'আমাদের এখানে প্রায়ই বানরের খেলা দেখানো হয়। খেলা শেষে বানরওয়ালা দুই কাপ চা নেয়। এক কাপ নিজে খায়, আরেক কাপ বানরকে খাওয়ায়। অথচ একই দোকানে আমাকে চা-পানি খেতে দেওয়া হয় না
। খেতে চাইলে চড়-থাপ্পড় দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব দেখে একেক সময় মরে যেতে ইচ্ছে করে।' নিজের জন্ম-পরিচয়ের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ জানিয়ে বঞ্চনার কথাগুলো বলছিলেন রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র দিপু বাঁশফোড়। বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া রেলস্টেশনের পূর্ব পাশে বাঁশফোড় কলোনিতে। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে দলিত জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য ও নির্যাতন নিরসনে গতকাল রবিবার আয়োজিত গণশুনানিতে দিপু এসব কথা বলেন। নাগরিক উদ্যোগ এবং বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আন্দোলন যৌথভাবে এর আয়োজন করে। দেশে সামাজিকভাবে প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছে দলিত, হরিজন ও বেদে জনগোষ্ঠীর মানুষ। সমাজে বসবাস করেও যেন ওরা বাইরের কেউ! সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে দলিত সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা প্রায় ৬৩টি লাখ; যার মধ্যে দলিত ৪০ লাখ, বেদে আট লাখ ও হরিজন ১৫ লাখ। বহুমাত্রিক বৈষম্যের কারণে এদের প্রায় ৯৬ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা সামাজিক বঞ্চনার দুষ্টচক্রে আটকা পড়ে আছে। সভ্যতার বিকাশ ঘটছে। কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিঁড়ে মানুষ মুক্তমনের অধিকারী হচ্ছে। উচ্চ-শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু দলিত-নিগৃহীত মানুষগুলোর ব্যাপারে দেশের সাধারণ মানুষের মনোভাবের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি আজও। নিগৃহীত এসব জনগোষ্ঠী পরিচ্ছন্নতাকর্মী, চা-শ্রমিক, মুচি, ধোপা, ডোম, মেথর ইত্যাদি পেশায় 'সেবা শ্রমিক' হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। জন্ম-পরিচয় ও পেশাভিত্তিক বৈষম্যের কারণে সমাজে তাদের ওপর নেতিবাচক মনোভাব যেন ওদের কপালের লিখন। গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার উচ্চশিক্ষিত রাজেশ বাঁশফোড়ও সমাজের নেতিবাচক মানসিকতার শিকার। তিনি বলেন, 'বিজয়ের মাস চলছে। আজ এখানে এসে আমার কাঁদার সময় নয়। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এসেও আমরা স্বাধীন, এমনটা জোর গলায় দাবি করতে পারি না। এ দেশে ভোটাধিকার ছাড়া আমাদের কোনো অধিকার নেই। জন্মের সময় স্রষ্টা তো বলে দেননি তোমাকে বাঁশফোড় হয়ে জন্ম নিতে হবে। তবে আমাদের ওপর এত বঞ্চনা কেন?' গাইবান্ধা জেলায় বাঁশফোড়, নুনিয়া, রবিদাস, মঘাইয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ের পাঁচ হাজারের অধিক দলিত জনগোষ্ঠীর বসবাস। এই সম্প্রদায়ের জনগণ শুধু অস্পৃশ্য বা বঞ্চনা নয়, অবিচারেরও শিকার হচ্ছে। জেলার সুন্দরগঞ্জে এক দলিত তরুণীকে গত ২১ সেপ্টেম্বর রাতে একই এলাকার আব্দুস সালাম ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করে। যেখানে ধর্ষণের বিচার হওয়ার কথা, তা না হয়ে উল্টো প্রতিনিয়তই হুমকির শিকার হচ্ছে ধর্ষিতার পরিবার। গতকাল গণশুনানিতে অংশ নিয়ে মেয়েটির বাবা মেয়েকে নির্যাতনের সেই ঘটনার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, 'ধর্ষক আবদুস সালামকে হাতেনাতে আটক করা হয়। কিছুক্ষণ পরই ধর্ষকের ভাইয়েরা এসে