Sunday, January 11, 2015

পিছু হটবে না বিএনপি:যুগান্তর

নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। কোনো কিছুতেই পিছু হটবে না তারা। সরকার যত কঠোর হবে, আন্দোলনও ততটা কঠিন হবে। চলমান আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে সব ধরনের কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে বিশ্ব ইজতেমা ও ছুটির দিনেও অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করা হয়নি। ইজতেমার পর চলমান আন্দোলনের ধরন পাল্টাবে, গতিও বাড়াবে। অ
নির্দিষ্টকালের অবরোধ গড়াতে পারে লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনে। রাজপথে আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারের ওপর বহির্বিশ্বের চাপ বাড়াতে অব্যাহত রাখা হবে কূটনৈতিক তৎপরতা। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য। তারা আরও জানান, বিএনপি অনেকটা ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’র দিকে চলে গেছে। এ অবস্থা থেকে পিছু হটলে ভবিষ্যতে তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ার আশংকা রয়েছে। দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এবারের আন্দোলনকে বাঁচা-মরার লড়াই হিসেবে দেখছেন। দলের চেয়ারপারসনও তাদের এমন নির্দেশনাই দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে এখন থেকে যেসব স্থানে আওয়ামী লীগ সভা-সমাবেশ করার ঘোষণা দেবে, বিএনপিও সেখানে পাল্টা সমাবেশ করার চিন্তা-ভাবনা করছে। তবে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আর আন্দোলনের সার্বিক কার্যক্রম খালেদা জিয়া নিজেই সার্বক্ষণিক মনিটর করছেন। পরবর্তীতে তিনি প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টদের। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যুগান্তরকে বলেন, সরকার তাদের রাজপথে নামতে বাধ্য করেছে। বারবার তাদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানানোর পরও তারা এতে পাত্তাই দেননি। এখন আর তাদের পেছনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। জনগণের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে। তিনি বলেন, ‘বিএনপির সিনিয়র নেতারা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন’ বলে সরকারের এমপি-মন্ত্রীরা নানা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন। সরকারের সঙ্গে সিনিয়র নেতাদের যোগাযোগ নেই। আর যোগাযোগের প্রশ্নই ওঠে না। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সব সিনিয়র নেতারা আন্দোলন সফল করতে কাজ করে যাচ্ছেন। বিএনপির সব নেতারাই ঐক্যবদ্ধ আছেন। তারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। যে যার পর্যায়ে, পথে বা উপায়ে আন্দোলনের অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে কাজ করছেন। বিএনপির আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সরকার নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু এসব করে আন্দোলন দাবিয়ে রাখা যাবে না। গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ থাকলেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় আছেন তিনি। কোনো বিভ্রান্তিতে কান না দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে নেতাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার ছক আগেই তৈরি করা হয়েছে। তা বাস্তবায়নের দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সারা দেশের অবরোধের বিষয়টি খালেদা জিয়া নিজেই মনিটর করছেন। অবরুদ্ধ অবস্থা তুলে দেয়া হলে তিনি আবারও রাজপথে নেমে আসার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন। বাসায় নয়, নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করে আন্দোলনকে যৌক্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে চান। স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য দাবি করে যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির যে প্রস্তুতি রয়েছে তার সবটুকু এখনও প্রয়োগ করা হয়নি। সরকার পতনের সূতিকাগার রাজধানী ঢাকার আন্দোলন শুরুই করেননি তারা। ইজতেমা শেষ হওয়ার পর শুরু হবে চূড়ান্ত আন্দোলন। যাতে ইজতেমায় আগত মুসল্লিরা নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। এর আগে ঢাকার বাইরে চূড়ান্ত আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর রাজধানীতে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারা। এদিকে ৫ জানুয়ারি থেকে চলমান আন্দোলনে নেতাকর্মীদের ওপর সন্তুষ্ট দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এভাবে চালিয়ে যেতে পারলে আন্দোলনের সফলতা আসবে বলেও মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। সূত্র জানায়, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ যাতে কোনোভাবেই রাজপথে বড় ধরনের শোডাউন করতে না পারে সে বিষয়টি নিয়েও চিন্তাভাবনা চলছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলে একই দিন বিএনপিও সমাবেশের ডাক দেবে। যাতে আইনশৃংখলা বাহিনী সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে বাধ্য হয়। তবে এ ব্যাপারে ১২ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠেয় আওয়ামী