Thursday, January 15, 2015

কর্মকর্তার বদলাবদলিতে ঘুরে যায় মামলার মোড়:যুগান্তর

দুর্নীতির অভিযোগ আসে, কমিটিতে বাছাই হয়, এরপর সুপারিশ অনুযায়ী শুরু হয় অনুসন্ধান। প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয় অনুসন্ধান কর্মকর্তা (ইও)। তিনি কাজ শুরু করেন। কিন্তু কিছুদূর এগোনোর পর তাকে প্রত্যাহার করে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয় অন্য কোনো কর্মকর্তাকে। প্রায় একই রকম ঘটে তদন্ত কার্যক্রমেও। তদন্ত কর্মকর্তা রেকর্ডপত্র তলব, সাক্ষ্য গ্রহণ, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে হয়তো মামলার চার্জশিট দাখিলের সুপারিশ করেন।
দেখা যায়, কমিশন সেই সুপারিশ আমলে না নিয়ে পুনঃতদন্তে নিয়োগ দিচ্ছেন আরেক কর্মকর্তাকে। যিনি চার্জশিটের পরিবর্তে আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে সুপারিশ করেন ফাইনাল রিপোর্টের। কমিশন পরের কর্মকর্তার সুপারিশই অনুমোদন করে। দায়মুক্তি পেয়ে যান অভিযুক্তরা। এভাবে অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তা (ইও এবং আইও) পরিবর্তনের বিষয়টি নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়ালেও বিশ্লেষকরা বলছেন, একবার নিয়োগ দেয়ার পর কারণে-অকারণে কর্মকর্তা পরিবর্তন মূল কার্যক্রমকেই বিলম্বিত করে। অভিযোগ রয়েছে, কর্মকর্তা পরিবর্তনের আড়ালে হাসিল করা হয় নানামুখী উদ্দেশ্য। তবে কমিশনের দাবি, পুরো বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ১৮ ধারায় প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে কর্মকর্তারা অনুসন্ধান করেন। দুদক বিধি-২০০৭ এর বিধি-৭ অনুসারে তিনি অনুসন্ধান চালান। অন্যদিকে দুদক আইন-২০০৪ এর ২০ ধারায় তদন্তের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এ ধারার (২) উপধারা (১)-এ উল্লিখিত অপরাধসমূহ তদন্তের জন্য কমিশন গেজেটের মাধ্যমে অধস্তন কর্মকর্তাকে তদন্তের ক্ষমতা দেয়। নিয়োগের মধ্যে একবারেই অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষমতা দেয়া হয় বিধায় কেস টু কেস প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় না। আইনের (৩) উপধারা (২)-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সমান ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে তদন্ত করেন। দুদক বিধি-২০০৭ এর বিধি-১০ অনুসরণ করে তিনি তদন্ত পরিচালনা করেন। পুলিশ রেগুলেটরি অব বেঙ্গল (পিআরবি) অনুযায়ী তদন্ত কর্মকর্তা তল্লাশি, মামলার আলামত জব্দ এবং গ্রেফতার করতে পারেন। অভিযোগ অনুসন্ধানে কর্মকর্তা নিয়োগের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন কমিশনার (অনুসন্ধান)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেন কমিশনার (তদন্ত)। কমিশনের এখতিয়ার অনুযায়ী তারা এ নিয়োগ দিয়ে থাকেন। দুদক বিধিতে ইও কিংবা আইও নিয়োগের বিধান থাকলেও কর্মকর্তা পরিবর্তন সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা নেই। তবে কর্মকর্তা পরিবর্তন সংক্রান্ত নোটশিটে কারণ উল্লেখ করা হয়। সূত্র জানায়, কর্মকর্তা পরিবর্তনের বিবিধ কারণ থাকলেও সাধারণ কারণ রয়েছে কয়েকটি। যেমন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ওপর যদি কাজের চাপ বেশি থাকে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান/তদন্ত সম্পন্ন করতে না পারেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি কমিশনের কাছে আবেদন করেন যে, বিদ্যমান কর্মকর্তার কাছ থেকে তিনি ন্যায়বিচার পাবেন