
ি। তাই শুল্ক দিয়ে আসা চীনা পণ্যও বাংলাদেশে বিক্রি হয় অনেক কমে। বাংলাদেশি পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে গিয়েও পড়তে হচ্ছে একই বিপাকে। বর্তমান সুদের হার বিশ্লেষণ করে একজন ব্যবসায়ী কালের কণ্ঠকে বলেন, চীনে যে পণ্য উৎপাদনে ১০০ টাকা খরচ হয়, শুধু সুদের হার বেশি থাকার কারণে বাংলাদেশের কোনো ব্যবসায়ীকে একই পণ্য উৎপাদনে ব্যয় করতে হয় ১০৬ টাকা ৪৯ পয়সা। ১০০ টাকার পণ্যে ১০ টাকা মুনাফা করে চীন তার পণ্য ১১০ টাকায় বিক্রি করতে পারে। সমপরিমাণ মুনাফা করতে হলে একই পণ্য বাংলাদেশকে বেচতে হয় ১১৭ টাকা ১৪ পয়সায়। কিন্তু একই মানের পণ্য হওয়ায় চীনা পণ্য রেখে বাংলাদেশি পণ্য কিনতে ক্রেতাদের আগ্রহ থাকে না। এভাবেই কম সুদের দেশগুলোর পণ্যের কাছে দেশে-বিদেশে মার খাচ্ছে বাংলাদেশি পণ্য। কেবল চীনই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য, কৃষি এবং হিমায়িত খাদ্যের মূল প্রতিযোগী ভারত, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ায়ও সুদহার অনেক কম। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে বাংলাদেশি পণ্য। সেসব দেশে কম খরচে উৎপাদিত পণ্য অবাধে আমদানি হচ্ছে বাংলাদেশেও। বিদেশ থেকে কম মূল্যে আনা এসব পণ্যের সঙ্গে দামের প্রতিযোগিতায় স্থানীয় বাজারেও কুলিয়ে উঠছে না দেশে উৎপাদিত পণ্য। ফলে বিনিয়োগ থেকেই হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় ক্ষুব্ধ অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। চীন, মালয়েশিয়া, ভারত, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সুদহার পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের সুদহার হ্রাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছে কমিটি। কমিটির সদস্যরা বলেছেন, গত ছয় বছরে দেশের অবকাঠামোগত খাতে বেশ উন্নয়ন হয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামোতেও দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। বিদ্যুৎ-জ্বালানি উৎপাদন বেড়েছে। তা সত্ত্বেও দেশে বিনিয়োগ না বাড়ার মূল কারণ ব্যাংকের উচ্চ সুদহার। সুদহার কমানোর জন্য প্রয়োজনে ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয়, সার্ভিস চার্জ ও অন্যান্য ব্যয় কমাতে গণশুনানি আয়োজনের কথাও বলেছেন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। বিশ্বব্যাংকের ২০১৩ সালের তথ্যানুযায়ী, চীনে ঋণের সুদহার ৬ ও মালয়েশিয়ায় ৪.৬ শতাংশ। এ ছাড়া ভারতে ১০.৩, ভিয়েতনামে ১০.৪ ও শ্রীলঙ্কায় ঋণের সুদহার ১০.৫ শতাংশ। আর ১৯৯৮ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ঋণের সুদহার ২.৫ শতাংশ। গত ১৬ বছরে এই সুদহার বেড়ে ২০০০ সালে সর্বোচ্চ ৪.৭৫ ও সর্বনিম্ন ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে নেমেছে। অন্যদিকে গত এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশে এখন সুদহার সবচেয়ে কম। তবুও এই হার প্রতিযোগী অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত অক্টোবরে গড় সুদহার ছিল ১২.৪৯ শতাংশ। কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়ীদের ১৬ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত সুদে ঋণ নিতে হয়েছে। বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার নিয়ে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার দাবি করে তাঁরা বলছেন, এত উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এতে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যায়। ফলে বেসরকারি খাত বিনিয়োগে আগ্রহ হারায়। দেশের ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ধরে সুদহার এক অঙ্কে (১০ শতাংশের নিচে) নামানোর জন্য সরকার ও ব্যাংকগুলোর কাছে মিনতি করছেন। অবশ্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সুদহার নির্ধারণের জন্য গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী নিজেও। তাতে কোনো কাজ হয়নি। উচ্চ সুদহারের কারণে বাংলাদেশে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। গত ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় কমিটির সভাপতি ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রেই সরকারের অর্জন অনেক বেশি। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগের সমস্যা অনেকটা কমলেও উচ্চ সুদহার বিনিয়োগে বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদহার কমাতে হবে। স্থায়ী কমিটির সদস্য টিপু মুন্সি বলেন, বাংলাদেশের ঋণের গড় সুদহার এখন ১২.৪৯ শতাংশ। এই হার আরো কমানো হলে ব্যবসার জন্য অনুকূল হবে। ঋণের সুদহার ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান এখন ৫ শতাংশ। একে ৪ শতাংশে নামানো বিনিয়োগের জন্য সহায়ক হবে। বিদেশের ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের আরো কম সুদে ঋণ দিচ্ছে। অসৎ ব্যবসায়ীদের খেলাপি ঋণের দায়ের কারণে সব ব্যবসায়ী অতিরিক্ত সুদহার বহন করবেন- এমনটা কাম্য হতে পারে না। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়া উচিত। কমিটির আরেক সদস্য মো. শওকত আলী চৌধুরী বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো সুদের হার কমালেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো সে অনুযায়ী কমাচ্ছে না। তাই সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকের ঋণের সুদহার ও আমানতের সুদহার কমানো উচিত। ভারত, শ্রীলঙ্কা, ব্রাজিল, চীন- এসব দেশের ব্যাংকের সুদহারের সঙ্গে তুলনা করে বাংলাদেশেও সুদহার নির্ধারণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয়, সার্ভিস চার্জ আদায় কমাতে হবে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলম বলেন, বাজার অর্থনীতির এ সময়ে চাপিয়ে না দিয়ে ব্যাংক সুদহার কমানোর জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ফলে ২০১৩ সালে আমানতের সুদহার যেখানে ৮.৬৭ শতাংশ ছিল, এখন তা কমে হয়েছে ৭.৪০ শতাংশ। একইভাবে গত এক বছরে ঋণের গড় সুদহার ১৩.৭৩ শতাংশ থেকে কমে ১২.৪৯ শতাংশে নেমেছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর উচ্চ পরিচালন ব্যয় এবং ৪২.৫ শতাংশ হারে করপোরেট ট্যাক্স আরোপ করায় সুদহার দ্রুত কমানো যাচ্ছে না। উচ্চ সুদহারের কারণেই বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে- উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওসমান ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যখন ব্যাংকগুলো ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, তখন ভালো ঋণগ্রহীতারা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দেন। ওই সময় খারাপ ঋণগ্রহীতারা ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেন। পরে ঋণগ্রহীতারা সেই ঋণ আর পরিশোধ করেন না বা করতে পারেন না। ফলে ব্যাংকগুলোতে খেলাপির পরিমাণ ও জালিয়াতি বেড়ে যায়। আবার খেলাপি ও জালিয়াতি বেড়ে যাওয়ার প্রভাবেও ঋণের সুদের হার বেড়ে যায়। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন সেই দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।'
No comments:
Post a Comment