![]()
ফেনীর কিশোর শাহরিয়ার হৃদয় এবং মিনহাজুল ইসলাম অনিক এসএসসি পরীক্ষার্থী। আগামী ২ ফেব্রুয়ারি তাদের এই পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু প্রস্তুতির বদলে তারা এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। গত ৬ জানুয়ারি বিরোধী জোটের অবরোধের মধ্যে প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফেরার পথে ককটেলে আক্রান্ত হয়েছে তারা। এতে হৃদয়ের ডান চোখ গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়। অনিকের মুখ, নাক আর কপালের ওপরের অংশে মারাত্মক জখম হয়েছে। ঢামেক হা
সপাতালে চিকিৎসাধীন ওই দুই কিশোরের সামনে এখন চরম অনিশ্চয়তা ভর করছে। হৃদয় ও অনিক ছাড়া প্রায় বারো লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীর মনেও ভর করছে অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা হবে কিনা এমন শংকার মাঝেই চলছে তাদের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। এছাড়া চলমান অবরোধের কারণে শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থী। কারও পরীক্ষা সামনে। কারও পরীক্ষা চলছে। আবার কারও নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে, হাতে নতুন বইও এসেছে। কিন্তু ক্লাস-পরীক্ষা দুটিই চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবরোধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থীর অনিশ্চয়তাটাই বেশি। ইতিপূর্বে হরতাল-অবরোধে শিক্ষার্থীদের অনেকেই স্কুলে যেত। ফেনীতে পিঠে স্কুলব্যাগসহ রক্তাক্ত হয়ে অসহায়ের মতো রাজপথে বসে থাকাবস্থার আহত হৃদয়ের ছবি গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের বদৌলতে অনেক অভিভাবকই দেখেছেন। এ কারণে অভিভাবকরা এখন তাদের সন্তানদের অবরোধের মধ্যে স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। তাই নতুন শিক্ষাবর্ষের দশদিন কেটে গেলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার স্বাভাবিক পরিবেশ অনুপস্থিত। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেন, ‘শিগগিরই এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। এরপর ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর কথা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা নতুন বই পেয়েছে। বই নিয়ে ক্লাস করার জন্য কোটি কোটি শিক্ষার্থী উন্মুখ হয়ে আছে। এই মুহূর্তে অযৌক্তিক হরতাল দিয়ে তারা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত করছে।’ তিনি বলেন, ‘এই হরতাল-অবরোধ খুবই অযৌক্তিক। বিরোধী জোট কর্মসূচি ডেকে রাজপথে অনুপস্থিত। তাই তাদের উচিত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মরে জীবনকে বাধাগ্রস্ত না করে কর্মসূচি থেকে ফিরে আসা।’ উল্লেখ্য, নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে ১০ দিন ধরে। এর মধ্যে প্রথমদিন বা ১ জানুয়ারি ছিল জামায়াতে ইসলামীর হরতাল। ২, ৩ ও ৪ জানুয়ারি ছিল সাপ্তাহিক এবং সরকারি ছুটি। ৫ জানুয়ারি ছিল অঘোষিত ‘সরকারি অবরোধ’। ৬ জানুয়ারি থেকে চলছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের অবরোধ কর্মসূচি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এই অবরোধ-অবরোধ খেলায় ৫ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন বিঘ্নিত হচ্ছে। এরমধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরি বিদ্যালয়ে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৪ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। দশম শ্রেণীতে রয়েছে আরও অন্তত ১৮ লাখ শিক্ষার্থী। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিকে দুই ক্লাসে ২০ লাখ এবং উচ্চশিক্ষা স্তরে প্রায় ২৫ লাখ ছাত্রছাত্রী রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে ১ জানুয়ারি। উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ১ জুলাই সেশন শুরু হলেও মূলত অক্টোবর-নভেম্বরে পুরোদমে তাদের ক্লাস শুরু হয়েছে। এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিমূলক বিভিন্ন পরীক্ষা। আর গত ৬ জানুয়ারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেবেল পরীক্ষা শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে ভর্তি প্রক্রিয়া। এছাড়া প্রায় সারা বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো না কোনো পরীক্ষা লেগেই থাকে। থাকে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসও। এসবই এখন চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। রাজধানীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিভাবকদের সংগঠন ‘অভিভাবক ফোরাম’-এর চেয়ারম্যান জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ক্লাসের চেয়েও অভিভাবকরা এই মুহূর্তে বেশি আতংকিত আসন্ন এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে। যে সময়ে শিক্ষার্থীদের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নেয়ার কথা, সে সময়ে তারা ঘরে বন্দি। লেখাপড়া ও মডেল টেস্টসহ অন্য পরীক্ষা তাদের দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। অবরোধের কারণে পিকেটিংকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এ কারণে ৩৮ দিন পর ক্যাম্পাস খুললেও পরদিন ছাত্রদল-শিবিরের অবরোধের সমর্থনে আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে। এছাড়া নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর শাহীন স্কুল ও কলেজের একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী জানান, গত সপ্তাহে তাদের মডেল টেস্ট ছিল। কিন্তু অবরোধের কারণে তা নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে শুক্রবার একটি পরীক্ষা দিয়েছেন তারা। ‘অভিভাবক ফোরাম’-এর চেয়ারম্যান জিয়াউল কবির দুলু বলেন, অবরোধের মধ্যে তারা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। আবার এর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিক খোলাও রয়েছে। এ অবস্থায় তারা উভয় সংকটে পড়েছেন। না পারছেন সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে, না পারছেন ঘরে বসিয়ে রাখতে। এই অবস্থার আশু উত্তরণ দরকার বলে মনে করেন তিনি। এদিকে ছাত্রছাত্রীরা জানিয়েছে, অবরোধের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হলেও কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দিতে পারছে না। এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকরা যথারীতি হাজির হচ্ছেন। অবরোধের মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্যাম্পাসে আসছেন। বাধ্যবাধকতা না থাকায় ক্লাসে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম। বিশেষ করে বাসে করে ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে যেসব শিক্ষার্থী আসার কথা, তাদের উপস্থিতি খুবই কম বলে জানা গেছে।
No comments:
Post a Comment