্টগ্রামের শাহ আমানত, সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর থেকে চোরাই পণ্য ও মুদ্রা আটক করা হয়েছে। আবার স্থলপথে ভারতে পাচারকালে বিশেষভাবে বাংলাদেশের দিকে বেনাপোল, সোনামসজিদ, আখাউড়া ও হিলি স্থলবন্দর থেকেও চোরাই পণ্য আটক করা হয়। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, যশোর, সাতক্ষীরা, রাজশাহী, লালমনিরহাট, হবিগঞ্জ ও সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকেও চোরাই পণ্য আটক করা হয়েছে। মূলত ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাংলাদেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে পাচারকারীরা বড় বড় চালানে সোনা আনা শুরু করে। গত বছরের এপ্রিল থেকে চোরাই সেনা আসার হার বাড়ছে। ভারত, বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বড় মাপের চোরাকারবারিরা চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে বাংলাদেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে বেছে নিয়েছে। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিদেশি মুদ্রা আটকের ঘটনা গত মার্চ- এপ্রিল থেকে বেশি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব অর্থ জঙ্গি সম্পৃক্ততায় ব্যবহৃত হচ্ছে। চোরাচালানের কাজে প্রভাবশালী লোকজন জড়িত। এতে সহযোগিতা করছেন সরকারি ছোট-বড় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
No comments:
Post a Comment