প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-চায়না-ইন্ডিয়া-মিয়ানমারÑ এ চার দেশীয় করিডোর বা সিল্ক রোড বাস্তবায়িত হলে এ অঞ্চলে উন্মোচিত হবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির নবদিগন্ত। এটিকে সামনে রেখে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে আকর্ষণীয় বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে চীন। এ সময়ে চীনে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানিও বাড়বে। ফলে ঘুরে দাঁড়াবে এ গোটা অঞ্চলের মানুষ। দূর হবে ুধা, দারিদ্র্য, অশান্তি আর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। স্থাপিত হবে রাজনৈতিক ও সামাজিক
স্থিতিশীলতা, পারস্পারিক সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির বন্ধন। এর সুফল ভোগ করবে কোটি কোটি মানুষ। আর এ জন্যই এ অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠায় সবার আগে প্রয়োজন এ দেশগুলোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার। প্রয়োজন পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক। আর এ আস্থার সম্পর্ক আরো মজবুত ও টেকসই করতেই উদ্যোগী ভূমিকায় নেমেছে বিশ্বের নয়া অর্থনৈতিক শক্তি চীন। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশকে ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে পেতে আগ্রহী চীন। অর্থনৈতিক এ সংযোগ স্থাপনের েেত্র বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এ বিষয়ে চীনা কর্মকর্তারা জানান, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনকে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনে আগ্রহী। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশকে ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে পেতেও দেশটি আগ্রহী বলে তারা জানান। প্রস্তাবিত করিডোরটি কলকাতা থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের মান্ডালার ভেতর দিয়ে চীনের কুনমিং পৌঁছবে। প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের ল্েয চারটি দেশের সরকারি কর্মকর্তারা নিজ দেশের প্রতিবেদন পেশ করবেন। আগামী ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর কক্সবাজারে বিসিআইএমের ওয়ার্কিং গ্র“পের দ্বিতীয় বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। তবে প্রস্তাবিত এ অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠায় সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। প্রয়োজন পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক তৈরি করা। অর্থাৎ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এটিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়Ñ এমনটাই মনে করেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কর্তাব্যক্তিরা। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) আমন্ত্রণে ২৩ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চীন সফরকালে বাংলাদেশের মিডিয়া প্রতিনিধিদলকে এ ধারণা দিয়েছেন দেশটির রাজনৈতিক নেতা, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বিশ্বের অর্থনৈতিক শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রতিযোগিতার দৌড়ে অদম্য ছুটে চলা চীন এ মুহূর্তে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে। এ চারটি দেশকে নিয়ে গড়ে তোলা হবে অর্থনৈতিক করিডোর। আর এ জন্যই বাংলাদেশকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রেখে অর্থাৎ শুরুতে রেখে চার দেশের নামের প্রথম অর নিয়ে প্রস্তাবিত এই করিডোরের নামকরণ করা হয়েছে ‘বিসিআইএম’ (বাংলাদেশ-চায়না-ইন্ডিয়া-মায়ানমার)। উত্তর-পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের পশ্চিমাঞ্চলের ১০ লাখ ৬৫ হাজার বর্গকিলোমিটারকে যুক্ত করবে এ করিডোর। