Friday, January 2, 2015

উড়ে গেছে বিমানের ১০৫ কোটি টাকা:যুগান্তর

বাংলাদেশ বিমানের বৈদেশিক স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হোটেল বিলে অনিয়ম-দুর্নীতি, অননুমোদিত জনবল নিয়োগ এবং অতিরিক্ত ফ্লাইং আওয়ারের নামে গত ৫ বছরে ৭৬ কোটি টাকার বেশি অর্থ লোপাট হয়েছে। এর সঙ্গে গত হজ মৌসুমে ৩ মাসে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ক্রুদের হোটেলে রেখে প্রায় ২৫ কোটি টাকা গচ্চা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিলম্বিত ফ্লাইটে যাত্রীসংখ্যা বেশি দেখিয়ে আরও ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে লোপাটের পরিমাণ প্রায় ১
০৫ কোটি টাকা। খোদ সরকারি অডিট আপত্তিতে এই অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। অডিট আপত্তিতে বলা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়োগ চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে বিমানকর্মীদের আর্থিক সুবিধা দেয়া হয়েছে। এছাড়া নীতিমালা অনুযায়ী একটি কক্ষে দু’জন কর্মী থাকার নিয়ম থাকলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাদের পছন্দের লোকদের সিঙ্গেল রুম দিয়ে বিমানকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এছাড়া ফ্লাইট সার্ভিস বিভাগ বিধিবহির্ভূতভাবে কতিপয় বিমানকর্মীকে অতিরিক্ত ফ্লাইং আওয়ার দিয়েও বিমানের অর্থ তসরুপ করেছে। জানা গেছে, নিয়ম-নীতির তোয়াক্তা না করে শুধু অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে হোটেলে অবস্থানের জন্যই বছরে বিমানের ক্ষতি হচ্ছে ১২ কোটি ২১ লাখ টাকা। এই হিসাবে গত ৫ বছরে এই খাতে ক্ষতি হয়েছে ৬১ কোটি টাকা। অপরদিকে বিধিবহির্ভূতভাবে ফ্লাইং আওয়ার দিয়ে এবং জনবল কাঠামোর বাইরে কর্মী নিয়োগ করে গত ৫ বছরে ১৫ কোটি টাকার বেশি অর্থ লোপাট হয়েছে। অডিট বিভাগ আপত্তিকৃত এই টাকা বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আদায় করার সুপারিশ করেছে। হজ মৌসুমে সৌদি আরবের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ফ্লাইট যাত্রী নিয়ে যাবে। ফেরার সময় খালি আসবে। এ কারণে প্রতি বছর ক্রুদের জন্য কোনো হোটেল বরাদ্দ রাখা হতো না। ফেরার পথে ক্রুরা ঘুমিয়ে কিংবা বিশ্রাম নিয়ে আসতে পারবে বলে হোটেল ব্যবহার করা হতো না। কিন্তু গত বছর হজ মৌসুমের তিন মাস এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ফ্লাইট নিয়ে যেসব ক্রু জেদ্দা যেতেন তারা ফিরতি ফ্লাইটে না এসে হোটেলে উঠতেন। এতে ওই তিন মাসে প্রায় ২৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত হোটেল বিল গুনতে হয়েছে। পাশাপাশি ক্রু সংকটে ফ্লাইট সিডিউল নিয়েও ভোগান্তিতে পড়তে হয় বিমানকে। অডিট আপত্তিতে বলা হয়েছে, বিমানের আউট স্টেশনে ক্রুদের অবস্থানের জন্য কমপক্ষে ৩০টি উন্নতমানের হোটেলের সঙ্গে বিমানের একক কক্ষ ও দ্বিকক্ষের চুক্তি আছে। কিন্তু এসব হোটেলে কোন পর্যায়ের ক্রু সিঙ্গেল রুম পাবেন তা নিয়ে কোনো নীতিমালা করেনি ফ্লাইট সার্ভিস বিভাগ। এ কারণে সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাদের পছন্দের ক্রুদের সিঙ্গেল রুম এবং অপছন্দের ক্রুদের মধ্য থেকে ২ জনকে এক রুম বরাদ্দ দিয়ে আসছে। বর্তমানে বিমানের ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ৩৯ জন চিফ পার্সার, ৪০ জন পার্সার, ১৪৭ জন জুনিয়র পার্সার ও ১৩১ জন স্টুয়ার্ড ও স্টুয়ার্ডেস রয়েছেন। তারা যথাক্রমে সপ্তম, ষষ্ঠ, পঞ্চম ও চতুর্থ গ্রেডে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। তাছাড়া দৈনিক ভিত্তিতে ৫ জন জুনিয়র পার্সার ও ১৫ জন স্টুয়ার্ড/স্টুয়ার্ডেস রয়েছেন, যারা নির্ধারিত ৯০ দিনের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের মূল বেতন ১২শ’ মার্কিন ডলার। এছাড়া ওভারসিস