জোরপূর্বক তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কাছের লোক হওয়ায় থানায় আজও মামলা করা সম্ভব হয়নি।' ১৯০৫ সালে ঢাকা পূর্ববঙ্গের রাজধানী হওয়ার পর বাড়তি পরিচ্ছন্নতাকর্মীর দরকার পড়ে। সেই সময় ভারতের কানপুর, নাগপুর, তেলেগু ও মাদ্রাজ থেকে 'ভালো' কাজের কথা বলে এই অঞ্চলে নিয়ে আসা হয় এসব দলিত জনগোষ্ঠীর মানুষকে। যাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে দেখা যাচ্ছে, তারা বর্তমানে কানপুরী, তেলেগু, ঋষি, কাওরা, বেদে, রবিদাস, পৌন্ড্র, চা-শ্রমিক, নিকারিসহ শতাধিক ক্ষুদ্র সম্প্রদায় হিসেবে এ দেশে বসবাস করছে। সূর্য বিশ্বাস যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রামের ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষ। বাজার, হোটেল কিংবা চায়ের দোকান কোথাও তার বসার বা খাওয়ার অধিকার নেই। এসবের প্রতিবাদ করলে তার মতো ঋষি সম্প্রদায়ের সবার কপালে জোটে চড়-থাপ্পড় আর গালি। সূর্য বিশ্বাস জানান, বাঘারপাড়ার সাতটি ইউনিয়নে দলিত ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাজার করতে গেলে নিগৃহীত হতে হয়। হোটেলে বা দোকানে কোনো কিছুই খাওয়া যায় না। এমনকি দোকানে গিয়ে চুল কাটাতেও মানা। স্থানীয় লোকজনের কারণে জনপ্রতিনিধিরাও তাঁদের কোনো সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন না। শুধু দলিত হওয়ার কারণে যথাযথ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে এই জনগোষ্ঠীর মানুষ। জন্ম, বর্ণ, জাতপাত, অস্পৃশ্যতার কারণে ওরা ন্যায়বিচার প্রাপ্তির দাবিও জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারে না। সমাজের প্রভাবশালীরা বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি আইনি দীর্ঘসূত্রতার কারণে সব সময়ই ওরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনই বাস্তবতায় দলিত জনগোষ্ঠীর নির্যাতিতদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গতকালের এই গণশুনানির আয়োজন করা হয়। গণশুনানিতে দলিত জনগোষ্ঠীর প্রতি অস্পৃশ্যতার কারণে বঞ্চনা, ভূমি দখল ও উচ্ছেদ, ধর্ষণ ও হত্যাসহ বিভিন্ন নির্যাতনের চিত্র উপস্থাপন করা হয়। দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধানের আলোকে এসব নির্যাতনের বিষয়ে বিশ্লেষণ, জুরি বোর্ড কর্তৃক সুপারিশ ও প্রতীকী রায় প্রদান করা হয়। গণশুনানিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নিরুপা দেওয়ান। জুরি বোর্ডের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র জেলা জজ (অবসরপ্রাপ্ত) শামসুন নাহার বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন, চট্টগ্রাম জেলা ও দায়েরা জজ আদালতের আইনজীবী নারায়ণ চন্দ্র কর্মকার প্রমুখ। এ ছাড়া গণশুনানিতে দলিত জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য ও নির্যাতনের ঘটনাবলির আইনি বিশ্লেষণ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহরিয়ার শাকির। গণশুনানি শেষে উপস্থাপিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জুরিগণ বলেন, সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিক সমান মর্যাদার অধিকারী। এ ক্ষেত্রে অস্পৃশ্যতার ভিত্তিতে বৈষম্য কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। দলিতদের ধর্ষণ, জীবন ও জীবিকার ওপর যে হামলা হয়েছে, তার দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণে সরকারের উচ্চ মহলকে অবহিত করা হবে। একই সঙ্গে যেকোনো ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়।
No comments:
Post a Comment