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মিডিয়া প্রতিনিধিদলের প্রধান সমন্বয়ক প্রবীণ সাংবাদিক কলামিস্ট সাদেক খান নয়া দিগন্তকে বলেন, চার দেশীয় এই করিডোর স্থাপিত হলে শীর্ষ সুবিধাভোগীদের তালিকার দ্বিতীয় স্থানেই থাকবে বাংলাদেশ। চীনের গতিশীল উন্নয়নের হাওয়া বাংলাদেশের পালেও লাগবে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান বাড়বে। বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা আরো গতিশীল হবে। আর এ জন্যই এ অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠায় চার দেশের রাজনৈতিক বোঝাপড়া দরকার। এ সফরের অংশ হিসেবে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে বাংলাদেশের মিডিয়া প্রতিনিধিদলের কাছে এক উপস্থাপনায় চায়না ইনস্টিটিউট অব কনটেম্পোরারি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের ইনস্টিটিউট অব সাউথ অ্যান্ড সাউথইস্ট এশিয়ান অ্যান্ড ওসেনিয়া স্টাডিজের উপপরিচালক প্রফেসর লি লি চার দেশের সমন্বয়ে প্রস্তাবিত এ অর্থনৈতিক করিডোরকে আখ্যায়িত করলেন চীনের ‘বিগ ভিশন’ হিসেবে। অধ্যাপক লি লির উপস্থাপনার বিসিআইএমের সারমর্ম হচ্ছে ‘এ করিডোর চার দেশকে একটি অর্থনৈতিক বেল্টে যুক্ত করবে। অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি এ করিডোর এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং সাংস্কৃতিক সংযোগ স্থাপনেও ভূমিকা রাখবে। সেমিনারে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম কমিশনের (এনডিআরসি) বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবিত করিডোরের অগ্রগতিসহ বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। সেমিনারে চীনের কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা আলোচনায় অংশ নেন। তারা পারস্পরিক আস্থাকে টেকসই করতে মতবিনিময় করেন। আলোচনায় তারা একমত হয়ে বলেন, এ অঞ্চলে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠায় সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। গড়ে তোলা প্রয়োজন পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক। একই দিনে বিসিআইএম নিয়ে বেইজিংয়ের দিয়াওউথাই হোটেলে আয়োজিত অপর এক সেমিনারে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস মিনিস্টার গুয়ো ইয়েঝু বাংলাদেশের মিডিয়া প্রতিনিধিদলকে বলেন, এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য করিডোরটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ। আপনাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরকালে এ ধরনের করিডোর প্রতিষ্ঠায় বেশ আগ্রহ দেখিয়েছেন। ভাইস মিনিস্টার ইয়েঝু আরো বলেন, এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশকে ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে পেতে আগ্রহী চীন। এ সেমিনারে বাংলাদেশ মিডিয়া প্রতিনিধিদলের প্রধান সাদেক খান বলেন, অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠায় চার দেশের রাজনৈতিক বোঝাপড়া দরকার। জবাবে গুয়ো ইয়েঝু বলেন, আমরাও মনে করি এটা খুব প্রয়োজন। এর জন্য আমাদের সমন্বিত প্রচেষ্টাও জরুরি। সাদেক খান বলেন, আমরা চারটি দেশের জনগণের সাথে জনগণের নিবিড় সম্পর্ক উন্নয়নে বিশ্বাস করি। ইয়েঝু জবাবে বলে, করিডোর প্রস্তাবনাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে গিয়ে এ সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। আর এটি সামনে রেখে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে আকর্ষণীয় বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে চীন। এ সময়ে চীনে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানিও বাড়বে। সিপিসির থিংক ট্যাংক হিসেবে পরিচিত প্রফেসর লি লি তার উপস্থাপনায় বিসিআইএম সম্পর্কে বলেছেন, অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করা গেলে চার দেশের কানেকটিভিটি বাড়বে। বিশেষ করে অর্থনীতি, শিা, কৃষি, যোগাযোগ ও মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক খাতে অভূতপূর্ব সংযোগ স্থাপনের দ্বার উন্মুক্ত হবে। সে জন্য আমাদের সবারই উচিত এখন একটি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা। তিনি বলেন, চীন-ভারত সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক পরিপক্ব¡। দুই দেশের সীমান্ত বিরোধের মতো বিষয় নিয়ন্ত্রণে রেখে শি জিনপিং-নরে›ন্দ্র মোদি সম্পর্ক এগিয়ে নিতে একমত হয়েছেন। এই দুই