লীগের সমাবেশকে কেন্দ্র করে এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি। কেউ কেউ ওই দিন সমাবেশের ডাক দিতে পরামর্শ দিয়েছেন। আবার কেউ বলছেন, হরতালের ডাক দিতে। ডিএমপির পক্ষ থেকে এখনও সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের সমাবেশ নিয়ে ডিএমপি কি সিদ্ধান্ত নেয় সেদিকেও নজর রয়েছে তাদের। তবে দলের একাধিক নেতা চাচ্ছেন আপাতত সমাবেশ না করে কিছু দিন পরে করাই ভালো হবে। তবে আজকের মধ্যে এ বিষয়ে বিএনপির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে। সূত্র মতে, বিএনপির তৃণমূলসহ সাধারণ মানুষেরও ধারণা ছিল ইজতেমার কারণে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ শিথিল বা স্থগিত করা হবে। কারণ ইজতেমার পাশাপাশি শুক্র ও শনিবার ছিল সরকারি ছুটির দিন। কিন্তু তাদের সে ধারণা পাল্টে যায়। ইজতেমা ও ছুটির দিনেও কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পর কোনোভাবেই আন্দোলনের গতি কমবে না বরং বাড়বে বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। এজন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতির নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। যেসব নেতা আত্মগোপনে আছেন তাদের আরও সতর্ক করা হয়েছে। কোনোভাবেই গ্রেফতার হওয়া যাবে না এমন নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে শুরু থেকে অবরুদ্ধ থাকা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, কর্মসূচি চলছে, চলবে। সরকার যতটা কঠোর হবে তারা আরও বেশি কঠোর হবেন। কোনো ছাড় দেয়া হবে না। ইজতেমার পর আন্দোলন আরও জোরদার হবে। সূত্র জানায়, বিগত আন্দোলন কর্মসূচি চূড়ান্ত করার আগে সুশীল সমাজের প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি স্কুল ও কলেজের পরীক্ষা, ধর্মীয় উৎসব, মিত্র দেশগুলোর কূটনীতিকদের পরামর্শসহ জনদুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় রাখত দলটি। কিন্তু এবারের আন্দোলনে কোনোকিছুর তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ছুটির দিনের পাশাপাশি বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বড় জামাত বিশ্ব ইজতেমা চলাকালেও অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা চলছে। ২ ফেব্র“য়ারি শুরু হবে এসএসসি পরীক্ষা। কিন্ত এসব পরীক্ষার সময়সূচি নিয়েও তাদের কোনো ভাবনা-চিন্তা নেই। উদ্দেশ্য একটাই- আন্দোলনের সফল সমাপ্তি। দলের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, চলমান কর্মসূচি থেকে পেছনে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে হাইকমান্ডের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারণ এবার আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় সম্ভব না হলে নেতাকর্মী এবং দলের অস্তিত্বে টান পড়বে। তাই বাঁচামরার লড়াইয়ে নামতে হবে। টানা অবরোধের পর অসহযোগ ও হরতালে গড়াতে পারে আন্দোলন। এমন বার্তা সারা দেশের নেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। বিএনপি নেতাদের মতে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আরেকটি নির্বাচনের জন্য সরকার যে অঙ্গীকার করেছিল তার বাস্তবায়ন চায় সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও। বিএনপির এ আন্দোলনে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা রাজপথে না নামলেও নৈতিকভাবে তাদের সমর্থন পাওয়া যাবে। এরই মধ্যে তাদের রাজনৈতিক মিত্র বাড়ছে বলে মনে করছেন তারা। গত কয়েক দিনে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না এমনকি জাতীয় পার্টি থেকেও আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনে সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন এমনকি সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও একই দাবি জানানো হচ্ছে। বিষয়গুলোকে তারা আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় হিসেবেই দেখছেন। চলমান আন্দোলন আরও বেগবান করা গেলে অনেকেই তাদের দাবির প্রতি নৈতিক সমর্থন জানাবে। বিএনপির একজন নীতিনির্ধারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী দেশ অসন্তোষ প্রকাশ করে। এখনও তারা আগের অবস্থানেই রয়েছেন। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বিএনপির পক্ষ থেকে ওইসব দেশের সহায়তা চাওয়া হয়। কূটনীতিকরা তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেন, রাজপথে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলেই তাদের পক্ষে সরকারকে চাপ দেয়া সম্ভব হবে। কূটনীতিকদের এমন আশ্বাস পাওয়ার পর থেকে রাজপথে কঠোর আন্দোলনের ছক আঁকে তারা। জ্বালাও-পোড়াও, সহিংসতার দায় তাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করলেও সে সমালোচনায় কান দেবে না তারা। যে কোনো মূল্যে সরকারকে চাপে রাখাকেই অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। রাজপথের আন্দোলনে সরকারকে ইতিমধ্যে কিছুটা ভাবিয়ে তুলতেও তারা সক্ষম হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশের পরিস্থিতি কঠোরভাবে মনিটর করছে। সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে বলেও জানান তিনি।  

No comments:

Post a Comment