Sunday, January 25, 2015

পেট্রলবোমায় ছারখার:কালের কন্ঠ

আছিয়ার (৪) চোখের ওপর একটা মাছি ভনভন করছে। পোড়া গন্ধে ঘুরেফিরে বারবারই বসার চেষ্টা শিশুটির চোখে-মুখে। পাশে বসে কখনো নানি শরিফা বেগম কখনো বাবা আজিমুদ্দিন ওই মাছি তাড়াচ্ছেন। কিন্তু দুই চাখ মেলে দেখার সাধ্য নেই আছিয়ার। এক দিন আগের ফুটফুটে চেহারা এখন পেট্রলবোমায় বিকৃত-বীভৎস। এ দৃশ্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (রামেক) বার্ন ইউনিটের। প্রায় একই দৃশ্য দেখা গেছে রংপুর মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটেও।
পোড়ার তীব্র জ্বালার চিৎকারে ভারী হয়ে আছে আশপাশ। প্রায় একই রকমভাবেই অসহায়তার দহনে জ্বলছে তাদের স্বজনরাও। যার বেশির ভাগই অতি সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ। পোড়াদের মধ্যে যেমন আছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, তেমনি আছে আছিয়ার মতো শিশু। যাদের চিকিৎসা ব্যয় বহনের সাধ্য পরিবারের নেই। রামেক বার্ন ইউনিটে সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে গতকাল শনিবার সকালে দেখা মেলে আছিয়ার। সংকটাপন্ন শিশুটির শ্বাসনালিসহ শরীরের ১২ শতাংশ পুড়ে গেছে। আইসিইউতে থাকা মেয়েটির খরচ বহন করছে সরকার। অন্যথায় ভ্যানচালক বাবার এই শিশুর চিকিৎসাও হয়তো বন্ধ হয়ে যেত। গত শুক্রবার আত্মীয়র বাসা থেকে ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয় আছিয়া, তার নানা মকবুল, নানি আনোয়ারা বেগমসহ অন্তত ১০ জন। পারিবারিক সূত্র আরো জানায়, মকবুলের ভাই কবির হোসেনের মেয়ে শিউলি বেগমের মেয়ে আছিয়া। তার বাবা আজিমুদ্দিনের আরেক মেয়ে ফারহানাও (৮) বুদ্ধি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। ছোট মেয়ে আছিয়াও আগুনে পুড়ে যাওয়ায় এবং তার জীবন সংকটাপন্ন হওয়ায় গতকাল হাসপাতালের বারান্দায় বসে বারবার বিলাপ করে মা বলছিলেন, 'আমি কী পাপ করলাম যে আমার এত বড় সর্বনাশ করে দিল ওরা। এক মেয়ে প্রতিবন্ধী। ছুট এই মেয়েকে নিয়ে কত না শুখ স্বপ্ন দেখেছিনু। এখন বুঝি সবই শেষ হয়ে যাবে। মেয়েকেই হয়তো আর ফিরে পাব না।' বার্ন ইউনিটের মেয়েদের ওয়ার্ডের দ্বিতীয় শয্যায় শুয়ে আছে পুড়ে দগ্ধ হওয়া আরেক শিশু ফারজানা খাতুন (৭)। সেও নানির সঙ্গে ওই বাসে চড়ে ঢাকায় যাওয়ার সময় দগ্ধ হয়। ফারজানারও মুখের বেশির ভাগ পুড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া অংশগুলো দিয়ে বের হচ্ছিল পানি। সেও কোনো কথা বলতে পারছিল না। এক চোখ ফুলে যাওয়ায় আরেক চোখ দিয়ে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিল সে। তানোরের ইলান্দ গ্রামের বাসিন্দা ফারজানার বাবা জালাল উদ্দিন একজন রিকশাচালক। তিনি বলেন, 'মেয়ের যাই হোক না কেন, তাকে ফিরে পেয়েছি, তাতেই আমরা খুশি। সে আগুনে পুড়ে মারা যেতেও পারত। তবে তার এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী তাদের তিনি কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন। শুক্রবারের ঘটনায় ফারজানার নানি জুলেখা বেগমও দগ্ধ হয়েছেন। তাঁকেও রামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। গার্মেন্টকর্মী জুলেখা বেগম ফারজানাকে নিয়ে আজ শনিবার কাজে যোগ দিতে ঢাকায় ফিরছিলেন। জুলেখা বেগম ও তাঁর স্বামী মজিবর রহমান দুজনেই ঢাকা ও গাজীপুরের দুটি পৃথক গার্মেন্টে চাকরি করেন। গত মঙ্গলবার জুলেখার এক বোনের বাচ্চা হয়েছে শুনে তিনি তাঁকে দেখতে ঢাকা থেকে তানোরের ইলান্দ গ্রামের বাড়িতে আসেন। বার্ন ইউনিটের পুরুষ ওয়ার্ডের ৪ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন আরেক দিনমজুর আশরাফুল ইসলাম। হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক আফরোজা নাজনীন জানান, আগুনে আশরাফুলের গোটা মুখসহ শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁকেও আইসিইউতে নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে শয্যা সংকটের কারণে তাঁকে বার্ন ইউনিটে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছেন পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ আরো পাঁচজন। দিনাজপুর-পঞ্চগড় সড়কের কাহারোল উপজেলার গড়েয়া ভাদগাঁ সেতুর কাছে কাচভর্তি ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হন ট্রাকচালক রফিকুল ইসলাম। প্রথমে তাঁকে দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখান থেকে গত বৃহস্পতিবার তাঁকে রংপুর মেডিক্যালে আনা হয়। চিকিৎসাধীন রফিকুল ইসলামের স্ত্রী হালিমা বেগম বলেন, 'বুধবার বিকেলে ওনার সঙ্গে আমার কথা হলে ছোট মেয়ে রুমার নোটবই আনতে বলেছিলাম। কিন্তু ভোরে হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানানো হয় তিনি অসুস্থ।' রংপুরের বদরগঞ্জের আসাদুল ঢাকায় রিকশা চালান। রংপুর থেকে অবরোধ চলাকালে গত ১১ জানুয়ারি এনা পরিবহনে ঢাকায় ফিরছিলেন। পথে গোবিন্দগঞ্জে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন তিনি। এখনো চিকিৎসাধীন। তাঁর স্ত্রী সেলিনা জানান, দুই সন্তানসহ চারজনের সংসার চলে আসাদুলের আয়ে। এখন কয়েক দিন ধরে সে পথও বন্ধ। বরং তাঁর চিকিৎসায় প্রচুর খরচ হচ্ছে। তিনি বলেন, 'নিজেদের খাবারই নাই। এলা হামার কী হইবে, আল্লায় জানে।' রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট এবং প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. মারুফুল ইসলাম জানান, ভূষিরবন্দরের ঘটনায় দগ্ধ হেলপার আব্দুর রশিদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তবে বাকিদের শঙ্কা কেটে গেলেও সম্পূর্ণ সেরে উঠতে সময় লাগবে।    

No comments:

Post a Comment