না বা তিনি পক্ষপাতিত্ব করছেন- তাহলে ভবিষ্যতে বিচারে যাতে প্রশ্ন না ওঠে- এ বিবেচনা থেকে কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়। এছাড়া কমিশন যদি মনে করে, বিদ্যমান কর্মকর্তার কাছ থেকে নিরপেক্ষ ও মানসম্পন্ন অনুসন্ধান/তদন্ত পাওয়া সম্ভব নয়- তাতেও কর্মকর্তা বদলে দিতে পারেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার পদোন্নতি, বদলি, অবসর গ্রহণের কারণেও কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়। এক কর্মকর্তার হাত থেকে অন্য কর্মকর্তার হাতে নথিপত্র পৌঁছা পর্যন্ত বহু সময়ক্ষেপণ হয়। সূত্র মতে, দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তে কালক্ষেপণের একাধিক কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ, সময়সীমা অনুসৃত না হওয়া। অনুসন্ধান সম্পন্ন করার সময়সীমা থাকলেও সেটি এখনও বাধ্যতামূলক করা হয়নি। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, অনুসন্ধানের সময়সীমা দুই দফায় ৩০ (১৫+১৫) কার্যদিবস। তদন্তের সময়সীমা দুই দফায় ১৮০ (১২০+৬০) কার্যদিবস। এ সময়সীমা প্রতিপালন বাধ্যতামূলক না হওয়ার কারণেও অনুসন্ধান ও তদন্তে সময়ক্ষেপণ হয়। তবে এ বিষয়ে বিধানে সুস্পষ্ট কিছু না থাকায় ইও-আইও পরিবর্তনের বিষয়টি এখনও কমিশনের ইচ্ছাধীন। তবে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু এ বিষয়ে বলেছেন, এটি একটি নিয়মিত বিষয়। যদি প্রতীয়মান হয়, এ কর্মকর্তার কাছ থেকে কাক্সিক্ষত তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া সম্ভব নয়- তখন তার পরিবর্তে অন্যজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। একই ব্যক্তিকে দিয়ে মামলা রুজু আবার তাকে দিয়েই তদন্ত করালে সঠিক ফলাফল নাও আসতে পারে। সূত্র মতে, গত এক বছরে দুদক ১৪৩টির মতো আলোচিত ঘটনায় অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করেছে। পরিবর্তিত কর্মকর্তারা প্রতিবেদন দিয়েছেন আগের কর্মকর্তার ঠিক বিপরীত। অনুসন্ধানে নেমে এক কর্মকর্তা বলেছেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়, দুর্নীতি হয়েছে। পরের কর্মকর্তা বলেছেন, অনুসন্ধানে সুফল পাওয়া যাবে না। অভিযোগ নথিভুক্ত করাই ন্যায়সঙ্গত। আবার মামলার এজাহারে এক কর্মকর্তা বলছেন, দুর্নীতি হয়েছে। পরের কর্মকর্তা বলছেন, দুর্নীতি হয়নি। এমন পরস্পরবিরোধী হরহামেশা ঘটছে দুদকে। সূত্র আরও জানায়, গত এক বছরে যে ১৪৩টি আলোচিত মামলার তদন্ত, ব্যক্তির অভিযোগ অনুসন্ধানে কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়েছে তার মধ্যে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সরকারদলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন বেশি। বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার আইনে অনুসন্ধান শেষে মামলা করেন তৎকালীন উপপরিচালক (বর্তমানে পরিচালক) নাসিম আনোয়ার। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় উপপরিচালক আহসান আলীকে। তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠালে তদন্তের দায়িত্ব নাসিম আনোয়ারকে দেয়া হয়। কক্সবাজারের এমপি আবদুর রহমান বদি, সাবেক ধর্মমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়ার এপিএস সৌমেন্দ্রলাল চন্দ শৈলেনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও মামলা করেন আহসান আলী। তাকে পরিবর্তন করে বদির মামলার তদন্তভার দেয়া হয় উপপরিচালক আবদুস সোবহানকে। পরে তাকেও প্রত্যাহার করে দায়িত্ব দেয়া হয় উপপরিচালক মঞ্জুর মোরশেদের নেতৃত্বে গঠিত দুই সদস্যের টিমকে। এটি এখন প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে। শৈলেনের মামলায় তদন্তভার দেয়া হয় উপপরিচালক শেখ মেসবাহউদ্দিনকে। আলোচিত পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয় কয়েক দফা। পরামর্শক নিয়োগে ঘুষ গ্রহণের চেষ্টার অভিযোগে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদ। এজাহারে ঘটনার সঙ্গে আসামিদের সম্পৃক্ততা তুলে ধরে দুর্নীতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলমকে। দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তিনি আসামিদের অব্যাহতির সুপারিশ করেন। আলোচিত বেসিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানেও কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়েছে কয়েকবার। দুদকের সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম, উপপরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে গঠিত টিম, উপপরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন পর্যায়ক্রমে এটির অনুসন্ধান করেন। উপপরিচালক আবদুল হোসেনও এটি অনুসন্ধানের অফিস আদেশ পান। পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুরের বিরুদ্ধে জনবল নিয়োগের দুর্নীতি অনুসন্ধানে নিয়োগ দেয়া হয় সহকারী পরিচালক শেখ আবদুস সালামকে। তিনি ড. হোসেন মনসুর, কর্ণফুলী গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) এমডিসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেন। কমিশন সুপারিশ অগ্রাহ্য করে কর্মকর্তা পরিবর্তন করে। দায়িত্ব দেয় উপপরিচালক ঋত্বিক সাহার নেতৃত্বে দুই সদস্যের টিমকে। ওই টিম প্রায় একই প্রতিবেদন দাখিল করলে সেটি কমিশনের মনঃপূত হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক মো. সহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির অভিযোগ অনুসন্ধান করেন সহকারী পরিচালক সেলিনা আক্তার মনি। তিনি সহিদের বিরুদ্ধে মামলা রুজুর সুপারিশ করেন বলে জানা যায়। পরে তাকে পরিবর্তন করে দায়িত্ব দেয়া হয় উপপরিচালক মো. জুলফিকার আলীকে। এটিও এখন পুনঃঅনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বিতর্কিত ধনকুবের মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয় ২০১০ সালে। চার বছর বিষয়টি পড়ে থাকলেও কোনো প্রতিবেদন দাখিল হয়নি। এরই মধ্যে পরিবর্তন করা হয় দুই কর্মকর্তা। উপপরিচালক আখতার হামিদ ভুঁইয়া, উপপরিচালক শেখ ফাইয়াজ আলমের হাত হয়ে এখন উপপরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর কাছে রয়েছে। আইডিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটির (আইসিএল) বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু হয় ২০১৩ সালে। উপপরিচালক নাসির উদ্দিনের কাছে দেড় বছরের বেশি পড়ে থাকার পর দায়িত্ব দেয়া হয় উপপরিচালক মো. হামিদুল হাসানকে। এভাবে একের পর এক কর্মকর্তা পরিবর্তনে দুদকের কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতা, অনুসন্ধান ও তদন্তে নিরপেক্ষতা এবং গুণগত মান বজায় থাকছে না বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের এখতিয়ার কমিশনের রয়েছে। এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এটি যদি প্রবণতা হয়ে থাকে তাহলে তা দীর্ঘসূত্রতারই সুযোগ সৃষ্টি করবে। অনুসন্ধান বা তদন্তের কোনো একটি পর্যায়ে কারণবশত হাতবদল হলে তদন্তের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।  

No comments:

Post a Comment