
নার মূলে শেষ পর্যন্ত কুঠারাঘাত এলো দেশ থেকেই, টানা অবরোধে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, অবরোধে চোরাগোপ্তা হামলার ভয়ে কোনো ক্রেতা প্রতিনিধি বাংলাদেশে আসতে রাজি নন। এমনকি গুলশান থেকে তাঁরা বিজিএমইএ ভবনেও যেতে চান না। কারণ প্রধান কার্যালয় থেকে তাঁদের ওপর 'রেড অ্যালার্ট' জারি করা থাকে। এখন বাংলাদেশি কারখানা মালিকরা বিদেশে গিয়ে কিছু কিছু কার্যাদেশ নিয়ে আসছেন। তবে সেটিও কারখানার সক্ষমতা অনুযায়ী নয়, ক্রেতারা তার চেয়ে কম পরিমাণ পোশাকের কার্যাদেশ দিচ্ছেন। এক দিনের হরতাল-অবরোধে পোশাক খাতের ৬৯৫ কোটি টাকার রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে কারখানার মালিকরা সময়মতো পণ্য তৈরি ও রপ্তানি করতে না পারায় কার্যাদেশ বাতিল, বিমানে বাড়তি ভাড়া দিয়ে পাঠানো, ক্রেতা কর্তৃক মূল্য কেটে রাখাসহ নানা ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েন। ২০১৩ সালে এসব কারণে তাঁদের সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল বলে দাবি করেছে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এ বছর এখন পর্যন্ত ছয়টি কারখানা ৯৯ লাখ ডলারের ক্ষতি গুনেছে বলে হিসাব দেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে রানা প্লাজা ধসের পর থেকে ক্রেতাদের পরিদর্শনের পরে ও কাজ না পেয়ে প্রায় আড়াই শ পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। পরিদর্শনের আওতায় পড়ার আগেই ঢাকা ছেড়েছেন প্রায় ৩০০ কারখানার মালিক। যাঁরা উৎপাদনে আছেন তাঁদের ব্যয় করতে হয়েছে কোটি টাকা, যে টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে অগ্নিনিরাপত্তার নানা সরঞ্জাম। এসব ধকলের মধ্যে ২০১৩ সাল পুরোটাই গেছে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে, বিশেষ করে শেষভাগে। এখনো যার মূল্য দিতে হচ্ছে পোশাক খাতকে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ ১৩.৮৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ০.৭৭ শতাংশ। একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে ছয় মাসে পোশাক রপ্তানি কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ। আরেকটি বড় বাজার কানাডায় কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। ইউরোপে রপ্তানি কমেনি; কিন্তু বাড়ার হার ভালো নয়, মাত্র ৩.৫৩ শতাংশ। নতুন বাজারগুলোর অবস্থাও খারাপ, সেখানে সম্মিলিতভাবে রপ্তানি আয় বেড়েছে মাত্র ২.৭৪ শতাংশ। বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি (ইএবি) ও দেশের শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সব ধকল সামলে উঠেছিলাম, ক্রেতারাও ফিরতে শুরু করেছিলেন; কিন্তু অবরোধের কারণে আবার কার্যাদেশ ছাড়ের ক্ষেত্রে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে।' তিনি বলেন, 'তাঁরা (ক্রেতারা) কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। এ কারণে আমার সক্ষমতা ১০০ ডজন থাকলে দিচ্ছেন ৭৫ ডজন। বাকি অর্ডারের জন্য তাঁরা অন্য দেশ খুঁজছেন।' আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমের জন্য এখন পোশাকের কার্যাদেশ দেওয়ার সময়। এ মৌসুমে যে কার্যাদেশ পাওয়া যাবে, তা দিয়ে আগামী তিন থেকে ছয় মাস চলবে কারখানাগুলো। মালিকরা বলছেন, আগামী কয়েক মাসের রপ্তানি আয়ে এখনকার অবরোধের প্রভাব পড়বে না। এটি বোঝা যাবে আরো পরে। যেমন, ২০১৩ সালের শেষ দিকে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে যে ক্ষতি হয়েছিল, তা প্রকট হয়েছে ২০১৪ সালের শেষ ছয় মাসের রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যানে। ওই সময় মোট পোশাক রপ্তানি আয়ে মাত্র ০.৭৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও তুরস্কের বাজারের। দেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানি আয়ের চার ভাগের এক ভাগ আসে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বাজার থেকে। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি পোশাক রপ্তানি করে। কানাডায়ও পিছিয়ে নেই বাংলাদেশি পোশাক। গেল বছর সেখান থেকে আয় হয়েছে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রায় ২৪৪ কোটি ডলার আয় করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ কম। কানাডায় ছয় মাসে পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে প্রায় ৪৩ কোটি ডলার, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ১৪.৬০ শতাংশ কম। অন্যদিকে তুরস্কে ছয় মাসে প্রায় ২২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৪ শতাংশ কম। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি আগের চেয়ে এখন ভালো অবস্থায় আছে, কানাডাও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ফলে ওই দুই দেশে ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশের রপ্তানি বাড়ছে; কিন্তু বাংলাদেশের কমছে। কারণ জানতে চাইলে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মো. শহিদউল্লাহ আজিম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রানা প্লাজা ও অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের পরিদর্শন কার্যক্রমের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ক্রেতারা এত দিন চুপচাপ ছিলেন। এ কারণে রপ্তানি কম হয়েছে। কিন্তু তাঁরা আবার ফিরছিলেন।' ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে চলাফেরার ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করার কথা বলা হয়েছে। কানাডা দূতাবাস তাদের নাগরিকদের উদ্দেশে বলেছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক। এ জন্য সবাইকে উচ্চমাত্রার সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য বলা হচ্ছে। হরতাল ও সহিংস সংঘর্ষ এখানে ধারাবাহিকভাবে হতে থাকে। নিরাপত্তা পরিস্থিতির যেকোনো সময় অবনতি ঘটতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস তাদের নাগরিকদের সব রাজনৈতিক সমাবেশ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশে যেসব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ হওয়ার কথা সেগুলো সহিংস হয়ে উঠতে পারে। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনায় পশ্চিমারা আক্রান্ত হয়েছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয় তাদের ওয়েবসাইটে। শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, 'অবরোধের কারণে ক্রেতারা বাংলাদেশে আসতে পারছেন না। এমনকি তাঁরা গুলশান থেকে বিজিএমইএ ভবনে যেতেও রাজি নন। অনিশ্চয়তার কারণে আমরা গ্রীষ্ম মৌসুমের প্রত্যাশিত কার্যাদেশ পাব না।'
No comments:
Post a Comment