অ্যালাউন্স, ইউনিফর্ম ভাতা, ট্রান্সপোর্ট ও মেডিকেল সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু বিদেশে অবস্থানকালে দৈনিক ভিত্তিক ক্যাজুয়াল ক্রু (জুনিয়র পার্সার) ও স্থায়ী জুনিয়র পার্সারদের প্রাপ্য সুবিধার বিষয়ে কোনো নীতিমালা করেনি সংশ্লিষ্ট বিভাগ। বিমানের ক্রু কমপ্লিমেন্টস অনুযায়ী চিফ পার্সার, ফ্লাইট পার্সার ও জুনিয়র পার্সারদের আউট স্টেশনে দায়িত্ব পালনকালে সিঙ্গেল কক্ষে অবস্থান করার কথা। এছাড়া পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মচারীরা ২ জন এক রুম ব্যবহার করার কথা। নিয়োগের সময় এ বিষয়ে তারা অঙ্গীকারনামাও দিয়েছেন। তারপরও দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া জুনিয়র পার্সারদের অনৈতিকভাবে সিঙ্গেল রুম দেয়া হচ্ছে। ৫ বছর ধরে নিয়ম না মেনে এ বাবদ কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে বিমান। ২০১২-১৩ অর্থবছরে গচ্চা গেছে ১২ কোটি ২১ লাখ টাকা। এছাড়া ফ্লাইং অ্যালাউন্স প্রদান করে প্রতি বছর বিমানকে গচ্চা দিতে হচ্ছে ২৫ লাখ ২ হাজার টাকা করে। অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতি করার জন্য গত ৫ বছরেও সিন্ডিকেট বিমানের ফ্লাইট স্টুয়ার্ডদের জ্যেষ্ঠতার তালিকা এফসিপিতে (ফাইনাল ক্রু পজেশনিং) উঠায়নি। এর মধ্যে ১০২ জন ফ্লাইট স্টুয়ার্ড/স্টুয়ার্ডেস পদোন্নতি পেয়ে জুনিয়র পার্সার হলেও রহস্যজনক কারণে তাদের নাম এফসিপিতে প্রকাশ করা হয়নি। উল্টো স্থায়ী কর্মীদের বাদ দিয়ে এফসিপিতে কতিপয় ক্যাজুয়াল ক্রুর (সি-নম্বরধারী) নাম জ্যেষ্ঠ কর্মী হিসেবে উঠানো হয়েছে। তাদের পদোন্নতি দিয়ে ক্রু তালিকার শীর্ষে রাখা হয়েছে। বৈদেশিক স্টেশনে যাওয়ার পর তাদের সিঙ্গেল রুম দেয়া হচ্ছে। অডিট আপত্তিতে বলা হয়েছে, জুনিয়র পার্সার পদে ১০২ জন অতিরিক্ত কর্মরত থাকার পরও দৈনিক ভিত্তিতে ৫ জন পার্সার নিয়োগ দেয়া হয়। তারা হলেন- দিলরুবা আক্তার, ফাওমিদা, সায়দা নাজনিন, ফারহানা আহমদ ও নাহিদ সুলতানা। এদের প্রতি মাসে অবৈধভাবে ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। গত বছর তাদের অবৈধভাবে পরিশোধ করা হয়েছে ৬৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। জানা গেছে দুবাই, আবুধাবি, কুয়েত, মাসকট, দাম্মাম, ফ্রাঙ্কফ্রুর্ট, জেদ্দা, রিয়াদ, লন্ডন, রোমের বেশির ভাগ ফ্লাইটে যাচ্ছেন সিন্ডিকেটভুক্তরা। এভাবে ক্রুদের মাধ্যমে চোরাচালানেরও অভিযোগ আছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, যদি এফসিপি অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ক্রু সিডিউলিং হতো তাহলে এই সিন্ডিকেট ভেঙে যেত। সম্প্রতি সরকারি এক অডিট আপত্তিতে বলা হয়েছে, বিমানের সাংগঠনিক কাঠামোতে শূন্য পদ না থাকার পরও অনিয়মিতভাবে দৈনিক ভিত্তিতে ক্রু নিয়োগ করে বছরে বিমানের কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। তাদের ৯০ দিনের জন্য নিয়োগ করা হলেও রহস্যজনক কারণে গত ৫ বছর ধরে তারা বিমানে কর্মরত আছেন। এদের বেশির ভাগের মাসিক বেতন ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা করে। এ প্রসঙ্গে বিমানের পরিচালক (ফাইনান্স) মঞ্জুর ইমাম যুগান্তরকে জানান, অডিট আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। বিমান পরিচালনা পর্যদের একজন সদস্যকে প্রধান করে অডিট আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি কাজও করছে। তিনি বলেন, ১০৫ কোটি টাকার অডিট আপত্তির সবগুলোই অনিয়ম কিংবা লোপাট নয়। অনেক বিল যথাযথ নিয়ম মেনেই পরিশোধ করা হয়েছে। তারপরও নানা কারণে আপত্তি আসে। এরই মধ্যে অনেক আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে। যদি কোনো আপত্তিতে অনিয়ম প্রমাণিত হয় তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হবে।  

No comments:

Post a Comment