Thursday, January 15, 2015

খামারিদের দুধ বিক্রি হচ্ছে না, পাস্তুরিত দুধের সংকট:প্রথম অালো

চলমান টানা অবরোধে দেশে তরল দুধ উৎপাদনকারী সবচেয়ে বড় অঞ্চল পাবনা-সিরাজগঞ্জ থেকে দুধ সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খামারিদের দুধ যেমন বিক্রি হচ্ছে না, তেমনি দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও চাহিদামতো পাস্তুরিত তরল দুধ সারা দেশে সরবরাহ করতে পারছে না। পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে ৪ হাজার ছোট-বড় দুগ্ধ খামারি রয়েছেন। এই অঞ্চল থেকে প্রতিদিন সাড়ে ৩ লাখ লিটার দুধ সংগৃহীত হয়। প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুল
ো খামারিদের কাছ থেকে এসব দুধ প্রতি লিটার ৪৩ থেকে ৪৭ টাকায় কেনে। কিন্তু এখন তারা না কেনায় দুধের দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। মিল্ক ভিটা সব সময় দৈনিক খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করলেও অবরোধ শুরু হওয়ার পর করছে এক দিন পর পর। ব্র্যাক ও প্রাণের মতো বড় বেসরকারি প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের দুধ সংগ্রহও অর্ধেকের নিচে নেমেছে। ফলে চাহিদা না থাকায় খামারিদের এখন অর্ধেক দামে স্থানীয় মিষ্টির দোকান ও বাজারে দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে। অনেকে বাকিতেও দুধ বিক্রি করছেন। তা–ও সব দুধ বিক্রি হচ্ছে না। এসব কারণে প্রতিদিন খামারিদের আনুমানিক ৫০ লাখ টাকার লোকসান হচ্ছে। এই লোকসান সামলাতে না পেরে কিছু খামারি তাঁদের গাভি বিক্রি করে দিচ্ছেন। মিল্ক ভিটার সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী কারখানার ব্যবস্থাপক মো. ইদ্রিস আলী গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কারখানার ধারণক্ষমতা ২ লাখ লিটার। সংগ্রহ করা দুধের পুরোটাই ঢাকায় পাঠানো হয়। যেদিন পুলিশ পাহারায় ঢাকায় পাঠানো হয়, তার পরদিন দুধ সংগ্রহ করা হয়। নইলে হয় না। খামারি ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলার দুধকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে সমবায়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা। এই অঞ্চল থেকেই বেশি দুধ সংগ্রহ করে ব্র্যাক, প্রাণ, আকিজ ও আফতাবের মতো প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই অঞ্চল থেকে যত দুধ সংগৃহীত হয় তার মধ্যে মিল্ক ভিটাই নেয় দেড় লাখ থেকে পৌনে ২ লাখ লিটার। বাকি দুধের বড় অংশই সংগ্রহ করে ব্র্যাক ও প্রাণ। তবে ৬ জানুয়ারি অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবে দুধ সংগ্রহ করতে পারছে না। ব্র্যাক ডেইরির কারখানা ব্যবস্থাপক আমতাজ আলী প্রথম আলোকে বলেন, শীতকালে দুধের চাহিদা অন্য সময়ের চেয়ে একটু কম থাকে। তবুও স্বাভাবিক সময়ে শীতে প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৩০ হাজার লিটার দুধ সংগৃহীত হয়। এখন হচ্ছে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার লিটার। এর ৭০ শতাংশই সিরাজগঞ্জ-পাবনা অঞ্চল থেকে আসে। তিনি বলেন, ‘আমরা চাইলে চাহিদামতো দুধ সংগ্রহ করতে পারি। কিন্তু দুধবাহী ট্যাংকারগুলো ঢাকায় পাঠাব কীভাবে? দামি ট্যাংকারগুলো অবরোধের মধ্যে এমনিতেই ঝুঁকি নিয়ে চলছে।’ স্বাভাবিক সময়ে প্রাণ প্রতিদিন দেড় লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে। এখন করছে ৫০ হাজার লিটারের মতো। এই দুধ সংগ্রহ হচ্ছে পাবনার চাটমোহর ও নাটোরের গুরুদাসপুর থেকে। সিরাজগঞ্জসহ অন্য সব জায়গা থেকে দুধ সংগ্রহ বন্ধ রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান বলেন, ‘দুধ তো ঢাকায় আনতে পারছি না। তাই সংগ্রহ কমিয়ে দিতে হয়েছে। অনেক জায়গা থেকে দুধ সংগ্রহ বন্ধ রেখেছি আমরা।’ প্রতিষ্ঠানগুলো না কেনায় খামারিদের দুধ বিক্রি হচ্ছে না। এতে তাঁরা বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন স্থানীয় মিষ্টির দোকান, বাজার ও ক্ষুদ্র ক্রেতাদের। এর পরও অনেক দুধ অবিক্রীত থাকছে। শাহজাদপুর উপজেলার রেশমবাড়ী প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুস সামাদ জানান, তাঁদের সমিতির সদস্যভুক্ত খামারি আছেন ২৭৫ জন। প্রতিদিন সাড়ে ৩ তিন হাজার লিটার দুধ উৎপদিত হয়। পুরো দুধ মিল্ক ভিটায় সরবরাহ করা হয় চর্বিভেদে ৪৩ থেকে ৪৭ টাকায়। মিল্ক ভিটা সংগ্রহ বন্ধ রাখায় অর্ধেক দামে স্থানীয় মিষ্টির দোকানে বিক্রি করতে হচ্ছে। বাকিতেও বিক্রি করতে হচ্ছে। অথচ গাভিকে ঠিকই খাবার দিতে হচ্ছে। ফলে খামারিরা লোকসানে পড়েছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে ঋণের দায়ে গবাদিপশু বিক্রি করা ছাড়া উপায় থাকবে না। পাবনার ফরিদপুর উপজেলার পার ফরিদপুর গ্রামের খামারি গোলাম মওলা, আরকান্দি গ্রামের হাফেজ আবদুল মোমিন, বাঙ্গাবাড়িয়া গ্রামের স্বপন মিয়া ও বাশুরিয়া গ্রামের জাকিন জানালেন, মিল্ক ভিটার বাঘাবাড়ী প্লান্টে দুধ সরবরাহ করতে না পারায় বাজারে ২০-৩০ টাকা লিটার দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। মিষ্টির দোকানিরাও এখন এত দুধ নিতে চাইছে না। তিন দিন আগে দুধ বিক্রি করতে না পেরে গ্রামের মানুষের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। দুধের চাহিদা ও দাম কমে যাওয়ায় লোকসান থেকে রেহাই পেতে অনেকে গাভি বিক্রি করে দিচ্ছেন। তেমনই একজন শাহজাদপুরের ব্রজবালা কুঠির পাড়া প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপক নূরুল ইসলাম। তিনি জানালেন, দেড় লাখ টাকার গাভি তিনি ১ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। সরবরাহ-সংকট: দুধ সংগ্রহ ব্যাহত হওয়ায় সারা দেশে প্যাকেটজাত পাস্তুরিত দুধের সরবরাহ কমে গেছে। বাজারে যত পাস্তুরিত দুধ পাওয়া যায় তার অর্ধেকই সরবরাহ করে মিল্ক ভিটা। স্বাভাবিক সময়ে ২ লাখ লিটারের বেশি দুধ সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। এখন করছে ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার লিটার। মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অবরোধে দুধ বিক্রি ও পরিবহন করা সম্ভব না হওয়ায় খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে সরবরাহও কমে গেছে। ব্র্যাক ডেইরির কর্মকর্তারা জানান, তাঁরা স্বাভাবিক সময়ে শীতকালে প্রতিদিন ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার লিটার দুধ সরবরাহ করেন। বর্তমানে সরবরাহ করছেন ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার লিটার। সরবরাহ করা দুধের ৪০ শতাংশই যায় ঢাকার বাইরে। পরিস্থিতির কারণে এই দুধই সরবরাহ করা কঠিন হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রাণ প্রতিদিন ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ লিটার দুধ সারা দেশে সরবরাহ করলেও এখন করছে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার লিটার। সংগ্রহ কম হওয়ায় পাস্তুরিত দুধের উৎপাদনও কমে গেছে প্রতিষ্ঠানটির। প্রাণের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান বলেন, কেবল ঢাকা ও আশপাশের এলাকাগুলোতেই এখন দুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। এর বাইরে কিছু দুধ যাচ্ছে সিলেট ও চট্টগ্রামে।

No comments:

Post a Comment