‘গ্রামবাসী হুঁশিয়ার। বস্তিওয়ালা জাগো’—রাত ১০টার পর চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দক্ষিণপাড়া গ্রামে গেলে কিছুক্ষণ পরই শোনা যাবে এমন চিৎকার। ডাকাত–আতঙ্কে গ্রামবাসী উদ্যোগী হয়ে প্রায় এক মাস ধরে সেখানে পাহারা বসিয়েছেন। ডাকাতদের হামলায় গত দুই মাসে রাউজান, লোহাগাড়া, বোয়ালখালী ও চট্টগ্রাম নগরে প্রাণ হারিয়েছেন চারজন। ডাকাতি হয়েছে অন্তত ৪০টি। ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে অর্ধশতাধিক। ডাকাতদের হামলায় আহত হয়ে
ছে শতাধিক মানুষ। মালামাল লুট হয়েছে কোটি টাকারও বেশি। বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে এমন কয়েকজন জানিয়েছেন, পুলিশি হয়রানির ভয়ে তাঁরা মামলা করেননি। তবে পুলিশ বলছে, গত দুই মাসে জেলায় ডাকাতি হয়েছে আট-নয়টি। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ডাকাতি বন্ধ করতে জেলার সব ওসিকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে দক্ষিণপাড়া গ্রামে পাহারার দায়িত্বে ছিলেন শ্যামল দাশ, অলক রায়, লিটন খাস্তগীর, প্রদীপ রায়সহ ১০ জন। লাঠি, টর্চলাইট ও বাঁশি হাতে সারা রাত তাঁরা গ্রামের রাস্তা ঘুরে বেড়ান। প্রদীপ রায় বলেন, নভেম্বর মাসে কাশি মহাজনের বাড়িতে ডাকাতির পর প্রতিদিন রাতে গ্রামের ১০ জন করে পাহারা দিচ্ছেন। তিনি জানান, গত মাসে দুটি ঘটনায় ডাকাতদের গুলিতে তিনজন আহত হয়েছেন। শ্যামল দাশ বলেন, ‘পুলিশ ডাকাতদের ধরে ফেললে রাত জেগে আমাদের পাহারা দিতে হতো না।’ চিকনদণ্ডী ইউনিয়নের শিকারপুর, আহনেরপাড়া গ্রামেও ডাকাত–আতঙ্কে পাহারা বসানো হয়েছে। চিকনদণ্ডী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সেলিম জানান, ডাকাত–আতঙ্কে লোকজন পাড়ায় পাড়ায় পাহারা দিচ্ছেন। উপজেলার মধ্যম মাদার্শা ইউনিয়নের সিকদারপাড়াতে একই অবস্থা। গত দুই মাসে ওই তিনটি গ্রামে অন্তত ১০টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। সিকদারপাড়া গ্রামের জসীম উদ্দিন বলেন, আশপাশে বড় বড় বিল থাকায় রাত হলেই আতঙ্কে থাকি। ডাকাতির পর থেকে রাতে পুলিশ টহল দিলেও মানুষের আতঙ্ক কাটছে না। ডাকাত দলের গুলিতে আহত শিকদারপাড়ার শফি মিস্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০ দিন হাসপাতালে থাকার পর কিছুটা সুস্থ হয়েছি। এখনো আতঙ্কে ঘুম আসে না।’ তবে বাড়িতে ডাকাতি হলেও পুলিশি ঝামেলা এড়াতে মামলা করেননি বলে জানালেন তিনি। গত ২২ নভেম্বর সন্ধ্যায় পুলিশ পরিচয়ে হাটহাজারীর চৌধুরীহাট এলাকায় প্রবাসী সেকান্দরের ঘরে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তাঁর ছলে ফয়সাল বলেন, হয়রানির ভয়ে তাঁরা মামলা করেননি। হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ডাকাতি হওয়ায় লোকজন পাহারা দিচ্ছেন। তবে ডাকাতি ঠেকাতে পুলিশ নিয়মিত টহল দিচ্ছে। মিরসরাই পৌরসভা এলাকার ১৫টি দোকান এবং ১০ বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে গত মাসে। মিরসরাইয়ের মিঠানলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু তাহের জানান, একের পর এক ডাকাতির ঘটনায় লোকজনের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। রাউজানেও থেমে নেই ডাকাতি। উপজেলার বিনাজুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুকুমার বড়ুয়া প্রথম আলোকে জানান, দুই মাস ধরে বিনাজুরীসহ আশপাশের ইউনিয়নে লোকজন ডাকাত আতঙ্কে রাতে পাহারা দিচ্ছেন। রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, মাঝখানে ডাকাতি বেড়ে গেলেও কিছুসংখ্যক ডাকাতকে গ্রেপ্তার করায় এখন ডাকাতি হচ্ছে না। নগরেও আতঙ্ক: গত ১৩ ডিসেম্বর কোতোয়ালি থানা থেকে ৩০০ গজ দূরে জিপিও-এর কাছে রাত সাড়ে আটটার দিকে দুটি সোনার দোকানে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতদের গুলি ও বোমা হামলায় মোহাম্মদ সৈয়দ নামের একজন হকার নিহত এবং নয়জন আহত হয়েছেন। নগরের ব্যস্ততম এলাকায় বোমা ফাটিয়ে ডাকাতির ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। প্রমিজ জুয়েলার্সের মালিক আশিষ নাথ বলেন, ‘আমরা নিরাপত্তা চাই।’ সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে নগরের কল্পলোক আবাসিক এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে দুই ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে বাকলিয়া থানা-পুলিশ। নগর ও জেলায় পুলিশের তালিকাভুক্ত কতজন ডাকাত কারাগারে আছেন আর কতজন মুক্তি পেয়ে বাইরে আছেন এর হালনাগাদ তালিকা নেই পুলিশের কাছে। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, নগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ১৪৩ জন ডাকাতের একটি তালিকা রয়েছে। জেলা পুলিশের তালিকায় দুই শতাধিক ডাকাতের নাম রয়েছে। এ বিষয়ে নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, পলাতক ডাকাতদের গ্রেপ্তার ও জামিনে থাকাদের ওপর কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তালিকাও হালনাগাদ করা হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment