Monday, January 12, 2015

ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেল তিন নারী পুলিশের:কালের কন্ঠ

পুলিশবাহী বাসে ট্রাকের ধাক্কায় গতকাল রবিবার রাজধানীর ফকিরাপুলে দুই নারী পুলিশ এবং দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ট্রাক ও সিএনজি অটোরিকশার সংঘর্ষে আরেক নারী পুলিশসহ পাঁচজনের মর্মা
ন্তিক মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ২৭ জন নারী পুলিশ সদস্য। নিহতরা হলেন মামুলী খাতুন (২২), আকলিমা বেগম (২৪) ও সেলিনা আক্তার (২৫)। মামুলীর গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুরে, আকলিমার বাড়ি কিশোরগঞ্জ এবং সেলিনা আক্তারের বাড়ি জামালপুর সদরে। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ফরিদা, লিলি, জেসমিন, সীমা, আলফা, শাহনাজ, লিজা, সোহাগা ও সালমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত অন্য ১৮ জনকে ভর্তি করা হয়েছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে। ঘটনার পরপরই নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, স্বরাষ্ট্রসচিব মোজাম্মেল হক খান, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক, ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়াসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা ঢামেক হাসপাতাল ও রাজারবাগ হাসপাতালে ছুটে যান। আইজিপি শহীদুল হক ঢামেক কর্তৃপক্ষকে আহত নারী কনস্টেবলদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে নিহতদের ব্যাপারে গভীর শোক প্রকাশ করেন। নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহতদের চিকিৎসা ও নিহতদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান পুলিশপ্রধান শহীদুল হক। ঢামেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মুশফিকুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, এখানে ভর্তি চারজন ক্যাজুয়ালটি, চারজন নিউরো সার্জারির অধীনে আছেন। তাঁদের সবাই আশঙ্কামুক্ত। আকলিমা (বাঁয়ে), মামুলী পুলিশ সূত্র জানায়, পুলিশ কন্ট্রোল রুমে দায়িত্ব পালনের জন্য ভোরে নারী সদস্যদের নিয়ে রিকুইজিশন করা পুলিশবাহী বাসটি রাজারবাগ পুলিশ লাইনস থেকে আবদুল গণি রোডের দিকে যাচ্ছিল। ফকিরাপুল মোড়ে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে মতিঝিল থেকে কাকরাইলের দিকে চলা একটি ট্রাক বাসটির মাঝামাঝি গায়ে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে বাসটি উল্টে গিয়ে রাস্তায় আছড়ে পড়ে। পুলিশসহ আশপাশের লোকজন দ্রুত এগিয়ে এসে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। এর মাঝে ঘটনাস্থলেই মারা যান মামুলী (কং-নং ২২১৭৬) ও আকলিমা (কং-নং ২৫১৭২)। আহত অবস্থায় ২৭ জনকে রাজারবাগ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখান থেকে গুরুতর ৯ জনকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতদের বরাত দিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, ভোর সোয়া ৬টার দিকে ফকিরাপুল এলাকায় এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। ওই বাসে ২৯ জন নারী পুলিশ সদস্য ছিলেন। তাঁদের সবাই কমবেশি আহত হয়েছেন। ঘটনার পরপরই মালাবাহী ট্রাক ফেলে রেখেই চালক-হেলপার পালিয়ে যায়। পুলিম জানায়, ট্রাকটি জব্দ করা হয়েছে। ট্রাকের চালক সেলিম মিয়াকে মাদারীপুরের শিবচর থেকে রাতে গ্রেপ্তার করা হলেও পলাতক হেলপারকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশানর (এসি) মামুন মোস্তফা বলেন, ডিএমপির পক্ষ থেকে নিহতদের লাশের দাফনসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ৩৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আহতদের চিকিৎসা-সংক্রান্ত যাবতীয় খরচসহ সব কিছু বহন করবে ডিএমপি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাত্র তিন মাস আগে (২০১৪ সালের ২৫ আগস্ট) পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি নিয়েছিলেন নিহত মামুলী খাতুন। চাকরির শুরুতেই রাজনৈতিক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয় তাঁকে। নানা সহিংস কর্মকাণ্ডের মোকাবিলা করতে হচ্ছিল তাঁকেসহ সহকর্মীদের। গত দুই মাসে হরতাল, টানা অবরোধে একটানা ডিউটি করতে হয় তাঁকে। বিশ্রাম নেওয়ার তেমন একটা সুযোগও ছিল না। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিরামহীন সময় পার করতে হচ্ছে মনিরার মতো অধিকাংশ পুলিশ সদস্যদের। কালের কণ্ঠের পার্বতীপুর প্রতিনিধি জানান, ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পুলিশ কনস্টেবল মামুলীর গ্রামের বাড়ি পার্বতীপুরের ভবানীপুরে চলছে আহাজারি ও শোকের মাতম। এলাকার শত শত মানুষের ভিড়ে সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে। মা ফুলজান বানু, বাবা বুলু মণ্ডল ও স্বজনদের আহাজারি এবং কান্নায় পরিবেশ শোকাবহ হয়ে উঠেছে। মা, বাবা ও একমাত্র ছোট বোন বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। মা-বাবার দুই কন্যাসন্তানের মধ্যে মামুলী ছিলেন বড়। ছোট বোন ইশরাত জাহান সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। মামুলী কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাসের পর ট্রেনিং শেষে গত ১২ অক্টোবর পুলিশের চাকরিতে যোগদান করেন। তাঁর চাকরির বয়স হয়েছিল মাত্র তিন মাস। অনেক আশায় বুক বেঁধে মা-বাবার অভাবের সংসারের হাল ধরেছিলেন মামুলী। কিন্তু ঘাতক ট্রাক অকালে কেড়ে নিল তাঁর প্রাণ। মা ফুলজান বানু বারবার বিলাপ করে বলছিলেন, ‘মামুলী আমার ছেলের অভাব পূরণ করেছিল। আমরা আর কোন আশায় বাঁচব?’ পার্বতীপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহমুদুল আলম গতকাল সন্ধ্যায় জানান, নিহত পুলিশ কনস্টেবল মামুলী খাতুন ট্রেনিং শেষে তিন মাস আগে ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চাকরিতে যোগ দেন। রাজারবাগে জানাজা শেষে তাঁর লাশ দাফনের জন্য পার্বতীপুরে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে। ওদিকে নিহত আকলিমা পুলিশে যোগ দেন ২০১১ সালের ১৪ আগস্ট। দুর্ঘটনায় আহত ফরিদা বেগম বলেন, ‘চোখ বন্ধ করলেই বিভীষিকার মতো দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ছে। গা শিউরে উঠছে। এমন ভয়ানক অবস্থায় কখনই পড়িনি।’ অন্যদিকে গতকাল বিকেল পৌনে ৩টার দিকে কেরানীগঞ্জের নাজিরবাগ এলাকায় ট্রাক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে পুলিশ কনস্টেবল সেলিনা আক্তার (২৩) এবং অজ্ঞাতপরিচয়ের অটোরিকশাচালকের (২৮) মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। কনস্টেবল সেলিনা ছিলেন অটোরিকশার যাত্রী। দুর্ঘটনায় গুরুতর অবস্থায় অজ্ঞাতপরিচয়ের এক নারীকে (৩০) স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তাঁরও মৃত্যু হয়। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি জামাল উদ্দীন মীরের বরাত দিয়ে আমাদের কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পাঁচ বছর আগে পুলিশে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন সেলিনা। দুই মাস আগে বদলি হয়ে আসেন কদমতলী থানায়। গতকাল দায়িত্ব পালনের ফাঁকে থানায় যাচ্ছিলেন দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। পথেই তিনি দুর্ঘটনার শিকার হন। জানাজা : গতকাল দুপুর ১২টার দিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে নিহত আকলিমা ও মামুলীর জানাজায় অংশ নেন আইজিপি, ডিএমপি কমিশনারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরে তাঁদের মৃতদেহ নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে সন্ধ্যা ৭টার দিকে গেণ্ডারিয়া থানার মিলব্যারাকে সেলিনার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর শোক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহিলা পুলিশ সদস্যদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। গতকাল এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী নিহত মহিলা পুলিশ সদস্যদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী রায়েরবাজারে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ফাতেমা নামের একটি শিশুর মৃত্যুতেও শোক প্রকাশ করেন।

No comments:

Post a Comment