ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনালের উল্টোপাশের ফুটপাতে কয়েকটি ফলের দোকান, যার একটি অসিত চন্দ্র মিস্ত্রির। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় বাসযাত্রীরা ওই সব দোকান থেকে ফল কিনে নিয়ে যায়। জানুয়ারি মাসজুড়ে অবরোধে মহাখালী থেকে বাসের চলাচল একেবারেই কমে গেছে, যাত্রীসংখ্যা একেবারেই নগণ্য। ফলে অসিত চন্দ্রের ফলের দোকানে বেচাবিক্রিতে ভাটা পড়েছে। স্বাভাবিক সময়ে তিনি দিনে ১০ হাজার টাকার বেশি ফল বিক্রি করতে পারতেন; এখন বিক্রি হচ্ছে দিনে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা। সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকাকেও অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। গাড়ির চাকা ঘুরছে, তবে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম; পণ্য বিক্রি হচ্ছে, তবে আগের মতো নয়; কারখানায় কাজ হচ্ছে, তবে দিনমজুরদের দুর্দিন চলছে- সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে চলছে গতিহীনতা, যার প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবন-জীবিকায়। বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টানা অবরোধ ও মাঝেমধ্যেই হরতালে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা দূরপাল্লার পরিবহন শ্রমিকদের। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নির্মাণ শ্রমিক, শহরের হকার ও উত্তরবঙ্গের চাতাল শ্রমিক- এই পাঁচ শ্রেণির মানুষের জীবন-জীবিকার অবস্থা সবচেয়ে করুণ। দেশে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবরোধে তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কারখানায় উৎপাদন চলছে, মাস শেষে তারা তাদের প্রাপ্য মজুরি পাবে। কোনো মালিক মজুরি দিতে ব্যর্থ হলে আন্দোলন বা আইনিভাবে মজুরি আদায় করার সুযোগও আছে। কিন্তু স্বনিয়োজিত পেশার মানুষের সেই সুযোগ নেই, পাশাপাশি দিন ভিত্তিতে মজুরি পাওয়া শ্রমিকরাও কাজ না থাকলে আয়বঞ্চিত থাকছে। অবরোধে সবচেয়ে বিপাকে আছে পরিবহন খাতের ৫০ লাখ শ্রমিক। বিশেষ করে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী পরিবহন ও পণ্য পরিবহনের শ্রমিকদের অবস্থা খুবই করুণ। দিনের পর দিন গাড়ির চাকা না ঘোরায় তাদের সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে প্রাণ মুঠোয় নিয়ে অনেক শ্রমিক রাস্তায় বের হচ্ছে, অনেকের প্রাণও যাচ্ছে। গত ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া অবরোধে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজন ট্রাকচালকের সহকারী, অটোরিকশাচালক ও বাস শ্রমিককে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন মারাও গেছে। পরিবহন শ্রমিকদের আনুষ্ঠানিক মজুরি খুব কম। তবে আয় মোটামুটি ভালো থাকে স্বাভাবিক সময়ে। অবরোধে যাত্রী কমে যাওয়ায় আয়ও কমে যায়, ওই সামান্য আয়ের জন্য আবার প্রাণের ঝুঁকিও নিতে হয়। হানিফ পরিবহনের সুপারভাইজার মো. বাদল হাওলাদার অবরোধ শুরুর পর কোনো কাজ না থাকায় গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। তিনি বলেন, এক মাসে মোটামুটি ১০-১২টি 'ট্রিপ' পাওয়া যায়। পথের খরচ বাদ দিয়ে প্রতি 'ট্রিপে' হাজারখানেক টাকা থাকে। কিন্তু অবরোধে গাড়ি চলে কম, পুরো মাসে তিন-চারটি 'ট্রিপ'ও পাওয়া যায় না, যা দিয়ে মেসের খরচও জোগাড় হবে না। ট্রাকচালক ও হেলপারদের আয় হয় ভাড়ার কমিশন থেকে। একটি 'ট্রিপে' যে টাকা ভাড়া হবে তার একটি নির্দিষ্ট অংশ পাবে চালক ও শ্রমিকরা। ট্রাকের চাকা যত ঘুরবে তত আয় বেশি হবে চালক ও সহকারীর। মালিক সমিতির হিসাবে, দেশের মোট এক লাখ ২৭ হাজার ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের মধ্যে অবরোধে রাস্তায় চলে এর ৩০ শতাংশ। ফলে শ্রমিকদের এখন চরম দুরবস্থা চলছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে হেলপার মো. সোহাগ বলেন, আগে তিনি পাঁচ টন বহনক্ষমতার একটি ট্রাকে চালকের সহকারী ছিলেন। মালিকের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। অবরোধে ওই এলাকায় ট্রাক চলাচল প্রায় বন্ধ, মালিকও ঝুঁকি নিয়ে তাঁর ট্রাক রাস্তায় নামাতে রাজি নন। এ কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি গত ২০ জানুয়ারি থেকে সাভারের একজন চালকের সঙ্গে মিনি ট্রাকে কাজ করছেন। তিনি বলেন, 'মালিকের পয়সা আছে, এক-দুই মাস ট্রাক না চললেও তাঁর চলবে। কিন্তু আমার বসে থাকার উপায় নাই। প্রতি মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়।' এ মাসে এখনো কোনো টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'অল্প দূরত্বে ঝুঁকি কম। কিন্তু সব ট্রাকই এখন কম দূরত্বে যেতে চায়। ফলে ভাড়া পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে।' মহাখালীর ফলের দোকান মালিক অসিত চন্দ্র মিস্ত্রি এমন অবস্থা দেখেননি কখনো। ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে স্বাধীনতাযুদ্ধ দেখেছেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলন দেখেছেন; কিন্তু এমন টানা অবরোধ দেখেননি। একসময় তিনি নিজে মোটামুটি বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু ২০০৭ সালের সিডরে তাঁর ৬০ একর জমির আলু নষ্ট হয়ে যায়, তাতে লোকসান হয় বিপুল অঙ্কের টাকা। এরপর ঢাকায় এসে মহাখালীতে ফলের দোকান দিয়ে কোনো রকমে চলছেন তিনি। এই কোনো রকম চলায়ও আঘাত হেনেছে অবরোধ-হরতাল। গত এক মাসে তাঁর প্রায় ১০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগে দিনে দুই ক্যারেট (২৫ কেজি করে) আঙুর বিক্রি হতো, এখন দুই দিনে এক ক্যারেট হয় না। অনেক ফল নষ্ট হয়েছে। অনেক ফল কম দামে বিক্রি করে দিতে হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা যায়, এখন লন্ড্রি, চাবি মেরামতকারী মিস্ত্রি, ফটোগ্রাফার- দেশে এমন ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ২২ লাখ ৭৫ হাজার। তাদের অনেকের অবস্থাই এখন অসিত মিস্ত্রির মতো করুণ। দেশে সেলুন রয়েছে তিন লাখ ৬০ হাজার, লন্ড্রি পাঁচ লাখ, মোবাইল ও টিভি-রেডিও মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান সাড়ে তিন লাখ, মুচি ১৪ লাখ, স্টুডিও ৭৪ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে মালিক নিজে ছাড়াও পাঁচ লাখ ১০ হাজার শ্রমিককে নিয়োগ দিয়েছেন। বছরে এসব কর্মকাণ্ড থেকে অর্থনীতিতে ২১ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা যোগ হচ্ছে; কিন্তু অবরোধে কোনো না কোনোভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছেন এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ঢাকার ফুটপাত বা ট্রাফিক সিগন্যালে ভ্রাম্যমাণভাবে পণ্য বিক্রি করে জীবন চলে অনেক হকারের। ঢাকাসহ পুরো দেশে এ রকম হকারের সংখ্যা নিয়ে কোনো জরিপ হয়নি। অর্থনীতিতে তাদের অবদান নিয়েও কোনো গবেষণা নেই। তবে অবরোধে তাদের আয় কমেছে, চাপ পড়েছে সংসারে। অবরোধের মধ্যে হরতাল দিলে তাদের আয় আরো কমে যায়। রাস্তায় যানজট হয় না, সিগন্যালে পণ্য বিক্রিও হয় না। রাজধানীর বিজয় সরণি মোড়ে পান-সিগারেট বিক্রি করে জীবন চলে মো. উজ্জ্বলের। তাঁর বাবাও একই কাজ করেন। গতকাল গায়ে ব্রাজিলের ফুটবলার নেইমারের মতো জার্সি পরে পান-সিগারেট বিক্রি করছিলেন উজ্জ্বল। তিনি জানান, বুধবারও ৪০০ টাকা বিক্রি করেছিলেন, গতকাল দুপুর ১টা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫০ টাকা। তিনি বলেন, রাস্তা ফাঁকা, কেনার মতো লোক নেই। তাই তাঁকে বিজয় সরণি মোড়ে রেখে বাবা গেছেন অন্য এলাকায় বিক্রি করতে। নির্মাণ শ্রমিকদের বসন্ত আসে শীতকালে। এ ঋতুতে বৃষ্টি হয় না বলে নির্মাণকাজে গতি আসে। পুরো মৌসুমেই নির্মাণ শ্রমিকদের চাহিদা বেশি থাকে। কিন্তু এ বছরের শুরুতেই মাসজুড়ে অবরোধে নির্মাণ শ্রমিকের চাহিদায় ভাটা পড়েছে। একদিকে অবরোধে ট্রাকভাড়া বেড়ে যাওয়ায় ব্যক্তিমালিকরা নির্মাণ উপকরণ এনে বাড়ি তৈরির কাজ করাতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না, অন্যদিকে নির্মাণপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি কাজেও গতি কমেছে। ফলে নির্মাণ শ্রমিকদের জীবিকাও অচল হয়ে পড়েছে। রাজধানীর কাজীপাড়ার বাইশবাড়ী এলাকায় গতকাল কাজ করছিলেন আবদুল মালেক। তিনি দলের নেতা। তাঁর দলে সদস্যসংখ্যা আট। রাজমিস্ত্রির দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা, সহকারীর ৩৫০ টাকা। আবদুল মালেক বলেন, 'শীতে আমরা এক দিনও বসে থাকিনি। এক কাজ শেষ হওয়ার আগেই অন্য কাজের ডাক পড়েছে। কিন্তু এবার চলতি মাসে ১০ দিন বসে ছিলাম।' তিনি বলেন, বাজারে কাজের চাপ কম। অবরোধের কারণে মালিকরা মাল আনতে পারেন না। খরচ বেশি, এ কারণে অনেকে ইচ্ছা করেও আনেন না। বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের (ইনসাব) সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুর রাজ্জাক জানান, সরকারি হিসাবে নির্মাণ খাতে ২৬ লাখ শ্রমিক কাজ করে। তবে তাদের হিসাবে এ সংখ্যা ৩৫ লাখ। প্রায় সবার জীবিকাই এখন 'অবরুদ্ধ' হয়ে আছে। দেশে মোট চালকলের সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। অনুমানভিত্তিক হিসাবে, এসব চালকলে কাজ করে প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক। তাদের ৯৫ শতাংশই দৈনিক মজুরিভিত্তিক। মিলে কাজ থাকলে তারা দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পায়, কাজ না থাকলে এক টাকাও নয়। বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, মিলগুলোর মধ্যে ৮০ শতাংশ এখন বন্ধ। বাকি ২০ শতাংশে উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। একদিকে ভারতীয় চালের আগ্রাসন, অন্যদিকে অবরোধ-হরতালে চাল বিক্রি করতে না পারাই এর কারণ। শ্রমিকদের বেশির ভাগই বর্তমানে বেকার।
No comments:
Post a Comment