নেতা তাদের সাম্প্রতিক বৈঠকে প্রাচীন সিল্ক রুট পুনরুজ্জীবন নিয়ে আলোচনা করেছেন। চীন-ভারত সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্পর্কে তা অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পিকিং ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ঝাইর কুন বলেন, প্রস্তাবিত করিডোর হলো বৈশ্বিক বৃহত্তর কানেকটিভিটির একটি অংশ। অর্থনৈতিক এ সংযোগ স্থাপনের েেত্র বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে এ ধরনের অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপন করে প্রত্যেকে সুফল ভোগ করছে। সাদেক খান বলেন, এ করিডোর প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সবসময়ই আগ্রহী। চার দেশের যুক্ত ঘোষণা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মিডিয়া প্রতিনিধিদলে থাকা চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত কলামিস্ট আশফাকুর রহমান বলেন, বিসিআইএম নিয়ে বাংলাদেশ গভীরভাবে স্টাডি করছে। বাংলাদেশ ও চীনের চিন্তাধারা অনেকটাই কাছাকাছি। কিন্তু প্রস্তাবটি সরাসরি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কাছ থেকে আসা উচিত, কারণ এ ধারণাটি তারই মস্তিষ্কপ্রসূত। এখানে আরেকটা কথা বলা দরকার, আমরা কিন্তু এখন বঙ্গোপসাগর নিয়েও কাজ করছি। সুতরাং সব কিছুর বিষয়েই প্রতিবেশী দেশগুলোকে আন্তরিক হতে হবে। মিডিয়া প্রতিনিধিদলের সদস্য নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার সময় রোহিঙ্গা বিষয়টি নিশ্চয়ই আলোচনায় উঠে আসবে। এটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে অন্যদেরও ভূমিকা রাখার প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিনিধিদলের সদস্য বাসসের প্রধান সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রস্তাবিত চার দেশীয় করিডোর বা সিল্করোড হলে এ অঞ্চলের তথা বাংলাদেশের বিপুল মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। খুলে যাবে ব্যবসাবাণিজ্যের দ্বার। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশেও ঈর্ষণীয় উন্নয়ন ঘটবে। প্রতিনিধিদলের আরেক সদস্য দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসাইন চীনা কর্মকর্তাদের বলেন, আপনারা যদি সত্যিই এটির বাস্তবায়ন চান তাহলে সবার আগে দরকার রাজনৈতিক প্রতিশ্র“তির। এরপর এটি নিয়ে চার দেশের একটি শীর্ষ সম্মেলন হতে পারে। প্রতিনিধিদলের সদস্য ডেইলি স্টারের কলামিস্ট রুবানা হক বলেন, এই ধরনের করিডোর প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক সদিচ্ছাটা খুব বেশি প্রয়োজন। একে অপরের আস্থাভাজন বন্ধুও হতে হবে। বিষয়টি নিয়ে ‘ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড ওয়ান রোড’ শিরোনাম আরো একটা সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এ সেমিনার শেষে চায়না সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি ওয়ার্ল্ড স্টাডিজের (সিসিসিডব্লিউএস) মহাপরিচালক সুন হাইয়ান বলেন, প্রতিবেশী প্রতিটি দেশের উন্নয়ন না হলে কেউ নিজেদের উন্নয়নও ঠিকমতো উপভোগ করতে পারে না। কাউকে দরিদ্র রেখে নয়, আমরা সব প্রতিবেশীকে নিয়ে উন্নয়ন করতে চাই। জানি আমাদের এ ভাবনার বাস্তবায়ন কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। তিনি বলেন, ২০২০ সালের মধ্যে ছয়টি করিডোরের মৌলিক অবকাঠামোগত উন্নতি আনার ধারণা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে চীন। যার মধ্যে যুক্ত হবে ইরান ও তুরস্ক। সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৯৯ সালে চীনের ইউনান প্রদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় (কুনমিং উদ্যোগ হিসেবে পরিচিত) ভারতের গৌহাটিভিত্তিক সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট সোশ্যাল অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ (সিইএসপিআর) এবং ঢাকার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) করিডোরের প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি করে। কিন্তু পরে এ দীর্ঘ সময়ে চোখে পড়ার মতো আর কোনো কার্যক্রম বা অগ্রগতি পরিলতি হয়নি।
No comments:
Post a Comment